শামীম ও খালেদের মধ্যে লড়াইটা ‘হাড্ডাহাড্ডি’ হবে বলেই ধারণা করছেন স্থানীয়রা।
Published : 04 Jan 2024, 07:40 PM
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি না থাকায় দেশের অনেক স্থানের মতো শরীয়তপুরের আওয়ামী লীগ প্রার্থীরাও ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতা’ করছেন দলের স্বতন্ত্র প্রাথীদের সঙ্গেই; তবে এ জেলার তিন আসনের একটি ছাড়া বাকিগুলোতে সেই লড়াইও তেমন জমছে না।
শরীয়তপুর-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য এ কে এম এনামুল হক শামীম দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য দ্বিতীয় দফায় নৌকার টিকেট পেলেও ভোটে জিততে তাকে মোকাবিলা করতে হবে যুবলীগ নেতা ও স্বতন্ত্র প্রার্থী খালেদ শওকত আলীকে।
শামীম আর খালেদের আসনের কথা বাদ দিলে জেলার অন্য দুটি আসনের চিত্র ভিন্ন।
শরীয়তপুর-১ (পালং-জাজিরা) আসন ও শরীয়তপুর-৩ (ভেদরগঞ্জ উপজেলার একাংশ, ডামুড্যা ও গোসাইরহাট) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা তেমন ‘শক্তিশালী না হওয়ায়’ নৌকার প্রার্থীরা ‘নির্ভার’ রয়েছেন বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম বর্তমানে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন। আর ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী খালেদ শওকত আলী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য।
খালেদ শওকত আলী নড়িয়া-সখিপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত শরীয়তপুর-২ আসনের আওয়ামী লীগের পাঁচবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও ডেপুটি স্পিকার প্রয়াত কর্নেল শওকত আলীর ছেলে। তিনি ১৯৯১ সালে পঞ্চম, ১৯৯৬ সালে সপ্তম, ২০০১ সালে অষ্টম, ২০০৮ সালে নবম ও ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এ আসনে এখন স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা দুই পক্ষে ভাগ হয়ে গেছেন। তবে গত পাঁচ বছরে ‘অধিকার বঞ্চিত’ নেতাকর্মীরাই মূলত যোগ দিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে। শামীম-শওকত দুই পক্ষেই জনসমর্থন থাকায় লড়াইটা ‘হাড্ডাহাড্ডি’ হবে বলেই ধারণা করছেন স্থানীয়রা।
এ আসনে ভোটের হাওয়া কোনদিকে বইছে তা বোঝার জন্য স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তারা দু্ই প্রার্থীর বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার কথা বলছিলেন।
নড়িয়া শহরের ব্যবসায়ী রমজান ঢালী বলেন, “এই আসনে ভোটের আমেজ পুরোপুরি শুরু হয়ে গেছে। অন্য আসনগুলোতে ‘একতরফা’ নির্বাচন হলেও এখানে শামীম-খালেদ শওকতের মধ্যে ‘হাড্ডাহাড্ডি লড়াই’ হবে।”
একই এলাকার মনির হোসেন ও রনি মিয়াও নৌকা আর ঈগল প্রতীকের মধ্যে লড়াই হবে বলেই আভাস দিলেন।
নড়িয়া উপজেলার ভোগেশ্বর ইউনিয়ন পরিষদের আনাখন্দ গ্রামের আজগর আলা খাঁ বলেন, “শামীম ভাই এমপি হওয়ার পর থেকে তার কাছে যেতেই পারি নাই। আমাদের আগের এমপির ছেলে খালেদ শওকত আলী যেহেতু এবার স্বতন্ত্র হিসেবে দাঁড়িয়েছেন; আমরা তারেই সমর্থন করছি।”
একই কথা বলেন ওই এলাকার চুনুর ঢালী।
নড়িয়া সদরের বৈশাখীপাড়া এলাকার আব্দুল কইয়ুম ও রব হওলাদার নৌকার পক্ষে। তারা বলেন, নড়িয়া হলো আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। এখানে নৌকার প্রার্থী শামীমই আবার পাস করবেন। এখানে স্বতন্ত্রের কোনো সমর্থন দেখি না।
নড়িয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাছানুজ্জামান খোকনের সুর শামীমের পক্ষে।
তিনি বলেন, “আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছি। জনগণ নৌকার বাইরে যাবে না। তারা প্রতীক চিনে; তারা নৌকায় ভোট দেবে।”
জয়ের ব্যাপারে ‘আশাবাদী’ এনামুল হক শামীম বলেন, “নড়িয়ায় কখনও নৌকা পরাজিত হয় নাই; হবেও না। এ এলাকার প্রধান সমস্যা ছিল নদী ভাঙন, আমি গতবার নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথমে নদী ভাঙন রোধ করেছি। রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। এ এলাকায় কোনও মারামারি-কাটাকাটি নাই।”
নিজের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, “শত শত মানুষকে ডিপ টিউবয়েল, ঢেউটিন ও নগদ অর্থ দিয়েছি। নড়িয়াতে বিদ্যুতের সঙ্কট ছিল। আমি ১০ মেগাওয়াট থেকে ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দিয়েছি।
“বঙ্গবন্ধুর সৈনিকরা কখনও শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ ও নৌকার প্রশ্নে আপস করে না। আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে নৌকা ভোট বিপ্লবের মাধ্যমে আবারও ক্ষমতায় আসবে।”
