ভোট সামনে রেখে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা দুই পক্ষে ভাগ হয়ে গেছেন।
Published : 01 Jan 2024, 09:11 PM
সিরাজগঞ্জ-৫ আসনের ভোট নিজের পক্ষে টানতে নৌকা এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া আওয়ামী লীগ নেতার কর্মী-সমর্থকরা সভা-সমাবেশ থেকে শুরু করে প্রচারেও একে অপরের বিরুদ্ধে তুলছেন নানা অভিযোগ।
ভোট সামনে রেখে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা দুই পক্ষে ভাগ হয়ে গেছেন। নানা সমালোচনা থাকলেও ভোটে জিততে ‘আশাবাদী’ দুজনই।
বেলকুচি-চৌহালী উপজেলা নিয়ে গঠিত সিরাজগঞ্জ-৫ আসনে দ্বিতীয়বার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন শিল্পপতি আব্দুল মমিন মণ্ডল। তিনি বেলকুচি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। আর দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে সাবেক মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফ বিশ্বাস জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন।
আব্দুল লতিফ বিশ্বাস ১৯৯৬ সালে প্রথমবার সিরাজগঞ্জ-৫ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৮ সালে দ্বিতীয়বার সংসদ সদস্য হয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তিনি মন্ত্রী থাকাকালে মণ্ডল গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুল মমিন মণ্ডলের বাবা আব্দুল মজিদ মণ্ডল সিরাজগঞ্জ জেলা পরিষদের প্রশাসক ছিলেন।
২০১৪ সালে মজিদ মণ্ডল নৌকা প্রতীকে সিরাজগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। লতিফ বিশ্বাস তখন সিরাজগঞ্জ জেলা পরিষদের প্রশাসকের দায়িত্ব পান এবং ২০১৭ সালে তিনি সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হন। তিনি দুইবার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানও ছিলেন।
২০১৮ সালের নির্বাচনে লতিফ আর দলীয় মনোনয়ন পাননি। সেবার আব্দুল মমিন মণ্ডল এ আসনে নৌকা প্রতীকে এমপি নির্বাচিত হন। আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও লতিফ বিশ্বাস এ আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হয়েছেন।
সুষ্ঠু ভোট হলে সিরাজগঞ্জ-৫ আসনে লতিফ বিশ্বাস আর নৌকার প্রার্থীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলেই স্থানীয়দের ধারণো। তবে নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে তৃণমূলের সঙ্গে ‘দূরত্ব’ এবং এলাকায় আশানুরূপ ‘উন্নয়ন না করতে পারার’ অভিযোগও করেছেন তারা।
বেলকুচি উপজেলার ধুকুরিয়াবেড়া ইউনিয়নের সগুনা মিলন মার্কেটের সামনে বুধবার দুপুরে এক পথসভায় নৌকার প্রার্থী মমিন মণ্ডলের বাবাকে ‘মাদক ব্যবসায়ী’ বলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশানুর বিশ্বাস।
তিনি বলেন, “মমিনের বাবা অবৈধ ব্যবসা করে শিল্পপতি হয়েছেন। অবৈধ ব্যবসা করতে লাল পাসপোর্ট দরকার, তাই মমিন এমপি হতে চায়। আর লতিফ বিশ্বাস জনগণের নেতা। মমিন তো নেতা নয়; শিল্পপতি। নির্বাচনে জনগণ লতিফকেই মূল্যায়ন করবেন।”
ঈগল প্রতীক নিয়ে ভোটের লড়াইয়ে থাকা স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল লতিফ বিশ্বাসও ছিলেন ওই সভায়। নৌকার প্রার্থী এক দশকেও এ অঞ্চলে উন্নয়ন করতে ‘ব্যর্থ’ হয়েছেন বলে সেখানে দাবি করেন তিনি।
লতিফ বিশ্বাস বলেন, “কোনো এক অদৃশ্য কারণে দলের মনোনয়ন পাইনি। প্রধানমন্ত্রী সুযোগ করে দিয়েছেন; তাই জনগণের চাপে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছি। গত ১০ বছরে নৌকার মাঝি এ অঞ্চলে উন্নয়ন করতে পারেনি। তাই তৃণমূল আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মী আমার সঙ্গে থাকায় ঈগল পাখির বিজয় নিশ্চিত।”
একইদিন বিকালে এনায়েতপুর থানার গোপরেখী আতার মাঠে নৌকার নির্বাচনি সভায় বেলকুচি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান রতন বলেন, “লতিফ বিশ্বাস ১৯৯৬ সালে প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর ২০০৮ সালে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রী হয়েছিলেন। ওই সময় তিনি সংগঠনকে কুক্ষিগত করে রাখায় পরের তিনটি নির্বাচনে দল তাকে মনোনয়ন না দিয়ে তালাক দিয়েছে।”
