“কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও গাফিলতির কারণে এই ঘটনা ঘটেছে। বিচার চাই।”
Published : 06 Nov 2024, 07:08 PM
ময়মনসিংহ নগরীর রহমতপুর বাইপাস মোড়ে আজহার ফিলিং স্টেশনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ তোফাজ্জল হোসেন নামে আরেকজনের মৃত্যু হয়েছে।
বুধবার বেলা ১২টার দিকে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তোফাজ্জল হোসেনের মৃত্যু হয়।
তোফাজ্জল নগরের নিজকল্পা গ্রামের আবদুস সালামের ছেলে। আজহার ফিলিং স্টেশনে ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি ছিলেন।
তোফাজ্জলকে নিয়ে মৃতের সংখ্যা চার জনে দাঁড়াল। এ ঘটনায় ফিলিং স্টেশনের মালিক আজহারুল ইসলামসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
এদিকে পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পাগল প্রায় নিহতের স্বজনরা। দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত লরি থেকে এখনও গ্যাস বের হওয়ায় ফিলিং স্টেশনের সামনের সড়ক দিয়ে যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
এর আগে ৪ নভেম্বর দুপুরে আজাহার সিএনজি ও পেট্রোলিয়াম ফিলিং অ্যান্ড কনভারশন সেন্টারে এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
ঘটনাস্থলে প্রাইভেটকার চালক হিমেল মুন্সি (২৯) এবং হাসাপতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আবদুল কদ্দুস (৮৫) ও আবুল হোসেন (৪৫) মারা যান।
বর্তমানে দগ্ধ দুজন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। আরও তিনজন আশঙ্কাজনক অবস্থায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
বুধবার দুপুরে নিহত প্রাইভেটকারের চালক হিমেলের মা ইয়াসমিন ওরফে হেনা বাদী হয়ে আজহার ফিলিং স্টেশনের মালিক আজহারুল ইসলামসহ ছয়জনকে আসামি করে কোতোয়ালি থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে মামলা দায়ের করেন।
এ তথ্য জানিয়ে ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি মো. সফিকুল ইসলাম বলেন, “ঘটনার পর থেকে পাম্পের মালিক আজাহারুল ইসলাম পলাতক রয়েছেন। এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত দুজনের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। অপর একজনের মরদেহ স্বজনেরা ময়নাতদন্ত ছাড়াই বাড়িতে নিয়ে দাফন করেছে।”
তিনি বলেন, “নিরাপত্তার স্বার্থে ফিলিং স্টেশনের আশপাশ ঘিরে এখনও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর নজরদারি রয়েছে। এতে কিছুটা যান চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। পরিস্থিতি ভালো মনে হলে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে নিরাপত্তা শিথিল করা হবে।”
ঘটনার বর্ণনায় ময়মনসিংহের তিতাস গ্যাসের উপ-মহাব্যবস্থাপক সুরঞ্জিত কুমার দে বলেন, “গত সোমবার ঢাকা থেকে আনা একটি এলপিজি গ্যাসের ট্যাঙ্ক লরি থেকে গ্যাস নামানো হচ্ছিল। এর খানিকটা দূরেই একটি প্রাইভেটকারে গ্যাস ভরা হচ্ছিল।
“এ সময় গ্যাস লিকেজ থেকে হঠাৎ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের সাতটি ইউনিট দুই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। কিন্তু ততক্ষণে সাতটি গাড়ি ভস্মিভূত হয়; ক্ষতিগ্রস্ত হয় তিনটি দোকান।”
অথৈ সাগরে নিহতদের পরিবার:
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দগ্ধ হয়ে নিহত চারজনের পরিবারেই অসচ্ছল। তাদের আয়ে চলতো সংসারের খরচ। এখনও পর্যন্ত তারা কোনো সহযোগিতা পাননি।
তাদের একজন প্রাইভেটকার চালক নগরীর কিসমত গ্রামের জামাল উদ্দিনের ছেলে হিমেল মুন্সী। দুর্ঘটনার সময় প্রাইভেটকারটি নিরাপদ স্থানে নিতে গিয়ে প্রাইভেটকারের ভেতরেই দগ্ধ হয়ে অঙ্গার হয়ে যান তিনি।
