ওমানে গিয়ে ভাগ্যবদল হয়নি শামীমের, দিন বদলেছে তরমুজে

ফলটি দেখতে বাঙ্গির মতো হলেও ভেতরটা তরমুজের মতো টকটকে লাল এবং মিষ্টি বেশি। প্রতিটির ওজন প্রায় আড়াই থেকে তিন কেজি।

হাসান আলীকুষ্টিয়া প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 June 2023, 05:17 AM
Updated : 14 June 2023, 05:17 AM

জীবিকার তাগিদে বিদেশে গেলেও ভাগ্য বিড়ম্বনায় টিকতে না পেরে দেশে ফিরে এসেছিলেন শামীম আহম্মেদ। পরে প্রশিক্ষণ নিয়ে মাচায় গ্রীষ্মকালীন রঙ্গিন তরমুজ চাষ করে নিজের ভাগ্য ফিরিয়েছেন কুষ্টিয়া কুমারখালীর জঙ্গলী গ্রামের এই তরুণ।

শামীম আহম্মেদ জানান, মাত্র দুই মাসেই তার জমিতে উৎপাদিত তরমুজ বিক্রি করে দুই লাখ টাকা আয়ের আশা করছেন তিনি।

তিনি জানান, জমিতে ইয়েলো গোল্ড (হলুদ) ও স্মার্ট বয় (কালো) জাতের তরমুজের চাষ করেছেন। খুবই সুন্দর সুন্দর হলুদ, কালো তরমুজ। দেখতে বাঙ্গির মতো হলেও ভেতরটা তরমুজের মতো টকটকে লাল এবং মিষ্টি বেশি। প্রতিটির ওজন প্রায় আড়াই থেকে তিন কেজি।

তিনি বলেন, “স্থানীয় বাজারেই আমি চাহিদামত তরমুজ দিতে পারছি না। ৭০ টাকা কেজি হিসাবে ক্রেতারা মাঠ থেকেই তুলে নিয়ে যাচ্ছে।”

সরজমিনে জঙ্গলী গ্রামে শামীমের জমিতে দেখা যায়, ছোট ছোট মাচা। বাঁশের কঞ্চির উপরে নাইলনের জাল দিয়ে মাচানের ছাউনি দেওয়া। মাচাগুলো ভরে আছে সবুজ পাতায়। মাচার নীচে ঝুলছে হলুদ ও কালো রংয়ের বাহারি তরমুজ। সেগুলো যাতে পড়ে না যায় এজন্য জালি ব্যাগ দিয়ে বেঁধে দেওয়া।

শামীম বলেন, “আমি ওমানে গিয়েছিলাম। দেশের বাইরের জীবনটা অনেক কষ্টের। নানা ঝক্কি-ঝামেলায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়। তাই বাড়িতে ফিরে এসে ভাবলাম কৃষিকাজ করে উন্নতি করা যায় কি-না।”

“এরপর উপজেলা কৃষি অফিস থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০ শতক জমিতে উচ্চমূল্যের এই হলুদ তরমুজ চাষ করেছি। মাত্র ১৩ হাজার টাকা খরচ করেছি। বীজ রোপণের পরে মাত্র ৬৫-৭০ দিনের মাথায় আমি তরমুজ পেয়েছি।

তিনি আরও বলেন, “এর মধ্যে ২০ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করেছি। এখনও গাছে ১২০০-১৫০০ মতো তরমুজ রয়েছে। আশা করছি, দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার মতো তরমুজ বিক্রি করতে পারবো। মাত্র দুই মাসে এমন অধিক লাভজনক ফসল দেখে সবাই অবাক হয়ে দেখছে।”

তার এই সাফল্যে স্থানীয় কৃষি কার্যালয়ের সহযোগিতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, বিদেশ থেকে ফিরে তিনি উপজেলা কৃষি কার্যালয়ে গেলে তারা উচ্চ মূল্যের ফসল চাষের কথা জানায়। পরে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন তাকে গ্রীষ্মকালীন সময়ে তরমুজ চাষ বেশি লাভজনক বলে জানান।

