নদী ভাঙন: নড়িয়ায় গৃহহীনদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেই

২০১৮ সালের ভাঙনে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার পরিবার গৃহহীন হয়।

কে এম রায়হান কবীরশরীয়তপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Nov 2022, 09:43 AM
Updated : 29 Nov 2022, 09:43 AM

তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের পর শরীয়তপুরের নড়িয়ায় পদ্মার ভাঙন থামলেও আগের ভাঙনে গৃহহীন পরিবারগুলোর জীবন কাটাছে কষ্টে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অন্তত তিন হাজার পরিবার খুপড়ি ঘরে বাস করছেন। চার বছরেও তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

নড়িয়া উপজেলার মোক্তারের চর, নড়িয়া পৌরসভা, কেদারপুর, ঘড়িসার, চরআত্রা ও নওপাড়া ইউনিয়ন পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত। ২০১৫ সাল থেকে এ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা পদ্মার ভয়াবহ ভাঙনের কবলে পড়ে। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ভাঙনে অন্তত ১০ হাজার ৬০০ পরিবার ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়।

এর মধ্যে ২০১৮ সালের ভাঙন ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। ওই বছর গৃহহীন হয়ে পড়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার পরিবার। পদ্মায় বিলীন হয় তিনটি বাজারের সাড়ে ৬০০ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মূল ভবনসহ তিনটি দ্বিতল ভবন।

শরীয়তপুর পানি উন্নয়র বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবিব জানান, পাউবো ২০১৯ সালে ভাঙন রোধে প্রকল্পের কাজ শুরু করে। ১ হাজার ৯৭ কোটি টাকায় ৮ কিলোমিটার পদ্মা নদীর ডান তীর রক্ষা বাঁধ ও ১১ কিলোমিটার এলাকা ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে চর খননের কাজ শুরু হয়।

ওই প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা। আর পদ্মা নদীর উত্তর তীরের চরআত্রা ও নওপাড়া এলাকায় ৫৫০ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০২০ সালে। নড়িয়া উপজেলা সদরে আরেকটি হাসপাতাল নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে, কিন্তু নানা অনিয়মের কারণে সেটির কাজও বর্তমানে বন্ধ।

সরেজমিনে দেখা যায়, নড়িয়ার বিভিন্ন সড়কের পাশে, ফসলি জমিতে ও বাগানে প্রায় তিন হাজার পরিবার জমি ভাড়া নিয়ে ছাপড়ায় ঘর বানিয়ে থাকছে।

এসব গৃহহীনরা জানান, ২০১৯ সালের পর নড়িয়ায় পদ্মার ভাঙন থেমেছে। কিন্তু ১০ হাজার ৬০০ পরিবারকে পুনর্বাসনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি স্থানীয় প্রশাসন। ভাঙনের শিকার অনেকেই এলাকা ছেড়ে গেছেন। কারও কারও ঠাঁই হয়েছে ঢাকার বিভিন্ন বস্তিতে।

আলামিন আকন ও সুফিয়া আক্তার আক্তার দম্পতি কেদারপুর ইউনিয়নের চর জুজিরা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তাদের ১৪০ শতাংশ ফসলি জমি ও ২০ শতাংশের বসতবাড়ি ছিল। কৃষিকাজ ও গবাদিপশুর খামার করে তাদের সংসার চলতো। ২০১৫-১৮ সাল পর্যন্ত তিন দফা নদী ভাঙনে তাদের ফসলি জমি ও বসতবাড়ি বিলীন হয়ে যায়। এরপর পরিবারটির ছয় সদস্য কেদারপুরের লস্কর বাড়ির বাগানে আশ্রয় নেন।

সুফিয়া আক্তার বলেন, “স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখেই ছিলাম। পদ্মার ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরছি। স্বামী মাটি কাটার শ্রমিক; আর আমি গ্রামে ঘুরে সেলাইয়ের কাজ করি। পরিবারের ছয়জনকে নিয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটচ্ছে।”

স্থানীয় মুলফতগঞ্জ বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কেদারপুরের বাসিন্দা মকবুল বাছারের ২০ শতাংশ জমিতে বাড়ি করেছিলেন। ২০১৯ সালের নদী ভাঙনে ব্যবসা-বাড়ি সবই পদ্মায় বিলীন হয়। পরে গ্রামের একটি বাগানে আশ্রয় নিয়ে হাটবাজারে ঝালমুড়ি বিক্রি করে পাঁচ সদস্যের পরিবারের হাল ধরেন বলে জানালেন মকবুল।

তিনি বলেন, “জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে এমন অসহায় হয়ে পড়ব, ভাবতেও পারিনি। কেউ আমাদের পাশে দাঁড়ায় না। আমাদের কথা ভাবে না। মরার পর একটু মাটিও মনে হয় পাব না।”

কেদারপুর ইউনিয়ন পরিয়দের চেয়ারম্যান মিহির চক্রবর্তী বলেন, তার ইউনিয়নের ১ নম্বর ও ২ নম্বর ওয়ার্ড পুরোপুরি এবং ৩ নম্বর ওয়ার্ডের আংশিক পদ্মা নদীর ভয়াবহ ভাঙনে বিলীন হয়েছে। লস্করদের বাগানে ৩০টি পরিাবারসহ তারা বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। সরকারি খাস জমি না থাকায় তাদের পুনর্বাসন করা যাচ্ছে না।

মোক্তারের চর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বাদশা শেখ বলেন, তার ইউনিয়নের ইশ্বরকাঠি, চেরাগআলী, বেপারী কান্দি ও শেহের আলী মাদবর কান্দি গ্রামের অধিকাংশ জায়গা-জমি পদ্মায় বিলীন হয়েছে।

সেখানে প্রায় সাড়ে ৫০০ পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। তারা বিভিন জায়গায় অন্যের জমিতে খুপড়ি ঘর করে কষ্ট করে বসবাস করছে।

তিনি বলেন, “সাবেক চেয়ারম্যানের আমলে ১৪৫টি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিলো। তার মধ্যে ৪৫ টি ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের দেওয়া হয়।”

নড়িয়া উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. আহাদী হোসেন বলেন, “নদী ভাঙনে গৃহহীন সাড়ে ৫ হাজার পরিবারকে পুনর্বাসনে করা সম্ভব না। যারা একেবারেই হতদরিদ্র, গরীব তাদেরকে টিন ও গৃহ নির্মাণের জন্য নগদ টাকা প্রদান করা হয়েছে।”

নড়িয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ রাশেদুজ্জামান জানান, নদী ভাঙনে যারা ভূমিহীন হয়েছে, তাদের যাছাই বাছাই করে টিন ও প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর দেওয়া হবে।

“তবে কত লোক ভাঙনে গৃহহীন হয়েছে, তা আমি এখন বলতে পারবো না।” যোগ করেন তিনি।