এখনও অরক্ষিত সিলেটের ‘লালমাটিয়া বধ্যভূমি’

সিলেট গণপূর্ত বিভাগ বলছে, ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত জটিলতার কারণে বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের কাজ আটকে আছে।

বাপ্পা মৈত্রসিলেট প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 March 2023, 05:22 PM
Updated : 17 March 2023, 05:22 PM

স্বাধীনতার ৫২ বছরেও সিলেটের লালমাটিয়া বধ্যভূমিটি অরক্ষিত পড়ে আছে; যাকে জেলার সবচেয়ে বড় গণহত্যার স্থান বলছেন মুক্তিযোদ্ধারা।  

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার লালমাটিয়াতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছিল।

যেখানে প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিকামী বাঙালিদের ধরে নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাত। পরে গর্ত খুঁড়ে মৃত ও গুলিবিদ্ধ মানুষদের মাটিচাপা দেওয়া হত।

কিন্তু স্বাধীনতার ৫২ বছরেও এ বধ্যভূমি সংরক্ষণ এবং এখানে মাটিচাপা দেওয়া শহীদদের তালিকা হয়নি। 

সিলেট গণপূর্ত বিভাগের এক কর্মকর্তার দাবি, ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত জটিলতার কারণে তিন বছর ধরে বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের কাজ আটকে আছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রেললাইনের পাশে লালমাটিয়া বধ্যভূমি এলাকাটুকু চিহ্নিতও করা হয়নি। নেই কোনো নামফলক, স্থানটিতে গড়ে উঠেছে আগাছা।

দক্ষিণ সুরমা উপজেলার গোটাটিকর এলাকার পাঠানপাড়ার বাসিন্দা মো. খুরশিদ আলী একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন ২৩ বছরের যুবক।

তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একদিন কৃষি জমিতে লাঙ্গল চালাচ্ছিলেন তিনি। এ অবস্থায় বন্দুক দেখিয়ে তাকে ধরে নিয়ে যান পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা।

পরে পাকিস্তানিরা সেখানের সড়কের পশ্চিম পাশের মাটিতে লম্বা করে গর্ত খুঁড়ে লাশ মাটি চাপা দিতে বলেন তাকে। তিনি একটি গর্ত খুঁড়ে লাশ মাটিচাপা দিতে বাধ্য হন।

এমন ৫০-৬০টি গর্তে পাকিস্তানি বাহিনী মানুষকে মাটিচাপা দিয়েছিল বলে তার দাবি।  

একই এলাকার ষাটঘরের বাসিন্দা মো. লাল মিয়া।

তার ভাষ্য, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জমিতে লাঙ্গল চালানো অবস্থা থেকে ভয় দেখিয়ে ধরে নিয়ে তাকে দিয়ে গর্ত করিয়ে লাশ মাটিতে চাপা দিতে বলে পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা।

এভাবে তিনদিন তাকে দিয়ে মাটিতে গর্ত খুঁড়িয়ে প্রায় ৩০-৪০টি লাশ মাটিচাপা দেওয়ানো হয় বলে দাবি লাল মিয়ার।

তিনি আরও জানান, এখানে পাকিস্তানি সেনাদের ছয়টি বাংকার ছিল। গুলি খেয়ে মারা না গেলেও কোনো কোনো মানুষকে মাটিচাপা দিতে হতো।

তার ভাষ্য, লাল রংয়ের (উইলসন) জিপগাড়ি দিয়ে মানুষদের ধরে আনা হতো। প্রতিদিন কয়েকবার করে মানুষদের ধরে আনত পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারা হতো। তারপর এলাকার কাউকে না কাউকে বন্দুক দেখিয়ে নিয়ে এসে মাটিতে গর্ত করিয়ে লাশগুলো চাপা দেওয়া হতো।

“এ ছাড়া পাকবাহিনী গোটাটিকর এলাকার এক হিন্দু বাড়িতে ঢুকে বীরেন্দ্র, নরেন্দ্র ও হরেন্দ্রকে গুলি করেন। এতে হরেন্দ্র ছাড়া বাকি দুজন মারা যান।”

স্বাধীনতার এত বছর পরও বধ্যভূমি এলাকায় কোনো শহীদ মুক্তিযোদ্ধা না থাকা এবং এলাকাটি অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকায় আক্ষেপ করেন লাল মিয়া।    