দশ বছর বয়সী একটি মেয়েসহ স্ত্রী, মা ও ছোট ভাইয়ের সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন হিমেল।
তার মামা সাজ্জাদ হোসেন খান মিলন বলেন, “সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও গাফিলতির কারণে এই ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় দায়ীদের বিচার চাই, পাশাপাশি সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।”
নিহত আবদুল কদ্দুস বৃদ্ধ বয়সেও জীবিকার জন্য ভাঙারি কুড়িয়ে ও মানুষের কাছ হাত পেতে চলতেন। ঘটনার সময় তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে হোটেলে ভাত খেয়ে ফিলিং স্টেশনের পাশের একটি দোকানে চা খাচ্ছিলেন।
তখন হঠাৎ অগ্নিকাণ্ডে তার শরীরের আগুন ধরে গেলে দৌঁড়ে আগুন নিভিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেন। পরে খবর পেয়ে তার স্বজনরা দগ্ধ অবস্থায় তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।– কথাগুলো বলছিলেন কদ্দুসের মেয়ে ময়না আক্তার।
ময়না বলেন, “আমার বাবা বাঁচার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পারেনি। আমি তার মৃত্যুর জন্য জড়িতদের বিচার চাই।”
নগরীর ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের হারগুজিরপাড় এলাকার বাসিন্দা নিহত আবুল হোসেন ফিলিং স্টেশন সংলগ্ন মুদি দোকানি ছিলেন।
আবুলের ছোট ভাই মিয়া হোসেন বলেন, “আমার ভাই তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। তার মৃত্যুতে পুরো পরিবার ভেঙে পড়েছে। এখন কে তার পরিবারকে দেখবে। সবাই সান্ত্বনা দিতে আসলেও কেউ দায়িত্ব নিচ্ছে না। পরিবারটি যেন চলতে সেই ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানাচ্ছি।”
চলাচলে নিষেধাজ্ঞা:
দুর্ঘটনা কবলিত ফিলিং স্টেশনের এলপিজির ট্রাঙ্কলড়ি থেকে এখনও গ্যাস নির্গত হওয়ায় পুরো এলাকাটি আইন শৃংখলা বাহিনী নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। ফলে ওই সড়কে জনসাধারণসহ সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
এরইমধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ফিলিং স্টেশনের ৫০০ মিটার এলাকায় যানবাহন ও মানুষের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে সোমবার রাতে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে।
বর্তমানে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সংশ্লিষ্ট সড়কের দুই পাশে ব্যারিকেট দিয়ে সর্তক অবস্থানে রয়েছে বলে ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি মো. সফিকুল ইসলাম জানান।
যা বলছে জেলা প্রশাসন:
ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলম বলেন, “আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এখানে এক ধরনের গাফিলতি রয়েছে। এ কারণেই জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
“আগামী তিন কর্মদিবস পর কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এতে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা হবে।”
তিতাস কর্তৃপক্ষের বক্তব্য:
ময়মনসিংহের তিতাস গ্যাসের উপ-মহাব্যবস্থাপক সুরঞ্জিত কুমার দে বলেন, “দুর্ঘটনা কবলিত এলাকা দুই দফা পরিদর্শন করেছি। দুর্ঘটনা সংক্রান্ত আমাদের একটি স্থায়ী কমিটি রয়েছে। আমরা সেই আলোকে প্রতিবেদন দিব।”
ফিলিং স্টেশনটিতে তিতাস গ্যাস ছাড়াও এলপিজি ও পেট্রোলিয়াম ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “দুর্ঘটনার জন্য ফিলিং স্টেশন কর্তৃপক্ষ কোন ভাবেই দায় এড়াতে পারে না।”