Published : 11 Aug 2023, 09:39 AM
দেশের পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী ১১টি নৃগোষ্ঠীর ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির তথ্য সংগ্রহ ও গবেষণার কাজে রাঙামাটিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট। শুরুতে বিপুল উদ্যমে কাজকর্ম শুরু হলেও সময়ের সঙ্গে বেড়েছে সীমাবদ্ধতা।
তাতে গতি হারিয়েছে এ ইনস্টিটিউট; বর্তমানে প্রয়োজনের অর্ধেক জনবল নিয়ে অনেকটা ‘খুঁড়িয়ে’ চলছে ইনস্টিটিউটের কাজ। এমনকি পরিচালক ও সহকারী পরিচালকের চারটি পদও রয়েছে শূন্য।
লেখক আব্দুল সাত্তারকে পরিচালক করে ১৯৭৮ সালে যাত্রা করে উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, যার বর্তমান নাম ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট।
এমনভাবে ইনস্টিটিউটটি নকশা করা হয়েছে যেন, একবার ঘুরে দেখলেই পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত নৃগোষ্ঠীগুলো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
স্থানীয় প্রায় সবগুলো জনগোষ্ঠীর জীবনাচার, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নান্দনিক উপস্থাপনা রয়েছে এ জাদুঘরে। যদিও যথাযথ প্রচারের অভাবে রাঙামাটি ঘুরে যাওয়া বেশিরভাগ পর্যটক জানতেই পারেন না এর কথা।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইনস্টিটিউট যেসব কাজ করেছে, তার মধ্যে রয়েছে– স্থানীয় সংস্কৃতির জীবনধারা ও লোক সাহিত্যের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ, সংরক্ষণ, পুস্তক ও সাময়িকী প্রকাশ, প্রচার, হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতির তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ, চারু ও কারুশিল্প, পোশাক পরিচ্ছদ, অলংকার, সংগীত, যন্ত্র, মুদ্রা, অস্ত্রশস্ত্র সংরক্ষণ এবং নিজস্ব জাদুঘরে প্রদর্শন।
পাহাড়ের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে প্রায় শতাধিক বই প্রকাশ করেছে ইনস্টিটিউট। পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইংরেজি বইয়ের বাংলা অনুবাদও প্রকাশ করেছে। যদিও বই প্রকাশের সংখ্যা সম্প্রতি অনেকটাই কমে এসেছে।
১৯৮৯ সালে গিরিনির্ঝর নামে একটি প্রকাশনা নিয়মিত বের করতে শুরু করে ইনস্টিটিউট। নয়টি সংখ্যা প্রকাশের পর সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি। তবে প্রতিবছর ‘বৈ-সা-বি’ উপলক্ষে একটি প্রকাশনা নিয়মিত বের হয়। রয়েছে ১০ হাজার বই সমৃদ্ধ একটি লাইব্রেরি।
প্রকাশনার পাশাপাশি চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও তংচঙ্গ্যা ভাষায় স্বল্পকালীন এবং দীর্ঘকালীন প্রশিক্ষণ পরিচালনা করে ইনস্টিটিউট। এর মধ্যে দুই বছর মেয়াদী সার্টিফিকেট কোর্সটি গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া ক্ষুদে শিল্পীদের জন্য নাচ, গান, চারুকলাসহ বেশ কিছু নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রয়েছে।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকমা ভাষা ও বর্ণমালা শেখানো হয়। এই শিক্ষকরাই শিশুদের নিজ ভাষা ও বর্ণমালা বিষয়ক জ্ঞান দেন।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ‘রাঙামাটি পার্বত্য জেলার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বিকাশ ও সংরক্ষণ কর্মসূচি’ প্রকল্পের আওতায় এই ভাষা শিক্ষা কার্যক্রমটি চলছে।
তবে ইনস্টিটিউটের প্রায় সব কার্যক্রমই অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে। বাজেট সমস্যার পাশাপাশি প্রকট হয়ে উঠেছে জনবল সংকট।
ইনস্টিটিউটের এক কর্মকর্তা বলেন, এই প্রতিষ্ঠানের জন্য বার্ষিক বরাদ্দ একেবারেই কম। গত অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল দুই কোটি টাকা। যার বড় অংশ চলে যায় কর্মচারীদের বেতন এবং দাপ্তরিক নানা ব্যয়ে।
