ওই ঘটনাটি ‘নিষ্ঠুর, অমানবিক’ই শুধু নয়, মানবাধিকার পরিপন্থিও, বলছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র।
Published : 21 Dec 2022, 08:53 PM
গাজীপুরের কালিয়াকৈরে হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি নিয়ে বিএনপি নেতার মায়ের জানাজা পড়ানো কারাবিধি মোতাবেক হয়েছে এবং এতে আইনের ব্যত্য়য় ঘটেনি বলে দাবি করছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
এই ঘটনা নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সমালোচনার মুখে বুধবার গাজীপুর জেলা প্রশাসক মো. আনিসুর রহমান ও জেলা কারাগারের জেল সুপার মো. বজলুর রশিদ আখন্দ এ দাবি করেন।
গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মো. আলী আজমের মা সাহেরা বেগম (৬৭) বার্ধক্যজনিত কারণে রোববার বিকালে মারা যান।
শেষবারের মতো মাকে দেখতে এবং জানাজা নিজে পড়াতে আইনজীবীর মাধ্যমে সোমবার (১৯ ডিসেম্বর) বিকালে গাজীপুর জেলা প্রশাসক বরাবর প্যারোলে মুক্তির আবেদন করেন আলী আজম। মঙ্গলবার তিন ঘণ্টার জন্য প্যারোলে মুক্তি পান এবং বাড়ি কালিয়াকৈরের পাবুরিয়াচালায় মায়ের জানাজায় উপস্থিত হন। মায়ের দাফন শেষে আবার কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে।
জানাজার নামাজসহ পুরো সময় হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় ছিলেন আলী আজম।
সোশাল মিডিয়াসহ সংবাদ মাধ্যমে এ খবর ও ছবি ছড়িয়ে পড়লে সমালোচনা শুরু হয়।
এ সময় আলী আজমের স্বজনরা ডান্ডাবেড়ি খুলে দিতে অনুরোধ করলেও পুলিশ তা করেনি বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে গাজীপুর জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান বলেন, “প্যারোল প্রদানের কর্তৃপক্ষ হলো জেলা প্রশাসক। আমার কাছে আবেদন করেছে আমরা সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নির্দেশনা সম্বলিত প্যারোলে মুক্তির আদেশ দিয়েছি।
“এখন এখানে জেলকোড বা অন্যান্য বিষয়ে পুলিশের নিজস্ব সিকিউরিটি নিয়ে যারা কাজ করে আপনার বরং তাদের কর্তৃপক্ষের কাছে জিজ্ঞাসা করাই ভালো।”
তিনি এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি ঢাকার আদালত চত্বর থেকে জঙ্গির পলায়নের বিষয়টিও স্মরণ করিয়ে দেন।
“যেহেতু সম্প্রতি একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে; জেল কোডে কিন্তু ডান্ডাবেড়ি পরানোর কথা বলা আছে। তবে এটা জানাজার সময় খুলবে কি খুলবে না, এ বিষয়টি নিয়ে পুলিশের সাথে বা নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা ছিলেন তাদের সাথে কথা বলেন। আমরা তো সর্বোচ্চ নিরাপত্তার কথা বলে দিয়েছি। তবে এটা নিয়ে একটা মানবিক বিষয় এসেছে এছাড়া আইনের কোনো বড় ব্যত্যয় ঘটেনি।”
গাজীপুর জেলা কারাগারের জেল সুপার বজলুর রশিদ বলেন, “আসামি জেলের বাইরে গেছে, তাই নিরাপত্তার জন্য ডান্ডাবেড়ি দিয়েছি। ওয়ারেন্টে দাগি-নিদাগি কোনো কিছু বলা থাকে না। আমি শুধু তাদের সেকশনগুলো (ধারা) দেখি। সেকশনে আছে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে ৩, ৪, ৫ ধারা; বিস্ফোরক আইনের মামলা আমি কি ছোট করে দেখব? আমি কোন মামলা ছোট করে দেখব? ৩৮০ ধারার মামলা, গরুর চুরি মামলা, আমি সেটাও আমি ছোট করে দেখতে পারি না।”
জঙ্গিদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “দেশের জঙ্গিরা কারাগারে থাকাবস্থায় আমাদের সাথে মধুর ব্যবহার করে; আবার যখন ঘটনা ঘটায় তখন আমাদের দায়িত্ব নিতে হয়; জবাবদিহিতা আমাদেরই দিতে হয়। এখানে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। জেল কোডে ডান্ডাবেড়ি পরানোর কথা বলা আছে।”
গাজীপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শাহ রিয়াজুল হান্নান বলেন, “আমরা বারবার বলে আসছি দেশে কোনো আইনের শাসন নাই, মানবাধিকার নাই, আইনের সঠিক প্রয়োগ নাই; সেখানে এসব ঘটনা ঘটতেই থাকবে। সারাদেশে ধারাবাহিকভাবে এবং নিয়মিতভাবে মানবাধিকার নির্মমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। গাজীপুরের এ ঘটনাটি তার বাস্তব উদাহরণ।”
একজন রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিকের সঙ্গে এমন আচরণে তিনি তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।
আলী আজমের ভাই আতাউর রহমান বলেন, জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করলে তার ভাইকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়। জানাজা পরানোর সময় তার হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি খুলে দিতে বলা হয়েছিল; কিন্তু পুলিশ খুলে দেয়নি।
হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি খুলে না দেওয়ায় জানাজায় উপস্থিত লোকজনও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
নিষ্ঠুর ও অমানবিক: আসক
গাজীপুরের কালিয়াকৈরের বিএনপি নেতা আলী আজমকে হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় মায়ের জানাজায় অংশ নিতে পাঠানোর নিন্দা জানিয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলেছে, ওই ঘটনাকে নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অসংবেদনশীল।
মানবাধিকার সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক নূর খান স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বিচার বা দণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না।
“সংবিধানে এমন বিস্তৃত অধিকার থাকা সত্ত্বেও একজন সাধারণ নাগরিককে মায়ের জানাজায় ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে নিয়ে যাওয়া কেবল অমানবিকই নয়, বরং মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থি।
“পাশাপাশি এক্ষেত্রে কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ডান্ডাবেড়ি পরানো বিষয়ক উচ্চ আদালতের যে নির্দেশনা রয়েছে, সেটাও অনুসরণ করা হয়নি।”
আলী আজম কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকায় গত ২৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগ এর কার্যালয়ে হামলার অভিযোগে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে করা মামলায় ২ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার হন।
তার বিরুদ্ধে করা এই মামলার বাদী এই ঘটনা ও মামলার বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশের কথাও আসকের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
এতে আরও বলা হয়, ““এছাড়া আলী আজম কোনো সুনির্দিষ্ট মামলার আসামি নন বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে বরং তিনি একটি গায়েবি রাজনৈতিক মামলার আসামি। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এ ধরনের নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অসংবেদনশীল আচরণের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে।”
আরও পড়ুন: