উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও বন্ধ নেই পাহাড়-টিলা কাটা।
Published : 19 Jun 2024, 09:31 AM
আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও নির্বিচারে মাটি লুটে নেওয়ায় অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী লালমাই পাহাড়।
লালমাটির এই পাহাড়ে সবুজে ঘেরা দৃশ্য পর্যটকসহ সবার কাছেই দারুণ উপভোগ্য। সেই পাহাড়ের টিলায় কখনও দিনে আবার এখনও রাতের আঁধারে মাটি কাটছে সংঘবদ্ধ চক্র।
এতে পাহাড়-টিলা প্রতিনিয়ত রূপ নিচ্ছে সমতল ভূমিতে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বন্যপ্রাণী ও পাখির আবাসস্থল। নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য।
কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার অংশজুড়ে লালমাই পাহাড়ের অবস্থান। এ ছাড়া কুমিল্লার আদর্শ সদর ও বরুড়া উপজেলায় এর সামান্য অংশ রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশবিদরা বলছেন, মাটি কাটার এ ধারা অব্যাহত থাকলে এক দশকেই লালমাই পাহাড় তার অস্তিত্ব পুরোপুরি হারাবে।
যদিও লালমাই পাহাড় ও টিলা কাটা বন্ধে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে একাধিক চক্র একের পর এক টিলা ও পাহাড় কাটছে।
বিশেষ করে পাহাড়ের কুমিল্লা সদর দক্ষিণের বড় ধর্মপুর, ধর্মপুর, রতনপুর, বিজয়পুর, সালমানপুর, জামমুড়া, রাজারখোলাসহ বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় কাটা হচ্ছে। মাঝে-মধ্যে প্রশাসন অভিযান চালালেও ফের মাটি খেকোরা পাহাড় কেটে নিচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ের মাটি খেকোদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপা কুমিল্লার সভাপতি মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “পরিবেশ ও প্রকৃতির ভারসাম্যের জন্য পাহাড় রক্ষার বিকল্প নেই। কিন্তু পাহাড় রক্ষায় কুমিল্লায় তেমন কোনো উদ্যোগ নজরে পড়ছে না।
লালমাই পাহাড়ের মাটি কাটা বন্ধে বাপা প্রশাসনের কাছে বহুবার লিখিত অভিযোগ করেছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। রাজনৈতিক নেতাদের প্রশ্রয়ে মাটি খেকো চক্র এই কাজ করছে। কিন্তু কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।”
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পাহাড়ের বড় ধর্মপুর মধ্যপাড়া এলাকায় কোম্পানি বাড়ির পশ্চিম পাশে অবাধে কাটা হয়েছে পাহাড় ও টিলার মাটি। ওই এলাকায় বেশিরভাগই পরিণত হয়েছে সমতল ভূমিতে। এ নিয়ে স্থানীয়রা অভিযোগ করলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বড় ধর্মপুরে প্রতিষ্ঠিত জাপানি স্কুলের পাশে বনবিভাগের একটি পাহাড়ের একাংশ কেটে ফেলা হয়েছে। রাতের আঁধারে একটি চক্র পাহাড়টি কেটে নেয় বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। পাশের শ্রীবিদ্যা এলাকায়ও অবাধে কাটা হয়েছে টিলা।
সালমানপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ম্যাজিক প্যারাডাইজ পার্কের বিপরীতে পাহাড় কেটে সমতল করা হচ্ছে। এই পার্কের পেছনে আরেকটি স্থানে দেয়াল তুলে ভিতরে পাহাড় কাটা হচ্ছে।
রাজারখোলা ও জামমুড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সড়ক থেকে একটু ভেতরে বাড়ি ও গাছপালার আড়ালে পাহাড় কাটা হয়েছে। বেশিরভাগ পাহাড় রাতের আঁধারে কাটা হয়। মাটিকাটা চক্রের সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতারা জড়িত থাকায় প্রশাসন ব্যবস্থা নেয় না বলে স্থানীয়রা জানান।
লালমাই পাহাড়ের কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার বড় ধর্মপুরের বেশ কয়েকজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কয়েকদিন পর পর টিনের বেড়া দিয়ে দিনে-রাতে উঁচু উঁচু এসব পাহাড় ও টিলা কেটে নিয়ে গেছে মাটি খেকোরা। কোথাও কোথাও টিলা কেটে পুকুর বানিয়ে মাছ চাষও করা হচ্ছে।
পাশের সালমানপুর ও আশপাশের এলাকায় সম্প্রতি বিনোদন পার্কসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। তাদের অধিকাংশ পাহাড়ের ক্ষতি করছে। পাহাড়ে প্রতিষ্ঠান নির্মাণের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।
