কুমিল্লার সীমান্তে মুমূর্ষু যুবকের প্রাণ গেল উদ্ধারের ঠেলাঠেলিতে

নাগরিকত্বের পরিচয় নিয়ে বিজিবি-বিএসএফের ঠেলাঠেলির মধ্যে মুমূর্ষু যুবকটি দীর্ঘ প্রায় ১০ ঘণ্টা সীমান্তে পড়েছিলেন।

কুমিল্লা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Sept 2022, 04:41 PM
Updated : 9 Sept 2022, 04:41 PM

কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার সীমান্তের ওপারে এক বাংলাদেশি যুবকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে বলে চিকিৎসক জানিয়েছেন।

বিজিবি ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে শশীদলের নারায়ণপুর সীমান্তের ওপারে তুষার খাঁ (৩৫) নামের ওই যুবককে মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন স্থানীয়রা। বিকাল ৪টার দিকে উদ্ধার করার সময় তাকে মৃত পাওয়া যায়।

এলাকাবাসীর ভাষ্য, পরিচয় নিশ্চিত না হওয়ায় উদ্ধারে বিজিবি-বিএসএফ ঠেলাঠেলিতে ওই যুবক সীমান্তের ওপারে ভারতের অভ্যন্তরে আহত ও অজ্ঞান অবস্থায় অন্তত ১০ ঘণ্টা পড়েছিলেন।

ব্রাহ্মণপাড়া থানার ওসি অপ্পেলা রাজু নাহা জানান, শুক্রবার সকালে এই যুবকের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

তুষার খাঁ নওগাঁর রানীনগর উপজেলার বালুভরা গ্রামের মোসলেম খাঁর ছেলে। তিনি ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার শশীদল এলাকায় ফুফু আসমা বেগমের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন।

বুধবার দুপুর থেকে তুষার খাঁ নিখোঁজ ছিলেন বলে ফুফু আসমা বলেছেন।

শুক্রবার ওসি অপ্পেলা রাজু নাহা বলেন, পতাকা বৈঠক শেষে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিএসএফের কাছ থেকে ওই যুবকের লাশ বুঝে নেয় বিজিবি। পরে রাতে পুলিশের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়। শুক্রবার কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। পরে পরিবারের লোকজনের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়।

তিনি বলেন, এ ঘটনায় নিহত ব্যক্তির পরিবার থেকে এখনও কোনো লিখিত অভিযোগ পাওয়া যায়নি। অভিযোগ পেলে ঘটনাটি তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

বিজিবি ও স্থানীয়রা জানায়, বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে সীমান্তের ওই এলাকায় তুষার খাঁকে মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন স্থানীয় লোকজন। এরপর খবর পেয়ে বিজিবি ও বিএসএফের সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছান। কিন্তু তাৎক্ষণিক যুবকের পরিচয় নিশ্চিত না হওয়ায় তাকে কোনো পক্ষ উদ্ধার করেনি। পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর ওইদিন বিকাল ৪টার দিকে উদ্ধার করা হয়। ততক্ষণে তিনি মারা গেছেন।

ওই যুবকের মরদেহ উদ্ধারের সময় ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার কাজী তানভীর আবসাল সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার বিকাল পৌনে ৪টায় ঘটনাস্থলে এসে প্রাথমিক পরীক্ষা করে ওই যুবককে মৃত অবস্থায় দেখতে পান তিনি। ওই যুবকের শরীরে বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে।

ভারত সীমান্তবর্তী গ্রাম নারায়ণপুর দক্ষিণপাড়া জামে মসজিদের ইমাম মো. রমজান আলী জানান, বৃহস্পতিবার ভোরে এক ব্যক্তি মসজিদ থেকে ফজরের নামাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে সীমান্ত এলাকায় এই যুবককে বিবস্ত্র অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। পরে তিনি মসজিদে এসে একটি লুঙ্গি নিয়ে তাকে ঢেকে দেন এবং বিষয়টি স্থানীয়দের মাধ্যমে বিজিবিকে জানাতে বলেন।

স্থানীয়রা জানান, বৃহস্পতিবার সকালে ওই যুবককে বাংলাদেশ-ভারতের সীমানা খুঁটি থেকে প্রায় ১০ ফুট ভারতের অভ্যন্তরে জীবিত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন তারা। কিন্তু গুরুতর আহত ওই যুবক কোনো কথা বলতে পারছিলেন না। তার শ্বাসপ্রশ্বাস চলছিল। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে বিজিবির সদস্যরা আসেন এবং ভারতের অভ্যন্তরে আহত অবস্থায় পড়ে থাকায় বিএসএফের সঙ্গে এ নিয়ে দফায় দফায় কথা বলেন ও পতাকা বৈঠক করেন।

তারা আরও জানান, ওই সময় বিজিবি বলছিল যুবকটি ভারতের নাগরিক; আর বিএসএফ বলছিল তিনি বাংলাদেশের নাগরিক। শেষে বৃহস্পতিবার দুপুরে তার ফুফু আসমা বেগম ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিচয় নিশ্চিত করেন।

এ বিষয়ে আসমা বেগম বলেন, তার স্বামী অসুস্থ হয়ে কুমিল্লা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এজন্য তার ভাইয়ের ছেলে তুষার খাঁ তাকে দেখতে বুধবার সকালে কুমিল্লা সদর হাসপাতালে আসেন। সেখান থেকে ওইদিন সকাল ১০টায় তুষারকে শশীদল এলাকায় বাড়ি পাঠিয়ে দেন।

ওইদিন দুপুরের পর থেকে তুষারের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি এবং বৃহস্পতিবার দুপুরে ফেইসবুকে ছবি দেখে তিনি ঘটনাস্থলে এসে তুষারকে শনাক্ত করেন বলে জানান।

আসমা বেগম বলেন, “সময়মতো উদ্ধার করা হলে ছেলেটি বেঁচে যেত। সে অনেক কষ্ট পেয়ে মরেছে। সীমান্তের ওপারে কীভাবে তুষারের লাশ পাওয়া গেল সেটাই বুঝতে পারছি না। আমি সরকারের কাছে ঘটনাটি তদন্ত করে প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটনের দাবি জানাচ্ছি।”

শুক্রবার বিজিবির শশীদল বিওপির কমান্ডার নায়েব সুবেদার আবদুল খালেক সাংবাদিদের বলেন, “আমরা বৃহস্পতিবার সকাল ৬টায় খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে অজ্ঞাতনামা যুবককে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখি। তবে ভারতের অভ্যন্তরে থাকায় এবং পরিচয় নিশ্চিত না হওয়ায় যথাসময়ে তাকে বাংলাদেশে আনা যায়নি। এরপরও আহত ব্যক্তির চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য বিএসএফকে একাধিকবার বলেছি।”

তার ভাষ্য, ভারতীয় সীমান্তে থাকায় আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ওই যুবককে বিএসএফ তাদের দেশে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার কথা। কিন্তু তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

আবদুল খালেক আরও বলেন, দুপুরের পর অজ্ঞাতনামা যুবকের পরিচয় জানতে পেরে তারা স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পুলিশকে খবর দেন। খবর পেয়ে পুলিশ ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে এসে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে সন্ধ্যায় পতাকা বৈঠক শেষে মরদেহ বুঝে নিয়ে রাতে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।