“নয়নের চাকরিতে পরিবারে একটু সচ্ছলতা ফিরতে শুরু করেছিল। কিন্তু সেই সুখ বেশিদিন টিকলো না।”
Published : 26 Dec 2024, 11:01 PM
আক্তারুজ্জামান পেশায় কৃষক। নদী ভাঙনে সব হারিয়ে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বড়বালা ইউনিয়নের ছড়ান আটপড়িয়া গ্রামে থাকেন পরিবার নিয়ে। সামান্য আয়ে স্ত্রীকে নিয়ে কোনোরকমে সংসার চলে তার। ফায়ার ফাইটার ছেলে সোহানুর জামান নয়ন ছিলেন তার পরিবারের একমাত্র অবলম্বন।
সব ভরসা ছিল ছেলেকে ঘিরে। স্বপ্ন ছিল, ছেলের চাকরি দিয়ে সামনের দিনগুলো কাটাবেন সুখে-শান্তিতে। কিন্তু আক্তাররুজ্জামের সেই স্বপ্ন ভেঙে গেছে। সচিবালয়ের সামনে আগুন নির্বাপণের সময় ট্রাকচাপায় ট্রাক চাপায় ছেলের মৃত্যুতে এখন তার পরিবারের এখন একরাশ হাহাকার।
কাঁদতে কাঁদতে আক্তারুজ্জামান বলেন “ছেলেকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন ছিল। অথচ এখন তার লাশ আমার কাঁধে। বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ অনেক ভারী। সবকিছু শেষ হয়ে গেল।”
বুধবার রাত পৌনে ২টার দিকে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন লাগার খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট সেখানে যায়।
আগুন নেভানোর কাজে নিয়োজিত ফায়ার ফাইটার নয়ন পানির লাইন দিতে রাস্তা পার হওয়ার সময় ট্রাক চাপায় গুরুতর আহত হন। তাকে চাপা দিয়ে ট্রাকটি পালিয়ে যায়।
বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর বঙ্গবাজারে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদর দপ্তরে নয়নের জানাজা হয়। তার আগে তার কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পক্ষ থেকে।
একইদিন নয়নের ছড়ান আটকুনিয়া গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে চলছে শোকের মাতম। সন্তান হারানোর ব্যথা সইতে না পেরে বুক চাপড়ে আহাজারি করছেন পাগলপ্রায় মা নার্গিস আক্তার। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরাও কাঁদছেন নয়নের মর্মান্তিক মৃত্যুতে।
নয়নের মৃত্যুর খবর পাওযার পর থেকে অনবরত কেঁদেই চলছেন নার্গিস বেগম। ছেলের কতঅ জিগেস করতেই কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, “নয়ন ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়েছিল এখনও রেজাল্ট হয়নি। বলতো, মা আমি ডিগ্রি পাস করলে আমার পদোন্নতি হবে, তখন সংসারে অভাব থাকবে না।
“কিন্তু আল্লাহর কি লীলা খেলা, পরীক্ষার রেজাল্টও জানতে পারলো না। যে ট্রাকচালক তাকে সন্তানহারা করেছে তার কঠোর বিচার দাবি জানাই।”
আক্তারুজ্জামান ও নার্গিস দম্পতির একমাত্র ছেলে নয়ন। এক বোন ও এক ভাইযের মধ্যে সবার ছোট। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। ২৪ বছর বয়সী এ তরুণের মূল কর্মস্থল সিলেটের বিশ্বনাথ ফায়ার স্টেশন হলেও তাকে ঢাকায় এনে তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনে সংযুক্ত করা হয়েছিল।
নিহতের স্বজনরা বলেন, নয়নই ছিল পরিবারের একমাত্র ভরসা। তাকে ঘিরেই স্বপ্ন দেখতেন তার মা-বাবা ও বোন। কিন্তু হঠাৎ এমন মৃত্যুতে যেন পুরো পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেল। মৃত্যু কেউই মেনে নিতে পারছেন না।
আগুন নেভাতে ঘটনাস্থলে থাকা ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সড়কে বেরিকেড না দেওয়ায় ট্রাক ঢুকে নয়নের এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ তুলেছেন তার স্বজনরা।
ট্রাকচালককে অতি দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচার নিশ্চিতের পাশাপাশি নয়নের পরিবারের পাশে যেন সরকার দাঁড়ায় সে দাবিও জানান তারা।
বড়বালা ইউনিয়নের সদস্য জিয়াউল হক জুয়েল বলছিলেন, “নয়নের পরিবার নদী ভাঙনের শিকার। নিজস্ব জমিজমা বলতে তেমন কিছু নেই। আক্তারুজ্জামানের অনেক কষ্টে একমাত্র ছেলে নয়নকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করিয়েছেন। ২০২২ সালে তার চাকরি হয়।
“নয়নের চাকরিতে পরিবারে একটু সচ্ছলতা ফিরতে শুরু করেছিল। কিন্তু সেই সুখ বেশিদিন টিকলো না। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে
এখন পরিবারটি দিশাহারা হয়ে পড়েছে।”
বড়বালা ইউপি চেয়ারম্যান তারিকুল ইসলাম সরকার বলেন, “নয়নের পরিবার অনেক দরিদ্র। তার এভাবে অকালে চলে যাওয়াটা কষ্টের। সরকারিভাবে ওই পরিবারের জন্য কিছু একটা করার জন্য জোর দাবি জানাই।”
ফায়ার ফাইটার নয়ন ২০২২ সালে ৬১তম ব্যাচে যোগ দিয়েছিলেন অগ্নি নির্বাপক বাহিনীতে।