শুক্রবার হাজারো হামলাকারী কারাগারে হামলা-অগ্নিসংযোগ করে ভেতরে ঢুকে সেলের তালা ভেঙে দিলে নয় ‘জঙ্গি’সহ ৮২৬ কয়েদি পালিয়ে যায়।
Published : 24 Jul 2024, 12:37 PM
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে শুক্রবার হাজার হাজার মানুষ মিছিল নিয়ে নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা-অগ্নিসংযোগ করে ভেতরে ঢুকে সেলের তালা ভেঙে দিলে নয় ‘জঙ্গি’সহ মোট ৮২৬ কয়েদি পালিয়ে যায়। এ সময় অস্ত্র-গোলাবারুদ ও খাদ্যপণ্য লুট এবং ব্যাপক ভাঙচুর করে হামলাকারীরা।
প্রাথমিকভাবে কারা কর্তৃপক্ষ ও রক্ষীরা প্রতিহত করার চেষ্টা করলেও অবস্থা বেগতিক দেখে পিছু হটতে বাধ্য হয়। একপর্যায়ে তারা জীবন বাঁচাতে কয়েদিদের সঙ্গে মিশে যান। এ সময় যেসব কয়েদি জেল ছেড়ে পালাতে চাননি তাদের মারধরও করা হয়।
শনি ও রোববার কারাগারে গিয়ে হামলার ধ্বংসের চিত্র দেখা যায়। শনিবারও সেখানে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। কারাগারের পুরো চত্বরজুড়েই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ইট-পাটকেল, কারাগারের বিভিন্ন স্থাপনার ভাঙা জিনিসপত্র। কর্তৃপক্ষ বলছিলেন, আগামী এক বছরেও কারাগারটিতে পুরোপুরি বসবাসের উপযোগী করা তোলা যাবে না।
যেভাবে হামলার সূত্রপাত
নরসিংদী জেলা কারাগারটি শহরের ভেলানগরের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশেই অবস্থিত। এই ভেলানগর ও জেলখানা মোড়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা গত কয়েকদিন ধরেই লাগাতার বিক্ষোভ-সমাবেশ করছিলেন।
শুক্রবারও সেখানে একই রকমভাবে কয়েক হাজার মানুষ বিক্ষোভ করছিলেন। তবে সেদিন সেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের খুব একটা দেখা যায়নি। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে হঠাৎ করেই হাজারো জনতা কারাগারের দিকে এগোতে থাকে।
তারা গিয়ে সেখানে প্রথমে ইট-পাটকেল, পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে। হামলাকারীদের প্রায় সবার হাতে লাঠিসোঁটা, দেশীয় অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। এ সময় প্রাথমিকভাবে কারারক্ষীরা তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে তাদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
কিন্তু এক পর্যায়ে কারারক্ষীরা পিছু হটে। তখন হামলাকারীরা কারাগারের দুই দিকের ফটক অনেকটা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় হামলায় চার কারারক্ষী গুরুতর আহত হয়। পরে কারারক্ষীরা নিরুপায় হয়ে জেলখানার ভেতরে ঢুকে নিজেদের রক্ষা করেন। জেল কোড অনুযায়ী, গুলি করার নিয়ম থাকলেও তা করা হয়নি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হামলাকারীরা মূল কারাগারের ভেতরে ঢুকে সেলগুলো শাবল ও লোহার জিনিসপত্র দিয়ে ভেঙে কয়েদিদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। কিছু কারারক্ষীর কাছ থেকে চাবি নিয়েও সেলের তালা খোলা হয়।
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কয়েদিরা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। এর মধ্যে নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নয় সদস্য ছিল; যাদের মধ্যে দুজন নারী। কোনো কোনো সাধারণ কয়েদি পালিয়ে যেতে না চাইলে তাদের মারধর করে জেল থেকে বের করে দেওয়া হয়। সাজাপ্রাপ্ত বন্দিরা কারাগারের পোশাক নিয়েই পালিয়ে যায়।
কারারক্ষীরা পিছু হটার পর অস্ত্রভাণ্ডার ভেঙে মোট ৮৫টি অস্ত্র ও কয়েক হাজার গুলি লুট করে হামলাকারীরা। এ সময় কারাগারের ভেতরে কয়েদিদের থাকা খাবারও লুট করা হয়। বন্দিদের কাছে থাকা টাকাও ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে।