সম্প্রতি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশে ম্যাজিক প্যারাডাইস পার্কের গা ঘেঁষে একটি টিলা কেটে মাটি বিক্রি করার ঘটনা ঘটেছে।
আট বছর আগে লাকসামের ইছাপুরা গ্রামের নাসির উদ্দিন ও সাইফুদ্দিন নামে দুই ভাই এবং কুমিল্লা নগরীর নোয়াগাঁও এলাকার মো. ইউনুস মিয়া ওই টিলা কেনেন। তারা কিছুদিন আগে খবর পান, তাদের টিলা থেকে মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে। তবে কারা টিলা কেটে মাটি লুটে নিয়েছে সেটি তারা জানেন না।
এ প্রসঙ্গে নাসির উদ্দিন বলেন, “গত ফেব্রুয়ারি মাসে হঠাৎ জানতে পারি, আমাদের টিলা কাটা হচ্ছে। কিন্তু কে বা কারা কাটছে তা জানতে পারিনি। তাই আইনি পদক্ষেপও নিতে পারিনি। পরে বিষয়টি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের জানিয়েছি।”
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) লালমাই পাহাড় রক্ষায় জনস্বার্থে একটি রিট করে হাই কোর্টে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে লালমাই পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হাই কোর্ট নির্দেশ দেয়।
এর আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেইন মহাসড়ক ও কুমিল্লা-নোয়াখালী চার লেইন মহাসড়ক করতে লালমাই পাহাড় কেটে মাটি নেওয়া হয়।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় নতুন ক্যাম্পাসের জন্য প্রায় ২০০ একর জমি অধিগ্রহণ করে। এর মধ্যে ১৩১ একর পাহাড় ও টিলাশ্রেণির।
কুমিল্লার ইতিহাসবিদ ও গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, “লালমাই পাহাড়ের দৈর্ঘ্য ৮ ও প্রস্থ ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। এটি একটি বিচ্ছিন্ন পর্বতশ্রেণি। এই পাহাড়ের সর্বোচ্চ উচ্চতা ৪৬ মিটার; আয়তন ৩৩ দশমিক ৬৫ বর্গকিলোমিটার। কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলায় এই পাহাড়ের অবস্থান। আনুমানিক ২৫ লাখ বছর আগে ‘প্লাইস্টোসিন যুগে’ এই পাহাড় গঠিত হয়।”
“যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির অভাবে ভূমিদস্যুরা এই পাহাড়ের মাটি কেটে বিক্রি করছে। তাই লালমাই পাহাড় রক্ষায় প্রশাসনের একটি পৃথক উইংয়ের দরকার। তবে এ নিয়ে প্রশাসনের তেমন উদ্যোগ না থাকায় সাধারণ মানুষ হতাশ,” বলেন আহসানুল কবীর।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কুমিল্লার উপ-পরিচালক আইউব মাহমুদ বলেন, “অবাধে পাহাড় কাটায় ফল-ফসল আবাদে বিঘ্ন ঘটে। মোট কথা, পরিবেশের ভারসাম্যের জন্য পাহাড় রক্ষা করতে হবে। এ নিয়ে সবাইকে আন্তরিক হতে হবে।”
সামাজিক বনবিভাগ, কুমিল্লার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জি এম মোহাম্মদ কবির বলেন, “পাহাড়ের বড় ধর্মপুর এলাকার জাপানি স্কুলের পাশের কিছু অংশ একটি পক্ষ কেটে ফেলেছে। সেখানে আমরা সীমান্ত নির্ধারণ করে তা বন্ধ করেছি। এ ছাড়া অন্যত্র যেন পাহাড় না কাটতে পারে সেদিকেও নজর রাখছি। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যই আমাদের পাহাড় রক্ষা করতে হবে।”
কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার ইউএনও রুবাইয়া খানম বলেন, “আমরা বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে মাটি কাটা চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। যখনই খবর পাচ্ছি, তখনই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। মাটি কাটার কোনো তথ্য পেলে আবারও পরিদর্শন করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক খন্দকার মু. মুশফিকুর রহমান বলেন, “লালমাই পাহাড়ের মাটি কাটা বন্ধে প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে। কোনোভাবেই পাহাড়-টিলা কেটে সাবাড় করা যাবে না। সেখানে প্রায়ই অভিযান চালানো হচ্ছে। কোথাও পাহাড় কাটা হলে যেকেউ আমাদের বিষয়টি জানালে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেব। এক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।”