তার ছোট ভাই হারুন মিয়া জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ৯-১০ বছরের। যুদ্ধ চলাকালে ক্যাম্পে গুলির শব্দ শুনে তিনি বুঝতেন, মানুষ মারা হচ্ছে। বাঙালিদের ধরে ধরে গাড়িতে করে ওই ক্যাম্পে নিয়ে আসার দৃশ্য তাদের বাড়ি থেকে দেখা যেত। তারপর শোনা যেত গুলির শব্দ।

“গুলির শব্দ শুনে মানুষ মারার হিসাব রাখতেন পরিবারের লোকজন।” 

ষাটঘরের আবু তালেব যুদ্ধের সময় ২২ বছরের যুবক ছিলেন।

তিনি জানান, লালমাটিয়ায় পাকিস্তানিরা যেখানে ক্যাম্প করেছিল সেখানে তিনি তিনজন নারী লাশও দেখেছেন। এ ছাড়া পুঁতে রাখা লাশ গর্ত থেকে টেনেহিঁচড়ে কুকুর-শিয়ালে খাওয়ার দৃশ্যও দেখার দাবি তার।

সিলেট জেলা মুক্তিযুদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার সুব্রত চক্রবর্তী জুয়েল বলেন, “সিলেটের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি দক্ষিণ সুরমার লালমাটিয়া। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে লালমাটিয়া বধ্যভূমি সংরক্ষণ প্রকল্পের কাজটি আটকে আছে। প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সারি-সারি গণকবরে চাপা দেওয়া হয়েছিল মরদেহ। অনেকের মরদেহ ফেলে দেওয়া হয়েছিল সড়কের বাম পাশের কচুরিপানা ভর্তি ডোবায়।”

তিনি আরও বলেন, “দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ বধ্যভূমিতে মিলেছিল মানুষের কংকাল, মাথার খুলি ও হাড়।”

সিলেটের সব বধ্যভূমি চিহ্নিত করে যথাযথ মর্যাদায় সংরক্ষণ করার দাবি জানান তিনি।

লালমাটিয়া বধ্যভূমিতে নিহতদের সংখ্যা খোঁজে বের করতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক অপূর্ব শর্মা।

তার ভাষ্য, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রতিদিন সিলেটের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষজনকে ধরে এনে হত্যা করে লাশ মাটি চাপা দেয়।

এখানে স্বাধীনতার পক্ষের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার দুই হাজারের অধিক মানুষকে হত্যা করে গণকবর দেওয়া হয়েছে দাবি করে অপূর্ব শর্মা বলেন, “স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে লালমাটিয়ায় ৫০টিরও অধিক গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। এক-একটি কবরে দুই থেকে তিন ডজন পর্যন্ত মানুষের কংকাল পাওয়া গিয়েছিল। সংখ্যা নিয়ে গবেষণাটি চলমান রয়েছে।”   

তিনি আরও জানান, ১৯৭২ সালে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ বধ্যভূমিটি পরিদর্শন করেন। তাছাড়া বিবিসির সংবাদদাতা স্থানটি পরিদর্শন করে একটি সংবাদ পরিবেশন করেছিলেন, যার সূত্র ধরে বাংলাদেশ অবজারভারের ১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে পাঁচ হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়; যদিও এ সংখ্যা নিয়ে মতপার্থক্য আছে।

সিলেট গণপূর্ত বিভাগ জানায়, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় ১৯৭১ সালের বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিসৌধ নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় জেলার পাঁচটি বধ্যভূমিতে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর টেন্ডার আহ্বান করে। একই বছরের ডিসেম্বর কার্যাদেশ দেওয়া হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। বর্তমানে চারটি বধ্যভূমির কাজ শেষ।

এ প্রকল্পের অধীনে লালমাটিয়া বধ্যভূমিতে ১১ শতাংশ জায়গার অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও ৬৪ লাখ ৮২ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করার কথা রয়েছে। কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত জটিলতার কারণে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজ আটকে আছে। যেখানে নির্মাণ কাজটি বাস্তবায়ন হবে ওই জায়গটি রেলওয়ের।

সিলেট গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রিপন কুমার রায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ভূমি সংক্রান্ত জটিলতার কারণে তিন বছর ধরে লালমাটিয়া বধ্যভূমির কাজটি করা যাচ্ছে না। ওই জমিটি রেলওয়ের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় অধিগ্রহণ করার পর কাজ শুরু হবে।