এমনকি খাবার দিলেও হাত-পায়ে ভর দিয়ে চতুষ্পদী প্রাণীর মতই খাচ্ছিল সে। একইসঙ্গে শব্দচয়নও ছিল কুকুরের মত।
Published : 15 Jan 2025, 04:53 PM
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে ভর্তি করানোর পর খোঁজ মিলছে না ‘অপ্রকৃতিস্থ’ আচরণ করা এক শিশুর।
অজ্ঞাত পরিচয়ের ১২ বছর বয়সী শিশুটিকে সোমবার দুপুরে লাকসাম থেকে উদ্ধারের পর রাতে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল। কিন্তু মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পরিচালক মো. মাসুদ পারভেজ বলেন, “কোনো রোগী খুঁজে পাওয়া না গেলে ২৪ ঘণ্টা পর তাকে পলাতক ঘোষণা করি- এর বাইরে আর কিছুই করার নেই।”
তবে অভিভাবক বা স্বজন কেউ না থাকা অসুস্থ শিশুটির বিশেষায়িত যত্ন না নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এভাবে দায় এড়াতে পারে না বলে মনে করছেন কুমিল্লার সমাজকর্মীরা।
লাকসাম স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, জলাতঙ্কের মতো অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত অজ্ঞাত শিশুটি লাকসাম জগন্নাথ দিঘির পাড়ে কুকুরের মত আচরণ করতে দেখা যায়। কুকুরের অনুকরণে হাঁটা ও চলাফেরা করছিল।
এমনকি খাবার দিলেও হাত-পায়ে ভর দিয়ে চতুষ্পদী প্রাণীর মতই খাচ্ছিল সে। একইসঙ্গে শব্দচয়নও ছিল কুকুরের মত।
শিশুটির অদ্ভুত আচরণে আতঙ্কে ছিলেন স্থানীয় ও পথচারীরা। তার এই ধরনের আচরণের ভিডিও ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
খবর পেয়ে লাকসাম উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা নাজিয়া বিনতে আলম শিশুটিকে উদ্ধার করে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশুটিকে রেফার করেন তিনি।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নাজিয়া বিনতে আলম বলেন, “ছেলেটি জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত নয়। আমরা যখন তাকে পেয়েছি- সে কথা বলতে পারেনি। যতটুকু ধারণা করা যাচ্ছে, সে মানসিক নির্যাতনের শিকার। লাকসামে চিকিৎসা সম্ভব নয় বিধায় আমরা তাকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠাই।”
পরে সোমবার সন্ধ্যায় লাকসাম উপজেলা থেকে একজন পুলিশ কর্মকর্তা ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন কর্মী শিশুটিকে মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগে এনে ভর্তি করিয়ে দিয়ে যায়।
প্রাথমিক চিকিৎসার পর কিছুটা স্বাভাবিক আচরণ
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, মেডিসিন বিভাগে শিশুটিকে প্রাথমিক চিকিৎসা ও খাবার দাবার দেয়ার পরে কিছুটা স্বাভাবিক আচরণ শুরু করলেও স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারছিল না।
মেডিসিন ওয়ার্ডের পুরুষ বিভাগের নার্সেস ইনচার্জ আইরিন আক্তার বলেন, “তাকে ডাক্তাররা দেখে কিছু ওষুধপত্র দেয়ার পর সে স্বাভাবিক আচরণ করে। সে তখন দুই পায়ে হাঁটছিল। চিকিৎসকরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করেছে সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ”
তবে মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকে তাকে আর দেখা যায়নি।
স্টাফ অঞ্জলি রানী দাশ জানান, “আমি তাকে দেখাশোনা করেছি। মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত তাকে দেখেছি। দুপুর দুইটার সময়ও একজন স্টাফ তাকে দেখেছে। এরপর শিফট বুঝিয়ে দেবার সময় তাকে আর খুঁজে পায়নি।”
ওয়ার্ডের নার্স ও আয়া থেকে শুরু করে বেশ কয়েকজন সদস্য তন্ন তন্ন করে খুঁজেন, কিন্তু কোথাও পাওয়া যায়নি শিশুটির সন্ধান।
তবে আশপাশের ভর্তি রোগীরা জানান, শিশুটিকে ভর্তি করানোর পরে দেওয়া হয়নি কোনো বেড। সারারাত শিশুটি ছিল ফ্লোরে। দুপুর পর্যন্ত কেউ তার খোঁজ খবরও নেয়নি।
