চার দিন চার রাত যমুনা নদীর উজান ধরে নৌকায় যাত্রা করে অবশেষে তারা পৌঁছান ভারতের মানিকার চর শরণার্থী শিবিরে।
Published : 16 Dec 2024, 08:20 PM
মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হল, সুশীল কুমার সাহা তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ এড়াতে বাংলাদেশের লাখো মানুষের মত তাকেও আশ্রয় নিতে হয়েছিল ভারতের শরণার্থী শিবিরে।
সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার যমুনা নদী বেষ্টিত হরিনাথপুর গ্রামের ক্ষিতিশ কুমার সাহার পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে সবার বড় সুশীল।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বসতবাড়ি ছেড়ে মা-বাবার সঙ্গে তিনিও চলে যান ভারতে। ছিলেন শরণার্থী শিবির ও আত্মীয়ের বাড়িতে।
আইন পেশায় জড়িত ৭০ বছর বয়সী সুশীল কুমার সাহার বর্তমান বাস সিরাজগঞ্জ শহরের মাছিুমপুর উকিলপাড়ায়। নিজের বাসার চেম্বারে বসেই পড়ন্ত বিকালে শরণার্থী জীবনের নানা দিক নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। পাশাপাশি যুদ্ধের ভয়াল দিনগুলোর স্মৃতির কথা বলেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে।
একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যাওয়ার পর তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা। প্রাণ বাঁচাতে বিভিন্ন পথে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করে লাখো মানুষ।
সুশীল কুমার সাহা বলেন, “১৯৭১ সালের ভয়াল সেই ২৫ মার্চের পর পাশের জেলা বগুড়ার ধুনট উপজেলা ক্যাম্পের পাকিস্তানি সেনারা প্রথম কাজিপুর উপজেলার হরিনাথপুর গ্রামে হামলা চালায়। ওই সময় গ্রামের বিপুল মানুষ লাঠিসোঁটা নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার প্রতিহত করা চেষ্টা করে। প্রচুর লোকসমাগম ও এলাকাটি যমুনা নদী বেষ্টিত হওয়ায় পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়s।
“এরপর প্রাণভয়ে পরিবারের সবাই তিন মাইল দূরের চালিতাডাঙ্গা গ্রামে মামার বাড়িতে আশ্রয় নিই।”
সুশীল বলেন, ওই এলাকাও ক্রমশ অনিরাপদ হয়ে ওঠে। সেখানে এক মাস থাকার পর ভারতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
“এপ্রিলের শুরুতে বড় একটি নৌকায় মামা ও আমাদের পরিবারসহ মোট তিনটি পরিবারের নারী-পুরুষ ও শিশু ভারতে রওনা হই।”
রান্না, খাওয়া ও ঘুম সবই চলত নৌকায়। পুরুষরা প্রাকৃতিক কাজ নৌকার এক পাশেই সারতেন। নারীদের জন্য নৌকা ভেড়ানো হত নদীতীরের ঝাউ ও কাশবনে।
এভাবেই যমুনা নদীর উজান বেয়ে ভারতের মানিকার চরের দিকে নৌকাটি এগোতে থাকে।
রাতের বেলায় উত্তরের জেলা গাইবান্দার ফুলছড়ি ঘাটে পৌঁছার আগেই তারা দেখতে পান, পাকিস্তানি সেনারা সেখানে ঘাঁটি করেছে। তারা সার্চলাইট দিয়ে নৌকায় কোনো বাঙালি ভারতের দিকে যাচ্ছে কি-না তার ওপর নজর রাখছেন।
এ অবস্থায় মাঝি তাদের নৌকাটি ঝাউবনের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। সুযোগ বুঝে আবারো নৌকা ছাড়া হয়। গন্তব্য ভারতের উত্তর আসামের মানিকার চর।
সুশীলের দাবি, গন্তব্যে পৌঁছার অন্তত তিন মাইল আগ থেকে তারা দেখতে পান, লাশের পর লাশ নদীতে ভেসে আসছে। ধারণা করা হয়, পাকিস্তানি সেনারা এদের হত্যা করে লাশগুলো নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে। এরপরও তাদের মাঝি সতর্কতার সঙ্গে নৌকা চালাতে থাকেন। এভাবে নদীপথে কেটে যায় চার দিন ও চার রাত। অবশেষে তারা পৌঁছান মানিকার চর।
সুশীল কুমার সাহা বলেন, মানিকার চরের অস্থায়ী শরণার্থী শিবিরেই তাদের সবার আশ্রয় হয়। সেখানে আগে থেকেই দুই হাজারের মত শরণার্থী অবস্থান করছিলেন।
ভারত সরকারের পক্ষ থেকে শরণার্থী শিবিরে থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হত। সবাইকে কার্ডের আওতায় এনে জীবন-যাপনের জন্য পরিবার প্রতি কিছু ভাতা (নগদ টাকা) দেওয়া হত।
তবে শরণার্থী শিবিরে খাওয়ার পানি ছিল খুবই খারাপ। যা খেয়ে অনেকেই কলেরায় আক্রান্ত হত। কেউ কেউ সেখানে মারাও গেছেন।
ওই শিবিরে থাকার সময় পাশেই মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটিং ক্যাম্পে গিয়েছিলেন সুশীল কুমার সাহা।
তিনি বলেন, “মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে গিয়ে একজন লুঙ্গি পড়া বয়স্ক ব্যক্তির দেখা পাই। তাকে বলি, আমি দেশের জন্য যুদ্ধ করতে চাই। তখন ওই ব্যক্তি বলেন, ‘তোমরা ছোট মানুষ, তোমরা ফিরে যাও, আমরা যদি মরে যাই, তখন তোমরা যুদ্ধ করিও’।”
