হাসপাতালটির পরিচালক বলছেন, ‘টম অ্যান্ড জেরি’ যেমন শুরু হয় কিন্তু শেষ হয় না, তেমনি দালালরাও শেষ হবে না।
Published : 08 Nov 2024, 10:36 AM
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সব উন্নত স্বাস্থ্যসেবা থাকার পরও দালাল চক্রের কারণে সেবা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের ভোগান্তির সীমা নেই ।
হাসপাতালটির সর্বত্রই ফাঁদ পেতে রেখেছে দালালরা। সেবাপ্রত্যাশীদের ফাঁদে ফেলতে পারলেই ভয়ভীতি দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটছে অহরহ।
কুমিল্লা জেলার জনসংখ্যা ৬৩ লাখের বেশি। পাশাপাশি চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ আশপাশের জেলাগুলো থেকে প্রতিদিন রোগীরা সেবা নিতে আসেন এই হাসপাতালে। কিন্তু দালাল চক্রের হাতে হাসপাতালে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা একপ্রকার জিম্মি হয়ে পড়েছেন।
বছরের পর বছর ধরে হাসপাতালটিতে দালাল চক্রের এমন দৌরাত্ম্যের লাগাম টেনে ধরতে কর্তৃপক্ষের চোখে পড়ার মত কোনো উদ্যোগও নেই।
কর্তৃপক্ষ বলছে, দালালদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালিত হচ্ছে; প্রায়ই ধরাও পড়ছে। তবে হাসপাতাল পুরোপুরি দালালমুক্ত করা সম্ভব নয়; নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে।
দৌরাত্ম্য বেশি বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগ ও ক্যাজুয়েলিটি ওয়ার্ডে
৫০০ শয্যার এই হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে এক হাজারের বেশি রোগী ভর্তি থাকেন। বহির্বিভাগে ১০ টাকার টিকেটে সেবা নিতে আসেন অন্তত এক হাজার মানুষ।
সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত এ বহির্বিভাগে বেশি সক্রিয় থাকছে দালাল চক্র। অন্য সময় জরুরি বিভাগ ও ক্যাজুয়েলিটি ওয়ার্ডে।
সম্প্রতি বহির্বিভাগে গিয়ে দেখা গেছে, টিকিট কাটতে পুরুষ ও নারীরা আলাদাভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ।
এ সময় দুই শতাধিক সেবাপ্রত্যাশীকে লাইনে দেখা যায়। টিকিট কেটে তারা নির্দিষ্ট চিকিৎসকের কক্ষে ঢুকছেন।
তবে চিকিৎসকের কক্ষ থেকে বের হতেই দালালরা রোগীদের ঘিরে ধরছে। তারা ব্যবস্থাপত্র দেখে নিশ্চিত হয়, রোগীকে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেওয়া হয়েছে কিনা।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা থাকলেই রোগীদের ফাঁদে ফেলার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়তে দেখা গেছে দালাল চক্রের। কম খরচে উন্নত পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ সেবা দেওয়ার কথা বলে কৌশলে রোগীদের বাগিয়ে নেওয়া হয় বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক-প্যাথলজিতে।
দালালদের এমন ফাঁদে বেশি পড়ছেন গ্রাম থেকে আসা সহজ-সরল রোগীরা ।
আবার কোনো একটি অ্যাম্বুলেন্স এলেই চক্রটি চেষ্টা করে রোগীকে বেসরকারি ক্লিনিক-হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার।
হাসপাতালটির বহির্বিভাগের সামনে বেশ কয়েকজন আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করলেও তাদের চোখের সামনেই এসব কাজ করছে দালালরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পঞ্চাশোর্ধ্ব এক আনসার সদস্য বলেন, এই হাসপাতালে সক্রিয় দালালের সংখ্যা দুই শতাধিক। এদের বেশিভাগই স্থানীয়। ফলে এদের কিছুই বলা যায় না।
তিনি বলেন, কিছু বললেই হাসপাতালের গেইটের বাইরে নাশতা করতে গেলেও দালালরা আমাদের বিভিন্ন হুমকি-ধমকি দেওয়াসহ হয়রানি করে। অনেক সময় ব্লেড নিয়ে আসে পোচ দেওয়ার জন্য।
ওই আনসার সদস্য আরও বলেন, হাসপাতালটিতে মোট তিন শিফটে কাজ করে দালাল চক্র। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত, বিকাল থেকে রাত ৯টা-১০টা পর্যন্ত এবং রাত ১০টা থেকে সকাল পর্যন্ত।
এসব বিষয় হাসপাতালের চিকিৎসক থেকে শুরু করে প্রতিটি স্টাফই জানেন। কিন্তু দালালরা এতোটাই সংঘবদ্ধ যে, তাদের ভয়ে কেউ মুখ খোলেন না।