নাম প্রকাশ করতে না চাওয়া মেডিসিন ওয়ার্ডের দুইজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, শিশুটি দীর্ঘদিন যাবত কোনো মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে যাচ্ছিল- যে কারণে সে অস্বাভাবিক আচরণ করে। এছাড়া সে বেশ ক্লান্ত এবং দুর্বল ছিল।
তাকে জলাতঙ্ক বলে ভর্তি করানো হলেও- সে হাসপাতালে ভর্তির পর পানি ও বিস্কুট খেয়ে স্বাভাবিকভাবেই আচরণ করছিল। জলাতঙ্ক আক্রান্ত বলে মনে হয়নি।
এই চিকিৎসকরা বলেন, আরো কিছু সময় পর্যবেক্ষণ করা গেলে বোঝা যেত সে কি রোগে আক্রান্ত। তাকে কোন মানসিক রোগের চিকিৎসক দেখালে বোঝা যেত। কিন্তু হঠাৎ করেই তাকে আর ওয়ার্ড থেকে পাওয়া যায়নি।
সরকারি হাসপাতালে আলাদাভাবে রেখে চিকিৎসা দেয়ার সুযোগ তেমন নাই, বলে অসহায়ত্বও প্রকাশ করেন তারা দুজন।
এদিকে বুধবার দুপুরে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শিশুটির সন্ধান চাইতে গেলে কোন চিকিৎসক, নার্স কিংবা নিরাপত্তাকর্মী শিশুটি কখন এবং কোথায় গিয়েছে এ বিষয়ে কিছুই জানাতে পারেন নি।
রোগীটির বিষয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের পরিচালক ডাক্তার মাসুদ পারভেজ বলেন, “রোগী আসলে আমরা ভর্তি করিয়ে সেবা দেই। এর চেয়ে বেশি কিছু করার নেই।”
ছেলেটি হারিয়ে গেছে কিনা সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কোন রোগী তার নিজস্ব ওয়ার্ডে না থাকলে আমরা ২৪ ঘণ্টা পর তাকে পলাতক বলে ঘোষণা করি। এর ক্ষেত্রেও তাই হবে।”
এ বিষয়ে তিনি আর কথা বলতে আগ্রহ প্রকাশ করেননি।
পুলিশ কী বলছে
লাকসাম থানার ওসি নাজনীন সুলতানা জানান, আমরা যখন ওই শিশুটিকে পেয়েছি- তাকে একজন এএসআইকে সঙ্গে দিয়ে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠাই। সবশেষ আমি শুনেছি - সে সেখানেই আছে।
এছাড়া সংশ্লিষ্ট বা আশপাশের এলাকায় এ ধরনের অসুস্থ কোনো শিশু হারানো গেছে বলে আমাদের কাছে কেউ কোনো রিপোর্ট করেননি।
সাম্প্রতিক সময়ে কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলায় কুকুরের কামড়ে শিশুসহ অন্তত ৩০ জনের আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। সে সময় জলাতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ারও আতঙ্ক দেখা দেয় মানুষের মাঝে।
তবে অস্বাভাবিক আচরণ করা শিশুটিকে কুকুরে কামড়েছিলো কি-না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এছাড়া চিকিৎসকরা বলছেন- জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্তদের মাঝে পানি-ভীতি দেখা যায়। যা এ শিশুটির মধ্যে ছিল না। তাকে পানি খেতে দেখা গেছে।
যা বললেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও সমাজকর্মী
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের চিকিৎসক সাইদুস সাকালান বলেন, “কোন গুরুতর মানসিক রোগের প্রাথমিক বহিঃপ্রকাশ হিসেবে শিশুটি এমন আচরণ করতে পারে। অথবা ভয় থেকে তার বয়সের তুলনায় কম বয়সীর আচরণ যেমন হামাগুড়ি দেয়া কিংবা গোঙ্গানির মত শব্দ করে থাকতে পারে শিশুটি।
“সেক্ষেত্রে তাকে পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে জানা যেতে পারত সে কেন এমন আচরণ করছে “
কুমিল্লার সাংবাদিক ও সমাজকর্মী নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, “চাইলে শিশুটিকে আলাদাভাবে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বিশেষায়িত চিকিৎসা দিতে পারতো। কারণ শিশুটির রোগটি একেবারেই আলাদা মনে হচ্ছিলো এবং শিশুটির পাশে তার অভিভাবক বা স্বজন কেউই নাই।
“কিন্তু তারা খেয়াল রাখেনি বিধায় এই শিশুটিকে হাসপাতালে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সে যেহেতু অস্বাভাবিক চলাফেরা করছে- তার যে কোনো ধরনের বিপদ হতে পারে। এই বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে পারে না।”