২০০৯ সাল থেকে শখের বশে প্রাচীন দুর্লভ সব জিনিসপত্র সংগ্রহ শুরু করেন পেশায় সাইকেল মেকানিক শাহজাহান।
Published : 05 Nov 2024, 11:04 AM
যশোরের শার্শা উপজেলার নিজামপুর বাজারের সাইকেল মেকানিক শাহজাহান কবির। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিক্রির জন্য রাখা বিভিন্ন যন্ত্রাংশের পাশাপাশি রাখা আছে অতীতের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত শত শত সামগ্রী।
ছোট্ট ঘরেই কাঠের শোকেসে থরে থরে সাজিয়ে রাখা আছে রয়েছে ৫৬৫ প্রকারের দুর্লভ তৈজসপত্র। আরও আছে প্রাচীন ধাতব মুদ্রা, কাগজের নোট, বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত বাংলাদেশের ডাকটিকিট।
তৈজসপত্রের মধ্যে প্রাচীন সময়ের ব্যবহৃত হাঁড়ি-পাতিলের সঙ্গে আছে হারিকেন, লণ্ঠন, ছুরি ও কারুকার্যময় ছুরির খাপ, আদিবাসীদের ব্যবহৃত গয়না, বাজু, নুপূর, বিছা, গলার হার, চুড়ি, পাথরের থালা-বাসন, হুকা, অভিনব তালাচাবি, জার্মানির তৈরি হ্যাজাক, ল্যাম্প, সুইডেনের তৈরি পিতলের স্টোভ, কলের গানের রেকর্ড, পিতলের তৈরি কয়লার ইস্ত্রিসহ প্রাচীন ও বর্তমান সময়ে ব্যবহৃত নানা জিনিসের সংগ্রহ।
উপজেলার নিজামপুর গ্রামের বাসিন্দা নওসের আলির ছেলে শাহজাহান কবির। পেশায় সাইকেল মেকানিক শাহজাহান ২০০৯ সাল থেকে শখের বশে প্রাচীন দুর্লভ সব জিনিসপত্র সংগ্রহ শুরু করেন।
পরে নিজামপুর বাজারে নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেই গড়ে তুলেছেন সংগ্রহশালা। তার ব্যক্তিগত এ উদ্যোগের নাম ‘শাহজাহান সংগ্রহশালা’।
শাহজাহান কবিরের ভাষ্য, “আধুনিক যুগে প্রযুক্তির ব্যবহারে দেশের অতীত ঐতিহ্য ভুলে যাচ্ছে মানুষ। সেই ভুলে যাওয়া ঐহিত্য তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য আমার এই প্রচেষ্টা। এতে নতুন প্রজন্ম প্রাচীন ও বর্তমান সমাজের মানুষের জীবনযাপনের পার্থক্যগুলো বুঝতে পারবেন।”
তিনি বলেন, “এগুলো সংগ্রহ করতে যেমন অনেক অর্থ ব্যয় করেছি, তেমনি এর পেছনে আছে অনেক পরিশ্রম। তিলে তিলে গড়ে তোলা আমার সংগ্রহশালার জিনিসগুলো এক নজর দেখতে প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন আসেন। তারা আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করে, এটাই আমার বড় পাওয়া।”
শাহজাহান আরও বলেন, “এ দেশের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। অথচ আধুনিকতার ছোঁয়ায় অনেক কিছু হারিয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্মকে ইতিহাস জানানোর জন্য নিজের প্রচেষ্টায় ব্যক্তিগত সংগ্রহশালাটি গড়ে তুলেছি। ১৫ বছর ধরে এ কাজ করে যাচ্ছি।”
সম্প্রতি শাহজাহান কবিরের এই সংগ্রহশালায় গিয়ে দেখা যায়, সংগ্রহশালাটি দেখতে শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সব বয়সি মানুষই আসেন। অনেক প্রবীণ এসে জিনিসপত্র নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে ফিরে যান শৈশবে ।
স্থানীয় কলেজশিক্ষক গোলাম মোস্তফা বলেন, “সভ্যতার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে আমরা যান্ত্রিক মানুষ হয়ে যাচ্ছি। এই যান্ত্রিকতার কারণে হারাতে বসেছি গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী নানা জিনিসপত্র। আমরা আমাদের অতীত ঐতিহ্য ভুলে সভ্যতার লেবাস পরেছি।”
তার ভাষ্য, “অতীত ঐতিহ্যের সংগ্রহ বা সংরক্ষণ ও আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে শাহজাহান কবিরের এই মহৎ উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়।”
নাভারন ফজিলাতুন্নেছা সরকারি মহিলা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী অনামিকা আফরিন বলেন, “বইয়ের পাতায় আশি বা নব্বই দশকের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিসের ছবি দেখেছি। তবে আধুনিক যুগে এসে বাস্তবে ওইসব ঐহিত্যবাহী তৈজসপত্র দেখার সৌভাগ্য হবে, এটি কখনো ভাবিনি। এখানে খুব ভালো লাগল শাহজাহান কবিরের সংগ্রহশালাটি দেখে।”
আরেক শিক্ষার্থী আফিয়া অর্পা বলেন, “শাহজাহান কবিরের সংগ্রহশালা দেখে দারুন একটা অনূভূতি হয়েছে। ওই সময়ে ব্যবহৃত তৈজসপত্র দেখে মনে হচ্ছে, মানুষের জীবন-যাপন ছিল খুবই সাধারণ। তাছাড়া প্রচুর পরিশ্রমী ছিলেন বলেও আন্দাজ হয়।”
দর্শনার্থী নয়ন হোসেন বলেন, “সংগ্রহশালায় প্রাচীন যুগের বিভিন্ন জিনিসপত্র দেখে খুবই ভালো লেগেছে। তার সংগ্রহশালায় বিভিন্ন সময়ের টাকা, গহনা, পুরানা যাতা, পাটকাটা প্রতিমা, তীর-সড়কি, বল্লম, ঘড়ি, রেডিও, রাজা-বাদশাদের ব্যবহৃত কাঁসা-পিতল-তামা-দস্তার তৈরি মনোমুগ্ধকর তৈজসপত্র রয়েছে।”
তিনি বলেন, “প্রাচীন যুগের অনেক কিছুই দেখা ছিল না। আলাদা একটি জাদুঘরের মত তৈরি করে সংগ্রহশালাটি মানুষের জন্য উন্মুক্ত রাখলে প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্য জানা আরও সহজ হবে।”
এ বিষয়ে শাহজাহান কবির বলেন, জায়গা সংকটে সব সুন্দরভাবে গুছিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। একটি খোলা জায়গা পেলে সেখানে জাদুঘরের মত তৈরি করার ইচ্ছে আছে তার।