সুশীল বলেন, “শরণার্থী শিবিরে আমরা এক মাস ছিলাম। পরে মামার ও আমাদের পরিবারের সবাই ট্রেনে করে ভারতের শিলিগুড়ির দাজিংলিয়ের কাছে এক নিকট আত্মীয়ের বাসায় চলে যাই। বাকিটা সময় সেখানেই কেটেছে।
“ভারতে থাকাকালে শরণার্থী কার্ড দেখালে ট্রেনে যাতায়াতে ভাড়া লাগত না। আমরা মাঝে-মধ্যে আসাম পর্যন্ত বিনা ভাড়ায় ঘোরাফেরা করেছি।”
১৬ ডিসেম্বর প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সংবাদ ভারতে বসেই পান তারা।
এ সংবাদে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান পরিবারের সবাই। এক বুক আশা নিয়ে প্রিয় মাতৃভূমিতে ফেরার অপেক্ষায় থাকেন তারা।
পরের বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, পরিস্থিতি অনুকূলে রয়েছে, শরণার্থীরা স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে যেতে পারেন, আপনাদের সবার জন্য স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা রয়েছে।
এরপর এক সকালে ভারতের জলপাইগুড়ি জংশন থেকে ট্রেনে করে আরো অনেকের সঙ্গে স্বাধীন দেশের পথে রওনা হন সুশীলরা।
তিনি বলেন, “পথে একটি স্টেশনে আমাদের ট্রেন থামিয়ে রেখে পাকিস্তানগামী একটি ট্রেনকে যেতে দেওয়া হয়। ওই ট্রেনে প্রচুর পাকিস্তানি সেনা ছিল। তবে তাদের সবার মাথা ন্যাড়া ছিল। জানতে পারি, নিরাপত্তার খাতিরে চিহ্নিত করার জন্য তাদের মাথা ন্যাড়া করা হয়েছিল।”
এই আইনজীবী বলেন, “আমাদের বহনকারী ট্রেন রাতে বগুড়ার সান্তাহার রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছায়। আমরা সবাই রাতে নির্জন ওই স্টেশনের প্ল্যাটফর্মেই ছিলাম। ভোরে আরেকটি ট্রেনে বগুড়া সদরে পৌঁছলাম। সেখান থেকে ছোট একটি যানবাহনে বগুড়ার শেরপুর যাই।”
সেখান থেকে গরুর গাড়িতে করে গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের কাজিপুরে পৌঁছান তারা।
সেদিনের কথা স্মরণ করে সুশীল বলেন, “আমরা বাড়িতে পৌঁছে দেখতে পাই, বসতঘরগুলোর শুধু চালা আছে। বেড়া, আসবাবপত্র ও প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই নেই। নদী বেষ্টিত হওয়ায় পাকিস্তানি সেনারা আমাদের গ্রামে হামলা বা হত্যাযজ্ঞ চালাতে পারেনি। যুদ্ধের সময়েও কিছু মানুষ গ্রামেই ছিলেন। তারা আমাদের বাড়ির কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিজেদের হেফাজতে রেখে দিয়েছিলেন। সেই সব আমাদের ফিরে দেন এবং বর্গাচাষিরা আমাদের জমির ফসলের ভাগের অংশ দিয়ে যান। ওই সব দিয়েই আমাদের পরিবারের সদস্যদের জীবনযাপন শুরু হয়।”
স্বাধীনতার পর প্রথম ছয় মাস গ্রামের যুবকদের নিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে নানা সেবামূলক কর্মকাণ্ড করতেন সুশীল কুমার সাহা।
সেসব দিনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, “যুদ্ধ জয়ের পর গ্রামের কোনো কিছুই স্বাভাবিক ছিল না। তাই গ্রামের তরুণ-যুবকরা মিলে খেলাধুলা ও অড্ডা বাদ দিয়ে সেবামূলক কার্যক্রমে যোগ দিই। আবাসন, খাদ্য, অসুস্থতাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াই। তবে ছয় মাসের ব্যবধানে এলাকার আবাদির জমির ফসল ঘরে উঠার পর গ্রামের সবার জীবন-যাপন স্বাভাবিক হতে শুরু করে।”
স্বাধীন দেশে আবারো শিক্ষাজীবন শুরু করেন সুশীল কুমার সাহা। ১৯৭২ সালে সরকার তিনটি বিষয়ে (বাংলা, ইংরেজি ও অংক) ৩০০ মার্কের পরীক্ষা কার্যক্রম চালু করে সেই পরীক্ষায় অংশ নিয়ে এসএসসি পাস করেন তিনি। এরপর কাজীপুর কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন।
সেখান থেকে আইন পাস করে ১৯৮২ সালে সিরাজগঞ্জ আদালতে আইন পেশায় যোগ দেন সুশীল। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সিরাজগঞ্জ আদালতে জিপির দায়িত্ব পালন করেছেন এই আইনজীবী। পাশাপাশি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র সিরাজগঞ্জের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
ব্যক্তি জীবনে এক সন্তানের জনক সুশীলের স্ত্রী ফেরদৌসী বেগম পারুল শিক্ষকতা করতেন। বর্তমানে লালমনিরহাটের হাতিবান্দা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন।
একমাত্র ছেলে প্রকৌশলী রাজিব ফেরদৌস ঢাকার মিরপুরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।