৫ অগাস্টের আগে প্রতিমাসে গড়ে ১৫ কোটি টাকার রাজস্ব আয় হত’ এখন হচ্ছে তিন কোটি টাকার মত।
Published : 02 Feb 2025, 01:15 AM
বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকে ভারতের ভিসা জটিলতায় বেনাপোল দিয়ে যাত্রী পারাপার কমে এসেছে; যার প্রভাব পড়ছে সরকারের রাজস্ব আয়ে।
সাধারণ সময়ে প্রতিদিন যেখানে সাত থেকে আট হাজার যাত্রী পারাপার হতেন, এখন তা নেমে গেছে ৮০০ থেকে এক হাজারে।
এখন যারা পারাপার বা ভারতে ভ্রমণ করছেন; তাদের অধিকাংশের ভিসাই আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে থেকে ইস্যু করা। এদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে এই স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে যাতায়াত আরও কমে আসবে বলে কর্তৃপক্ষের ধারণা।
বেনাপোল কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছে, বছরে এ বন্দরে ‘ভ্রমণ কর’ থেকে রাজস্ব আদায় হয় গড়ে ১৮২ কোটি টাকা। গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে প্রতিমাসে গড়ে ১৫ কোটি টাকার রাজস্ব আয় হত। বর্তমানে সেই রাজস্ব আদায় হচ্ছে মাসে তিন কোটি টাকার মত। অর্থাৎ, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় এক পঞ্চমাংশ।
শুক্রবার বেনাপোল স্থলবন্দরে গিয়ে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট এলাকা এখন কোলাহলমুক্ত, নেই যাত্রীচাপ। কাজের খুব বেশি তাড়া নেই কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। যাত্রী কম থাকায় পরিবহন শ্রমিকদেরও হাঁকডাকও কম। বেনাপোলের কর্মব্যস্ততায় কোথায় যেন একটা ফাঁক পড়ে আছে।
বেনাপোল স্থলবন্দরের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারত সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করায় দুই দেশের মধ্যে যাত্রী পারাপার কমেছে। আগে প্রতিদিন যেখানে সাত থেকে আট হাজার যাত্রী পারপার হত, এখন সেখানে প্রতিদিন পারাপার হচ্ছে হাজারখানেক যাত্রী।
ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, ২২ জানুয়ারি থেকে ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ভারতে গেছেন সাত হাজার ৫৭৯ জন। আর ভারত থেকে এসেছেন সাত হাজার ৪৩৯ জন। আট দিনে পারাপার হয়েছেন মোট ১৫ হাজার ১৮ জন যাত্রী।
হজ, ওমরাহ এবং ক্যানসারের চিকিৎসা ছাড়া অন্য যে কোনো কাজে দেশের সীমানা পার হতে ‘ভ্রমণ কর’ পরিশোধ বাধ্যতামূলক। ফলে কোনো কারণে ভ্রমণ কমলে এ খাত থেকে সরকারের আয় কমে।
যাত্রী পারাপার কমে যাওয়ায় ‘ভ্রমণ কর’ বাবদ রাজস্ব আদায়ও কমে যাচ্ছে। ৫ অগাস্টের পর থেকে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
তারিখ |
মোট পারাপার (জন) |
ভারতে গেছেন (জন) |
এসেছেন (জন) |
২২ জানুয়ারি |
১৮২৪ |
৯৭৩ |
৮৫১ |
২৩ জানুয়ারি |
১৮২৮ |
৯৩৭ |
৮৯১ |
২৪ জানুয়ারি |
১৮৪৭ |
৯৫৪ |
৮৯৩ |
২৫ জানুয়ারি |
১৫১৩ |
৬৬৮ |
৮৪৫ |
২৬ জানুয়ারি |
১৮১১ |
৮৭০ |
৯৪১ |
২৭ জানুয়ারি |
১৯৭১ |
১০৭৪ |
৮৯৭ |
২৮ জানুয়ারি |
১৯৪৩ |
৯৮২ |
৮৯৭ |
২৯ জানুয়ারি |
২২৮১ |
১১২১ |
১০৬০ |
তথ্যসূত্র: বেনাপোল ইমিগ্রেশন