কারাগারের ভেতরে কর্মকর্তা ও কারারক্ষীদের থাকার কোয়ার্টার ও ব্যারাক রয়েছে। সেসব আবাসিক ভবনে অনেকে পরিবার নিয়েও থাকেন। হামলাকারীরা সেসব ভবনেও হামলা চালায় এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে। লুটপাটও চালানো হয়। হামলার সময় পুরো আবাসিক এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেকের পরিবার আবাসিক এলাকার ভেতরে মসজিদে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেখানেও হামলার চেষ্টা চালানো হয়।
হামলার বর্ণনা দিয়ে নরসিংদী জেলা কারাগারের জেল সুপার আবুল কালাম আজাদ সাংবাদিকদের বলেন, “আক্রমণের সময় কয়েক হাজার হামলাকারী এসে প্রথমে কারাগারের মূল ফটক ভেঙে ফেলে এবং ভেতরের ফটক আক্রমণ করলে কারারক্ষীরা প্রথমে তাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করে। পরে অবস্থা বেগতিক দেখে প্রাণ বাঁচাতে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকে।
একপর্যায়ে জেল সুপার, জেলারসহ অন্যরা নিজেদের কক্ষ ছেড়ে জেলের ভেতরে ঢুকে পড়েন এবং তারা বন্দিদের সঙ্গে মিশে যান। এতেই তাদের প্রাণরক্ষা হয় বলে জানান জেল সুপার।
তিনি বলেন, “হামলাকারীরা প্রতিটি সেলে ঢুকে শাবল, চাপাতি, চাইনিজ কুড়ালসহ বিভিন্ন অস্ত্র দিয়ে তালা ভেঙে কয়েদিদের মুক্ত করে এবং পালাতে উৎসাহ দেয়। এ সময় অস্ত্র ও চাল-ডালসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য লুট হয়।”
এ ঘটনার সময় জেলা পুলিশের সহায়তা চাওয়া হয়েছিল জানিয়ে জেল সুপার বলেন, “আমি বিষয়টি পুলিশ সুপারকে অবহিত করি। তখন পুলিশ সুপার জানান, তিনি নিজেও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছেন। ফলে তিনি আমাদেরকেই কারাগার রক্ষার ব্যবস্থা নিতে বলেন।”
কারাগার যেন ধ্বংসস্তূপ
শনিবার কারাগারে গিয়ে দেখা যায়, কারাগার যেন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। অফিস কক্ষ, কনডেমড সেল, রান্নাঘর, খোলা চত্বর সব জায়গায় তাণ্ডবের চিহ্ন। দরজা-জানালাগুলো ভেঙে গেছে, কোথাও কোথাও আগের দিনের লাগানো আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। দেয়ালে দেয়ালে ছিল পোড়া চিহ্ন।
বিভিন্ন কর্মকর্তাদের কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, নথিপত্র পুড়ে গেছে। অনেক আসবাবপত্রে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। কয়েদিদের সেলগুলো খোলা অবস্থায় রয়েছে। কারাগারের ভিতরে থাকা বাগানটিও তছনছ অবস্থায় দেখা গেছে।
এ সময় আশপাশের কিছু উৎসুক মানুষকেও কারাগার ঘুরে দেখতে দেখা যায়। অনেকে মোবাইলে ধ্বংসযজ্ঞের ছবিও তুলছিলেন।
একজন কারারক্ষী বলছিলেন, যখন তাদের কাছ থেকে চাবি ছিনিয়ে নেওয়া হয় তখন তাদের মারধরও করা হয়। চাবি নিয়ে সেলে গিয়ে সেগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং সেখানে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
নরসিংদী জেলা কারাগারের জেলার কামরুল ইসলাম বলেন, গত ১৪০ বছরের ইতিহাসে কারা অভ্যন্তরে বন্দিদের বিদ্রোহের ইতিহাস থাকলেও বাইরে থেকে বন্দিদের ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা এই প্রথম। কারাগারের ৭৫ কারারক্ষীর মধ্যে ২০ জন আহত হয়েছেন।
৮৫ অস্ত্র ও আট হাজার গুলি লুট
কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, হামলাকারীরা কারাগার থেকে ৮৫টি অস্ত্র ও আট হাজারের বেশি গুলি ছিনিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে সাত হাজার রাইফেলের এবং শটগানের গুলি রয়েছে এক হাজার ৫০টি।
তবে মঙ্গলবার জেলা পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এখন পর্যন্ত মোট ৯৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে ছয়জন কয়েদি। তাদেরকে কারাগারের আশপাশ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এ ছাড়া লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে ৩৩টি, এক হাজার গুলি এবং অসংখ্য হাতকড়া উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার।