এরপর তিনি ‘যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্প’ থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রকল্প কর্মকর্তারা ২০ শতাংশ জমিতে প্রদর্শনী প্লট হিসাবে তরমুজ চাষের সকল উপকরণ- সার, বীজ, কীটনাশকসহ আনুষঙ্গিক সহযোগিতা করেন।

তরমুজ চাষে সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন জানিয়ে এই তরুণ কৃষক বলেন, “এজন্য আমি হলুদ ফাঁদ ব্যবহার করেছি। সেই সঙ্গে আমি মালচিং পদ্ধতি ব্যবহার করায় সেচ ও শ্রমিক খরচ অনেক কম হয়েছে।”

বাহারি এ তরমুজ দেখতে তার জমিতে প্রতিনিয়ত ভিড় করেন কৃষকরা। সেই সঙ্গে খুবই কম সময়ে এই ফসলে অধিক লাভ হওয়ায় এলাকায় চাষিদের মধ্যেও বেশ আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। আগ্রহীদের পরামর্শ দিচ্ছেন বলেও জানান শামীম।

স্থানীয় কৃষকদের মতে, শামীম এলাকার কৃষকদের কাছে এক অনুকরণীয় মডেল।

একই এলাকার কৃষক আলি আক্কাস বলেন, “এলাকার এই তরমুজের চাষ কখনও হয়নি। এটা খুবই অল্প সময়ের লাভজনক ফসল।”

কৃষক আলমগীর হোসেন বলেন, “আসলে এই সময় তরমুজের সময় না বলে সবাই হাস্যকর হিসেবে দেখত। কিন্তু সে দুই মাসে দুই লাখ টাকা লাভ দেখাচ্ছে। আর এটা বিষমুক্ত হওয়ায় খুবই ভালো খাওয়ার জন্য।

“গ্রামের কৃষকরা এই তরমুজ চাষ দেখে খুশি এবং আগামীতে আরও চাষ হবে। আমরা আশা করছি এ জাতীয় তরমুজ অধিক পরিমাণ চাষ হলে দেশের বাইরেও রপ্তানি করা সম্ভব হবে।”

শামীমের বাবা এলাহী মণ্ডল বলেন, “আমি তো প্রথমে মনে করেছিলাম যে পাগলের কাজ। কিন্তু এখন দেখছি কম সময়ে এ তরমুজ ধরেও বেশি আর দামও ভালো। আগামীতে আরো বেশি করে লাগাব বলে ভাবছি।”

আরেক চাষি শরীফ আলী জানান, “সরকার যদি এভাবে প্রশিক্ষণ আরও দেয় তাহলে কৃষকরা অনেক লাভবান হবে। আমরা মাচায় তরমুজ চাষ জানতাম না। এখন চোখের সামনে দেখছি। আগামীকে বড় পরিসরে এ আবাদ করব।”

যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক রমেশ চন্দ্র ঘোষ জানান, “কৃষিকে লাভজনক ও বাণিজ্যিক করার লক্ষ্যে প্রকল্পের মাধ্যমে কম জমিতে কম সময়ে আমরা উচ্চ মূল্যের ফসল চাষে প্রশিক্ষণ, মাঠ দিবস ও প্রদর্শনীর মাধ্যমে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি।”

কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হায়াত মাহমুদ বলেন, “গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষ কম সময়ে অধিক লাভজনক। তরমুজের বাজারমূল্য ভালো হওয়ায় এবং চাষাবাদ লাভজনক হওয়ায় এটি একটি সম্ভাবনাময় ফসল।

“আমরা কৃষকদের উচ্চমূল্যের ফসল চাষে উদ্বুদ্ধ করছি, সার্বক্ষণিক সেবা দিচ্ছি। অনেক বেকার ও শিক্ষিত যুবকরা চাষে যুক্ত হয়ে বেশ লাভবান হচ্ছেন।”