কুষ্টিয়ায় বাউলদের উপর হামলা: প্রতিবাদ, বিচার দাবি

গত ৫ নভেম্বর রাত দৌলতপুরের লাউবাড়িয়ায় এক ভক্তের বাড়িতে সমবেত সাধুদের ওপর এই হামলা হয়।

কুষ্টিয়া প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Nov 2022, 03:49 PM
Updated : 15 Nov 2022, 03:49 PM

কুষ্টিয়ায় বাউলদের উপর হামলায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী।

ঘটনায় জড়িতদের বিচার দাবিতে মঙ্গলবার দৌলতপুর উপজেলা চত্বর এবং এর আগে শনিবার কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায় লালন শাহর মাজার চত্বরে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে।

গত ৫ নভেম্বর রাত সাড়ে ৯টার দিকে দৌলতপুর উপজেলার লাউবাড়িয়ায় এক ভক্তের বাড়িতে সমবেত হয়েছিলেন সাধুরা। সেখানে অতর্কিত হামলা চালিয়ে বাউল ও ভক্তদের রক্তাক্ত জখম করে স্থানীয় একদল লোক।

এ ঘটনায় স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি একরাম হোসেনসহ ১৯ জনের নামোল্লেখসহ অজ্ঞাত পরিচয় আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে দৌলতপুর থানায় মামলা হয়েছে।

আহতরা জানান, আহত ছয় জন সাধুসহ মোট সাত জনকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ বাউল ফজল ফকিরও (৯০) রয়েছেন।

এলাকাবাসী ও বাউলরা জানান, উপজেলার লাউবাড়িয়া গ্রামে পলান ফকিরের বাড়িতে বার্ষিক সাধুসঙ্গ চলছিল। জেলা ও জেলার বাইরের বাউলভক্ত সাধুরা সমবেত হয়েছিলেন সেখানে। সন্ধ্যায় তারা নিজস্ব ঘরানায় সাধুসঙ্গের নিয়ম অনুযায়ী আলাপচারিতায় বসেছিলেন; কেউ কেউ তখন সন্ধ্যার খাবার খাচ্ছিলেন।

তখন হঠৎ স্থানীয় জামে মসজিদের সভাপতি একরাম হোসেনের নেতৃত্বে শতাধিক লোক অতর্কিতে হামলা চালায় তাদের ওপর। তারা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রসহ ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে সাধুসঙ্গের ওই বাড়িটি ভাংচুর করেন এবং সাধুদের মারধর করেন।

আহতদের মধ্যে ফজল ফকির (৯০) কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।  

ফজল ফকির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সেখানে মুড়ি-চানাচুর খেতে খেতে নিজেদের কুশল বিনিময় করছিলাম; হঠাৎ ঘরের চালে দুমদাম করে ইট পাটকেল এসে পড়ছিল। এরপর একসঙ্গে ‘নারায়ে তাকবির’ বলে ঘরবাড়ি ভাংচুর করে ভিতরে ঢুকে নির্বিচারে লাঠি ও রড় দিয়ে পেটানো শুরু করে। আমি তাদের কাছে জোড় হাত করেও রক্ষা পাইনি। হাইসু [হাসুয়া] দিয়ে কুপিয়ে এবং লাঠিসোটা দিয়ে নির্মমভাবে মারধর করে সাধুসঙ্গ ভন্ডুল করে দেয়।”

আহত সাধুরা জানান, সেখানে কোনো মাইক বা সাউন্ড বক্স ব্যবহার করা হয়নি; কোনো বাদ্যযন্ত্র ছিল না; গান-বাজনাও হয়নি। হঠাৎ বাড়িটির চারপাশে কিছু লোক ঘিরে ফেলে এবং ইটপাটকেল ছুড়ে ভাঙচুর করে৷ তারা বাড়িতে প্রবেশ করে উপস্থিত ১৫-২০ জনকে বেধড়ক লাঠিপেটা করে। তারা বৃদ্ধ বা নারী কাউকেই ছাড় দেয়নি।

অভিযোগের বিষয়ে মসজিদ কমিটির সভাপতি একরাম হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।  

তবে একরাম হোসেনের মেয়ে সাহিদা (২৮) বলেন, “আমার আব্বা তিন বছর ধরে ওদের এই সাধুসঙ্গ বন্ধ করার জন্য বলে আসছে। ওরা কোনো কথা শোনেনি বলেই গ্রামের লোকজন মসজিদে বসে সিদ্ধান্ত নিয়েই সাধুদের উচ্ছেদ করেছে।”

সরেজমিনে আলাপকালে মসজিদ কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করে বলেন, “এই গ্রামে হয় মসজিদ থাকবে নয়ত সাধুর আস্তানা থাকবে। ওরা পারলে এই লোকালয় থেকে তফাতে গিয়ে ওই মাঠের মধ্যে আস্তানা গাড়ুক, কেউ দেখতে যাবে না।”

এ ঘটনার পর জেলার বাউল সাধু ও স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।

সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের কুষ্টিয়ার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম বলেন, “এসব নির্বোধ কাঠমোল্লাদের জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মবলিদান, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির মধ্য দিয়ে এই দেশ স্বাধীন হয়নি। দিন দিন এরা সীমা ছাড়িয়ে দেশের মধ্যে সাম্প্রায়িক উস্কানি সৃষ্টি করে পরিস্থিতি অশান্ত করছে। এদের শক্ত হাতে মুলোৎপাটন এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার খাইরুল আলম বলেন, গত ৫ নভেম্বর দৌলতপুরে বাউলদের ওপরে হামলার ঘটনায় ১৯ জনের নামোল্লেখসহ অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ এনে ইতোমধ্যে দৌলতপুর থানায় মামলা হয়েছে। আসামি ধরতে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। সেখানে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পুলিশী নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

দৌলতপুর থানার ওসি মজিবর রহমান জানান, “সাধুদের  উপর  হামলার মামলায় এজাহারনামীয় ১৮ জন ইতোমধ্যে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নিয়েছেন। শুধু বাবুল হোসেন ওরফে বাবলু নামের একজন জেলা হাজতে আছেন।”