শনিবার কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এস এম আনিসুল হক, পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলামসহ পুলিশ ও কারা কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা কারাগার পরিদর্শন করেন।
কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আনিসুল হক এ ধরনের হামলাকে ‘দেশের ইতিহাসে বর্বরোচিত আক্রমণ’ মন্তব্য করে বলেন, “দেশের পরিস্থিতি নষ্ট করার জন্য স্বার্থান্বেষী মহলের অপচেষ্টার সর্বোচ্চ নৃশংসতার বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখলাম। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত।”
এ ধরনের ঘটনা মোকাবিলায় রাষ্ট্রের সকল শক্তি একতাবদ্ধ জানিয়ে আইজি প্রিজন বলেন, “আমরা এ ক্ষতি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াব। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণের চেষ্টা হচ্ছে। অস্ত্র উদ্ধারে তৎপর রয়েছে পুলিশ।”
পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, “অস্ত্র লুট ও বন্দিদের আন্দোলনকারীদের পক্ষে নেওয়ার জন্যই এই হামলা চালানো হয়েছে। এখান থেকে লুট হাওয়া অস্ত্র নিয়ে তারা পুলিশের বিরুদ্ধে ফাইট করছে। আজকে নারায়ণগঞ্জে তারা ফাইট করছে। সেখানে অস্ত্রসহ চারজন ধরা পড়েছে।
এই হামলায় নিসন্দেহে বিএনপি-জামায়াত জড়িত জানিয়ে সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, “হামলাকারীদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।”
সোমবার রাজারবাগে পুলিশ হাসপাতালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও বলেন, নরসিংদী জেলা কারাগার থেকে অস্ত্র লুট করে নিয়ে তারা সেই অস্ত্র দিয়ে পুলিশের সঙ্গে লড়াই করছে।
পুরস্কার ঘোষণা
সোমবার নরসিংদী জেলা কারাগার পরিদর্শনে গিয়ে পুলিশের প্রধান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার ও অস্ত্রধারীদের ধরিয়ে দিতে পারলে পুরস্কারের ঘোষণা দেন।
তিনি বলেন, “অস্ত্র লুট হয়েছে। কেউ অস্ত্রধারী ধরিয়ে দিতে পারলে বিশেষ পুরস্কার, অস্ত্র উদ্ধার করে দিতে পারলে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।”
এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, কারাগারে হামলার ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। যেহেতু এখানে অনেক ধরনের অপরাধ হয়েছে ফলে আরও মামলা হবে।
তদন্তে দুই কমিটি
নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা-অগ্নিসংযোগ ও কয়েদি পালানোর ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
সোমবার বিকালে কারাগার পরিদর্শনে গিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মশিউর রহমান এ তথ্য জানান।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র যুগ্ম সচিব ড. ফারুককে প্রধান করে ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কারা কর্তৃপক্ষ একজন এডিশনাল আইজি প্রিজনকে প্রধান করে তিন সদস্যের আরেকটি কমিটি করেছে। উভয় কমিটিকে আগামী ১০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
এ সময় মশিউর রহমান বলেন, এরই মধ্যে জেলা কারাগারের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সেখানে পুলিশের পাশাপাশি বিজিবির ক্যাম্প করা হয়েছে।
কারাগারের বিদ্যুৎ ও পানির সরবরাহ ব্যবস্থা সচল করা হয়েছে। পাশাপাশি ফটক ও সিসি ক্যামেরা মেরামত করা হয়েছে।
কারাগারকে প্রাথমিকভাবে থাকার উপযোগী করা হয়েছে জানিয়ে মশিউর রহমান বলেন, “কয়েকজনকে সেখানে রাখা হয়েছে। এরপর কয়েদিদের যারা আত্মসমর্পণ করতে আসবেন তাদেরও এখানে রাখা হবে।”