হাসপাতালের কিছু কিছু স্টাফও চক্রটির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানতে চাইলে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দায়িত্বরত আনসার সদস্যদের ইনচার্জ সবুজ হোসাইন বলেন, “এসব বিষয়তো সবাই জানেন। আমাদের চোখের সামনে দালাল চক্রটি রোগীদের বিরক্ত করলে আমরা তাদের বাধা দিই। এর বেশি কিছু বলা যায় না, কারণ প্রায় সবাই স্থানীয়।”
বহির্বিভাগ সেবা নিতে আসা কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের মুন্সিরহাট এলাকার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, “রোগীদের ভিড়ে দালালরা এমনভাবে থাকে যে, সহজে তাদের চেনাও যায় না।”
তার ভাষ্য, দালাল চক্র অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে বেশি সক্রিয়। ফলে হাসপাতালে আসার রোগীরা সঠিক সেবা থেকে বঞ্চিত।
মনির হোসেন নামে এক সেবাপ্রত্যাশী বলেন, “হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শুধু ‘দালাল হতে সাবধান’ সাইনবোর্ড টানিয়েই দায় সেরেছে।”
বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা কুমিল্লা নগরের হাউজিং এলাকার বাসিন্দা অন্তঃসত্ত্বা নাসরিন বেগম বলেন, “এখানে ডাক্তার দেখাতে এসেছি। চিকিৎসক আল্ট্রা করতে দিয়েছেন। চিকিৎসক কক্ষ থেকে বের হতেই তিনজন নারী দালাল ঘিরে ধরে বেসরকারি ক্লিনিকে যাওয়ার জন্য। পরে আমি দ্রুত সরে চলে আসি।
“পুরুষ ও নারী দালালরা গ্রামের সহজ-সরল মানুষের বেশি ফাঁদে ফেলছে।”
এদিকে কুমিল্লা নগরের টমছমব্রিজ এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় নবজাতকের মৃত্যুর অভিযোগে গত ২৯ অক্টোবর কুমিল্লা কোতায়ালি মডেল থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন বরুড়া উপজেলার শৈলখালি গ্রামের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম ।
ওই নবজাতকের মৃত্যুর নেপথ্যেও কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দালাল চক্র।
সাইফুল ইসলাম বলেন, ২১ অক্টোবর রাত ২টার দিকে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ফাতেমা বেগমকে নিয়ে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান তিনি।
তার ভাষ্য, “এ সময় হাসপাতালের স্টাফ পরিচয়ে এক দালাল রোগীর সব কাগজপত্র হাতে নিয়ে তাকে বলেন, মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক টমছমব্রিজ এলাকার একটি হাসপাতালে আছেন।
এরপর তাদের ফাঁদে ফেলে ওই বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায় দালাল।
এক পর্যায়ে ওই দালাল তাদের কাছ থেকে রোগীর বড় ধরনের সমস্যার কথা বলে ৬০ হাজার টাকা নিয়ে কৌশলে পালিয়ে যান। এরপর শুরু হয় তাদের ভোগান্তি।
২২ অক্টোবর ভোরে ৪টার দিকে সিজারের (অস্ত্রোপচার) মাধ্যমে একটি ছেলে সন্তানের জন্ম দেন তার স্ত্রী।
এরপর ওই বেসরকারি হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে। আরও টাকার জন্য মৃত বাচ্চার পাশাপাশি তার স্ত্রীকেও আটকে রাখে হাসপাতালের লোকজন।
যদিও সাইফুলের স্ত্রী ফাতেমা বেগমের দাবি, যে মৃত নবজাতকটি তাদের দেওয়া হয়েছে, সেটি তাদের নয়। কৌশলে চক্রটি বাচ্চা পাল্টে ফেলেছে।
অভিযোগটির তদন্তকারী কর্মকর্তা কুমিল্লা কোতায়ালি মডেল থানার কান্দিরপাড় ফাঁড়ির এসআই মনির হোসেন বলেন, “আমরা ঘটনাটি তদন্ত করে দেখছি। পাশাপাশি ওই দালালকেও শনাক্তের চেষ্টা করছি।”
যা বলছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. মাসুদ পারভেজ বলেন, “দালাল চক্রের বিরুদ্ধে আমরা প্রতিনিয়ত অভিযান চালাচ্ছি। প্রায়ই অভিযানে দালালরা ধরা পড়ছেন। তবে দালাল পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব নয়, আমরা তাদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি।
“টম অ্যান্ড জেরি’ শুরু হলেও যেমন শেষ হয় না, তেমনি দালালরাও শেষ হবে না।”
তার ভাষ্য, “আমরা অভিযান চালিয়ে তাদের ধরব। তবে সবচেয়ে বড় কথা, রোগীদের এসব বিষয়ে সতর্ক হতে হবে।”