বেনাপোল আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট ইমিগ্রেশন ওসি ইমতিয়াজ মো. আহসানুল কাদের ভূঁইয়া বলেন, বাংলাদেশ থেকে যারা ভারতে যায়, কেবল সেই সব যাত্রী ‘ভ্রমণ কর’ বাবদ এক হাজার টাকা এবং ‘প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল’ ফি বাবদ ৫৫ টাকা দেন। ফেরত আসা যাত্রীরা এই করের আওতামুক্ত।
“স্বাভাবিক সময়ে বেনাপোল দিয়ে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার যাত্রী ভারতে যেত। এখন সেটা কমে গড়ে ৮০০ থেকে এক হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে।”
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গত বছরের শেষ নাগাদ বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ভিসা সীমিত করে ভারত। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অনেক দেশের ভিসা সেন্টার ভারতে থাকায় সেসব দেশের ভিসা প্রাপ্তিতে দেখা দিয়েছে জটিলতা।
এতে বাংলাদেশ থেকে বিদেশ ভ্রমণের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। যার প্রভাবে ধাক্কা লেগেছে সরকারের রাজস্ব আয়ের অন্যতম খাত ‘ভ্রমণকর’ সংগ্রহে।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি মো. রফিউজ্জামান বলেন, “বাংলাদেশিদের বিদেশ ভ্রমণ কমে গেছে মূলত ভিসা প্রাপ্তি জটিল হওয়ার কারণে। বর্তমানে ভারত ভিসা দিচ্ছে না। গত কয়েক মাসে যারা ভারত ভ্রমণ করেছেন, তাদের বেশির ভাগের ভিসাই আগে ইস্যু করা।
“বর্তমানে ভারতের ভিসা সীমিত থাকায় সামনের দিনগুলোয় বাংলাদেশি পর্যটকের বিদেশযাত্রা আরও কমবে। যার প্রভাব পড়েছে সরকারের ভ্রমণকর আদায়ের ক্ষেত্রে।”
ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ায় ফরিদপুরের রনধীর সাহা, ঢাকার রমেশ শীল শুক্রবার ভারত থেকে ফিরেছেন।
রনধীর সাহা বলেন, “ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছিল তাই তড়িঘড়ি করে ভারতে আত্নীয়-স্বজনদের সঙ্গে একটু দেখা করে আসলাম। তাদের সঙ্গে দেখাও হল আবার একটু বেড়ানোও হল।”
রমেশ শীল বলেন, “ভিসার মেয়াদ এ মাসেই শেষ। তাই ভারতে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলাম। তাড়াহুড়ো করে ফিরে আসতে হল।”
বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে বাংলাদেশে এসেছেন ভারতীয় নাগরিক আবুল কাশেম।
বেনাপোল চেকপোস্টে আবুল কাশেম বলেন, “অন্য সময় বেনাপোল চেকপোস্টে খুব ভিড় থাকত। এবার কোনো যাত্রীর ভিড় নেই। আল্লার রাস্তায় যাচ্ছি খুব ভালো লাগছে।”
বাংলাদেশ-ভারত চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক মতিয়ার রহমান বলেন, ভিসা কেন্দ্রগুলো এখন কেবল জরুরি মেডিকেল ও স্টুডেন্ট ভিসার জন্য সীমিত পরিসরে স্লট দিচ্ছে। ব্যবসা ও ভ্রমণ ভিসার যাত্রীদের সংখ্যা নেই বললেই চলে।
“ভিসা বন্ধ থাকায় বেকায়দায় পড়েছেন তারা। ভারত সরকার ব্যবসা (বিজনেস) ভিসা না দেওয়ায় বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি- রপ্তানি বাণিজ্যেও প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
ইমিগ্রেশন ওসি বলেন, “ভিসা জটিলতা না কাটলে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে যাত্রী পারাপার শূন্যের কোটায় এসে দাঁড়াবে। এখন যারা যাতায়াত করছে এদের অধিকাংশের ভিসার মেয়াদ শেষের দিকে।”