এদিকে ভোটে দাঁড়িয়ে ‘ব্যাপক জনসমর্থন’ পাচ্ছেন দাবি করে স্বতন্ত্র প্রার্থী খালেদ শওকত আলী বলেন, “আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাষায় এবারের নির্বাচন সৌন্দর্য্য; আমরা সেই সৌন্দর্য্য রক্ষা করছি। যেন একটি প্রতিযোগিতামূলক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়, তাই ভোটে দাঁড়িয়েছি। সাধারণ মানুষের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। বিজয়ের ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী।”
নড়িয়া পৌরসভা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আল আমিন হামজাও বিশ্বাস করেন, ‘বিপুল ভোটে’ স্বতস্ত্র প্রার্থী খালেদ শওকত আলী জয়ী হবেন।
জেলার উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত শরীয়তপুর-১ আসনের নড়িয়া উপজেলায় ১৪টি ইউনিয়ন, একটি পৌরসভা ও সখিপুর থানার নয়টি ইউনিয়ন রয়েছে।
৩ লাখ ৮২ হাজার ৩৬৬ জন ভোটারের এ আসনের বাকি প্রার্থীরা হলেন- গণফ্রন্টের কাজী জাকির হোসেন (মাছ), বাংলাদেশে খেলাফত আন্দোলনের মাহমুদুল হাছান (বটগাছ), বিকল্প ধারা বাংলাদেশের মো. আমিনুল ইসলাম (কুলা), জাতীয় পাটির মো. ওয়াহিদুর রহমান (লাঙ্গল), ন্যাশনাল পিপলস পার্টির মো. আবুল হাসান (আম), জাসদের মো. ফিরোজ মিয়া (মশাল), মুক্তিজোটের মো. মনির হোসেন (ছড়ি) ও বাংলাদেশ কংগ্রেসের সৌমিত্র দত্ত (ডাব)।
শরীয়তপুর-১
এই আসনে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলেও আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ইকবাল হোসেন অপু প্রতীক বরাদ্দের পর থেকেই ব্যাপক প্রচার শুরু করেছেন। পোস্টার সাঁটানো, মাইকিং ও পাড়া-মহল্লায় গণসংযোগ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি।
বাকি প্রার্থীরা হলেন- স্বতন্ত্র মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা (ঈগল), তৃণমূল বিএনপির আবুল বাশার মাদবর (সোনালী আঁশ), বাংলদেশ খেলাফত আন্দোলনের মো. আব্দুস সামাদ (বটগাছ) ও জাতীয় পাটির মো. মাসুদুর রহমান মাসুদ (লাঙ্গল)।
এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছাড়া কারও কোনো প্রচার নেই বলে ভোটাররা জানিয়েছেন।
শরীয়তপুর সদর পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মজিদ মাঝি ও আলমগীর হোসেন বলেন, “আওয়ামী লীগ ছাড়া এখানে কেউ জিতে নাই; জিতবেও না। স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কেউ ভোট দেয় কি-না সন্দেহ।”
পালং উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন, ১টি পৌরসভা এবং জাজিরা উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত এ আসন। এখানে ৩ লাখ ৬৩ হাজার ৩৪৯ জন জাতীয় নির্বাচনে প্রতিনিধি বাছাইয়ের সুযোগ পাবেন।
শরীয়তপুর-৩
এখানে নৌকার মাঝি হয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাক। আওয়ামী লীগ সরকারের নানা উন্নয়ন কার্যক্রম তুলে ধরে ভোটারদের কেন্দ্রে উপস্থিত করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন তিনি। কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থী না থাকায় ভোটারদের মধ্যে নেই নির্বাচনি আমেজ।
শরীয়তপুর সদর ও ডামুড্যা এলাকার ভোটার কালাম শেখ বলেন, “পরিচিত ও প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো প্রার্থী না থাকায় আমাদের এলাকায় নির্বাচনি আমেজ নেই।”
একই এলাকার বিল্লাল ছৈয়াল, কাশেম মীর ও জনি সিকদার জানান, নৌকার প্রার্থী কেন্দ্রে ভোটার টানার চেষ্টা করছেন ঠিকই, কিন্তু ভোটের সেই আমেজই তো নাই।
নাহিম রাজ্জাক আওয়ামী লীগ নেতা ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে। বাবার মৃত্যুর পর নাহিম ২০১৪ সালে উপ-নির্বাচনে এবং ২০১৮ সালে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হন। তৃতীয়বারের মত নৌকার সমর্থন পেয়েছেন তিনি।
এ আসনে অন্য প্রার্থীরা হলেন- ইসলামী ঐক্যজোটের কা হা মা মো. মাহদী হাসান (মিনার), জাতীয় পাটির মো. আব্দুল হান্নান (লাঙ্গল), বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের মো. সিরাজ চৌকিদার (ফুলের মালা)।
জেলার সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত এ আসনে রয়েছে ভেদরগঞ্জ উপজেলার ৪টি ইউনিয়ন, ১টি পৌরসভা, ডামুড্যা উপজেলার ৭টি ইউনিয়ন, ১টি পৌরসভা এবং গোসাইরহাট উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা। এ আসনে ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৬৯৩ জন ভোটার রয়েছেন।