কুমিল্লার এই জাদুঘরে প্রদর্শন করা হয়েছে পুরনো বই, কলম, দোয়াত, ট্রাংক, কুপি, হারিকেন, চিমনি, ঘড়িসহ বিভিন্ন উপকরণ।
Published : 05 Oct 2022, 09:51 AM
কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার রামধনপুর গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গড়ে তোলা হয়েছে ব্যতিক্রমী ‘শিক্ষা জাদুঘর’। বিদ্যালয়ের অর্ধশত বছর পুরোনো পরিত্যক্ত মাটির ঘরকে সংস্কার করে নান্দনিক আল্পনায় রাঙিয়ে বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ নিয়ে সাজানো হয়েছে জাদুঘরটি।
রামধনপুর গ্রামটি উপজেলার গলিয়ারা ইউনিয়নের বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শুভাশিস ঘোষ কয়েক মাস আগে বিদ্যালয়টি পরিদর্শনে গেলে সেই স্কুলে থাকা পরিত্যক্ত মাটির ঘরটি তার নজর কাড়ে।
পুরনো শিক্ষা ব্যবস্থার নিদর্শন হিসেবে সেটি রক্ষা করার চিন্তা করেন তিনি। তার উদ্যোগ আর ব্যতিক্রমী চিন্তায় মাটির স্কুল ঘরটিতে নির্মাণ করা হয়েছে `শিক্ষা জাদুঘর’।
জানা যায়, ১৯৭১ সালে এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে সচেতন কিছু মানুষ প্রত্যন্ত এ গ্রামটিতে বাঁশের বেড়া ও ছনের ছাউনি দেওয়া একটি ঘরে প্রতিষ্ঠা করেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। কালের পরিক্রমায় সেই বিদ্যালয়টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে।
১৯৭৩ সালে ছন ও বাঁশের বেড়ার ঘরটি ভেঙে নির্মাণ করা হয় মাটির স্কুল ঘর। পরে ১৯৯৪ সালে পাকা ভবন নির্মাণের আগ পর্যন্ত ওই মাটির স্কুল ঘরেই চলেছে শিক্ষার্থীদের পাঠদান। মাটির সেই ঘরে যারা জ্ঞান অর্জন করেছিলেন, তাদের অনেকেই আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত। অনেকেরই নাতি-নাতনি এখন বিদ্যালয়টিতে পড়াশোনা করছে।
বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে পাকা দালানের সংখ্যা দুটি। কিন্তু পরিত্যক্ত হয়েও সেই মাটির স্কুল ঘরটি দাঁড়িয়ে ছিলো কালের সাক্ষী হয়ে।
সম্প্রতি বিদ্যালয়ের আঙিনায় সেই মাটির ঘরে নির্মিত শিক্ষা জাদুঘরটির উদ্বোধন করেছেন কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান। এটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘রামধনপুর শিক্ষা জাদুঘর’।
সেই জাদুঘরে উপজেলার বেশ কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পুরোনো দিনের শিক্ষার নানা উপকরণ দিয়েছেন। এর মাধ্যমে যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে মাটির ঘরটি।
উদ্বোধনের পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ স্থানীয় এলাকাবাসী দাবি করেন, কুমিল্লা জেলাতেই প্রথমবারের মতো নির্মিত হলো দেশের প্রথম `শিক্ষা জাদুঘর’। এর আগে এমন কোনো `শিক্ষা জাদুঘর’ দেশের অন্য কোথাও স্থাপনের নজির দেখতে পাননি তারা।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, “মাটির ঘর আমাদের ঐতিহ্যের প্রতীক। বর্তমানে মাটির ঘর খুব একটা দেখা যায় না। কুমিল্লার ওই পল্লী গ্রামে মাটির ঘর সংরক্ষণ করে `শিক্ষা জাদুঘর’ স্থাপন করা নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ।”