এছাড়া অডিটোরিয়াম ভাড়া ও যাদুঘরের টিকেট বিক্রি থেকে যে সামান্য আয় হয়, তা দিয়ে বড় কোনো প্রকল্প হাতে নেওয়া যায় না বলে জানালেন তিনি।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাদুঘরে কোনো স্থায়ী কর্মচারী নিয়োগ করা হয়নি। ২৯টি পদের মধ্যে খালি পড়ে আছে ১৬টি। পরিচালকের কাজ চলছে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক দিয়ে; খালি রয়েছে সহকারী পরিচালকের তিনটি পদ।
শুরুতে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হত এ ইনস্টিটিউট। ১৯৯৩ সালের ১ মে হস্তান্তর করা হয় রাঙামাটি জেলা পরিষদের কাছে। এর উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেয়নি জেলা পরিষদ।
অবশ্য প্রায় ৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, শিল্পীদের আবাসিক ভবন, একটি মাচা ঘর, সীমানা দেয়াল নির্মাণ ও সৌন্দর্য বর্ধনের কিছু কাজ করা হয়েছে।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট নিয়ে এ অঞ্চলের মানুষের যে প্রত্যাশা ছিল, তা পূরণ হয়নি বলে মনে করেন রাঙামাটির সংস্কৃতি কর্মী সুপ্রিয় চাকমা শুভ।
তিনি বলেন, “গত কয়েকবছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানটি অনেকটাই অকার্যকর। কিছু কাজ হচ্ছে বটে, কিন্তু নিয়মিত কোনো প্রকাশনা, কার্যক্রম বা উদ্যোগ নেই।
“এই রকম একটি প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য যে যোগ্যতার লোকবল প্রয়োজন ছিল তা এখানে নেই। অনেকটা দায়সারাভাবে কাজ চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ফলে এই প্রতিষ্ঠান এখন আর পাহাড়ের মানুষের কোনো কাজেই আসছে না।”
পার্বত্য চট্টগ্রামের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির ‘প্রকৃত বাতিঘর’ হতে হলে ইনস্টিটিউটকে ব্যাপক ও পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিতে হবে বলে মত দেন তিনি।
এসব প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করলেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) রুনেল চাকমা।
তবে এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ‘অবশ্যই এ অঞ্চলের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষা হচ্ছে’ বলে মন্তব্য করলেন তিনি।
রুনেল চাকমা বলেন, “এখানে যে-সব গবেষণা, প্রকাশনা বা উন্নয়ন কাজ হচ্ছে, তা ব্যক্তি পর্যায়ে কখনো সম্ভব নয়। এই প্রতিষ্ঠান এই অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলো রক্ষায় যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, তা অন্য কেউ করতে পারেনি।”
পর্যাপ্ত বাজেটের অভাবে অনেক পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, “জেলা পরিষদ যদি আমাদের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে কিছু করে তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংস্কৃতি বিকাশে আমরা আরও বেশি ভূমিকা রাখতে পারব।”
শূন্য ১৬টি পদে দ্রুত নিয়োগ দেওয়া দরকার বলে মনে করেন তিনি। এছাড়া কর্মকর্তা কর্মচারীদের অবসরের পর পেনশন সুবিধা না থাকাও কাজের শ্লথগতির পেছনে দায়ী বলেও মত তার।
তিনি বলেন, “অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কাজ করছি আমরা। তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে একমাত্র রাঙ্গামাটিতেই আমরা নয়টি উপজেলায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা চালু রেখেছি।”
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের দায়িত্বে রয়েছেন রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য রেমলিয়না পাংখোয়া।
তিনি বলেন, “আমাদের সামগ্রিক বাজেট অনেক কম। সেই কারণে আমরা চাইলে অনেক কিছু করতে পারি না। তবে আমাদের পরিষদ দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ইনস্টিটিউটে নিয়মিত কিছু কর্মসূচি পালন করে আসছি।
“এছাড়া কিছু পরিকল্পনা তৈরি করে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোয় পাঠানো হয়েছে। আশা করছি, কাজের অগ্রগতি আরও বাড়বে এবং সামনে দিনগুলোয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট পাহাড়ের সংস্কৃতি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।”