একই সভায় নৌকার প্রার্থী মমিন মণ্ডল বলেন, “লতিফ নির্বাচিত হয়ে পরিবারতন্ত্র কায়েম করেছিলেন। তার পরিবারের সদস্যরা মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতন করেছে। তাই দল তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আসন্ন নির্বাচনে জনগণ নৌকায় ভোট দিয়ে আবার আমাকেই নির্বাচিত করবেন।”
অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক বেলকুচি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী আকন্দ বলছেন, “প্রায় দুই বছর আগে উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে আংশিক কমিটি ঘোষণা হয়। সভাপতি মমিন মণ্ডলের ‘অসহযোগিতার’ কারণে আজও পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। যে কারণে দলের অধিকাংশ সাবেক নেতা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে।”
দলের অন্যান্য অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনেও একই রকম বিভক্তি রয়েছে। বেলকুচি পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মির্জা শরিফ জানান, কমিটির ৬৯ জন নেতার মধ্যে ৫৬ জন ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন। নৌকার মাঝি ‘ভালো না’ হওয়ায় ‘ঈগল পাখির’ পক্ষ নিয়েছেন তারা।
লতিফের পক্ষে সুর তুলে বেলকুচি উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি শ্রী গোপাল চন্দ্র প্রামাণিক বলেন, “তিনি এ অঞ্চলে আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করেছেন। আর মমিন ‘হাইব্রিড’ ও ‘নব্য আওয়ামী লীগ’কে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাই সংগঠনের ৭৫ জনের মধ্যে ৬৫ জন নেতা এক হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নেমেছি। দল বাঁচাতে হলে লতিফকে জেতাতে হবে।”
দলকে সুসংগঠিত করতে এবং সিরাজগঞ্জ-৫ আসনের উন্নয়নের স্বার্থে লতিফ বিশ্বাসের পক্ষে কাজ করার সিন্ধান্ত নিয়েছেন বলে বেলকুচি উপজেলা পরিষদের সদ্যবিদায়ী চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম সাজেদুলের ভাষ্য।
তার দাবি, নৌকার সমর্থকদের হুমকির কারণে এলাকার হিন্দু ভোটাররা ‘আতংকে’ মধ্যে রয়েছেন।
এনায়েতপুর থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রাশেদুল ইসলাম সিরাজের কাছে লতিফ বিশ্বাস ‘রাজনৈতিক ওস্তাদ’। কিন্তু এখন তিনি মমিনের পক্ষে।
সিরাজ বলেন, “যে নৌকার কারণে তার (লতিফ) রাজনৈতিক উত্থান, মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে আজ তিনিই সেই নৌকার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।”
এনায়েতপুর থানা আওয়ামী লীগের সহসাধারণ সম্পাদক আলহাজ আলী একই সুরে বলেন, “আমরা লতিফের কর্মী। তার পাশে থেকেই রাজনীতি করেছি। কিন্তু তিনি আমাদের নেতা না বানিয়ে পরিবারতন্ত্র কায়েম করেছেন। এজন্য দল তাকে আর মনোনয়ন দেয়নি। তাই আমরাও তাকে আর চাই না।”
দলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি ভোটারদের সমর্থনও যে লতিফের পক্ষে কিছুটা ‘ভারী’ তা বোঝা গেল কয়েকজনের কথায়।
বেলকুচি উপজেলার ধুকুরিয়া বেড়া ইউনিয়নের সগুনা বাজারের চায়ের দোকানদার প্রদীপ কুমার সেন বলেন, “মমিন সাহেব এই বাজারে মিটিং করতে এসেছিলেন। লোকজন না হওয়ায় মন খারাপ করে চলে গেছেন। আমাদের এখানে আগে নৌকার ভোট বেশি ছিল। এবার সবাই প্রবীণ নেতা লতিফ বিশ্বাসের ঈগল পাখি মার্কায় ভোট দেবে।”
গত ১০ বছরে এলাকায় কোনো ‘উন্নয়ন হয়নি’ অভিযোগ করে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন একই ইউনিয়নের ঝোকনালা গ্রামের কৃষক নূর ইসলাম ও সাবের আলী।
সাবের আলী বলেন, “বর্তমান এমপি সাহেব এলাকায় আসেনি। তিনি বেলকুচিতে গামের্ন্টস কারখানা ও স্টেডিয়াম করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু করেনি। নৌকার মাঝি ভালো হয়নি, তাই জনগণ তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।”
সিরাজগঞ্জ-৫ আসনে নৌকা ও ঈগল পাখির প্রার্থী ছাড়াও নোঙ্গর প্রতীকে বিএনএম মনোনীত আব্দুল হাকিম, লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির ফজলুল হক, কাঁচি প্রতীকে (স্বতন্ত্র প্রার্থী) বিএনপির বহিস্কৃত নেতা মেজর (অব.) আব্দুল্লাহ আল মামুন ও গামছা প্রতীকে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের ব্যারিস্টার নাজমুল হক অংশ নিচ্ছেন।