“এই জাদুঘর নতুন প্রজন্মকে আগের শিক্ষা উপকরণ সম্পর্কে জানতে সহযোগিতা করবে। সাথে বড়রা তাদের ফেলে আসা স্মৃতিতে ফিরে যেতে পারবেন। বিশেষ করে তরুণরা বুঝতে পারবে আগে মানুষ কতোটা কষ্ট করে পড়াশোনা করেছেন।”
সরেজমিনে রামধনপুরে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের সামনে ডানা মেলে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বটবৃক্ষ। বিদ্যালয়ের দুইটি পাকা ভবনের সাথে জরাজীর্ণ মাটির ভবনের গায়ে যেন নতুন করে যৌবনের ছোঁয়া লেগেছে। পরিত্যক্ত ঘরটিতে লেগেছে মাটির নতুন প্রলেপ। আঁকা হয়েছে নানান রঙের আল্পনা।
ঘরটির ভেতরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে কয়েক দশক আগে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা উপকরণ। সেখানে প্রদর্শন করা হয়েছে পুরোনো বই, কলম, দোয়াত, ট্রাংক, কুপি, হারিকেন, চিমনি, ঘড়ি, আলমিরা, মগ, পিতলের প্লাস, পাখা, চেরাগদানি, হ্যাজাক লাইটসহ বিভিন্ন উপকরণ।
স্থানীয় এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, গত ১৪ সেপ্টেম্বর বিকালে উদ্বোধনের পর থেকেই জাদুঘরটি দেখতে বিভিন্ন বয়সের মানুষ ভিড় করছেন। এমন উদ্যোগ না নিলে হয়তো ঘরটির অস্তিত্ব যেকোনো সময় হারিয়ে যেতো। এখন আশা করি অর্ধশত বছরের পুরোনো মাটির ঘরটিও বছরের পর বছর টিকে থাকবে।
রামধনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি আবদুল হান্নান বলেন, “মাটির এই স্কুল ঘরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আমিও একজন। এখানে অনেক আবেগ ও ভালোবাসার স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে।
“মাটির ঘরটিতে শিক্ষা জাদুঘর নির্মিত হওয়ায় বিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের মতো এলাকাবাসীও আনন্দিত। প্রত্যন্ত অঞ্চলের এমন স্কুলে শিক্ষা জাদুঘর নতুন প্রজন্মকে পড়াশোনায় আরও অনুপ্রাণিত করবে।”
এমন উদ্যোগের কারণ জানতে চাইলে কুমিল্লা সদর দক্ষিণের ইউএনও শুভাশিস ঘোষ বলেন, “জেলা প্রশাসকের নির্দেশনায় উপজেলার পিছিয়ে পড়া স্কুল খুঁজতে গিয়ে কয়েক মাস আগে রামধনপুরে যাওয়া হয়। বর্তমানে দেশে এই রকম কয়টি মাটির প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন অক্ষত আছে, সেটা জানি না। আমার মনে হয়েছে একটু উদ্যোগ নিলেই এখানে ভালো কিছু হতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “মূলত সেই চিন্তা থেকেই বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র, শিক্ষক ও স্থানীয় ইউপি সদস্যের সমন্বয়ে পাঁচ সদস্যের সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়। তাদের সবার সহযোগিতায় অর্ধশত বছরের পুরোনো স্কুল ঘরটি সংস্কার করা হয়।
“আমার জানা মতে, দেশে এমন ‘শিক্ষা জাদুঘর’ আর নেই। এজন্য আমার মতো সকলেই বলছেন- এটি দেশের প্রথম শিক্ষা জাদুঘর। এই জাদুঘর আমাদের শেকড়ের গল্প শোনাবে নতুন প্রজন্মকে।
“আর জাদুঘরটি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। আমি আশা করছি স্থানীয় এলাকাবাসী জাদুঘরটি রক্ষায় সামনেও ভূমিকা রাখবেন,” যোগ করেন ইউএনও।