ভোটের মাঠে স্থানীয় দুই আওয়ামী লীগ নেতার কথা চালাচালিও নির্বাচনের আমেজ তৈরি করেছে ভোটারদের মধ্যে।
Published : 30 Apr 2024, 12:52 AM
এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নরসিংদীর পলাশে চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন তিন প্রার্থী; তবে ভোটের মাঠে আলোচনা বেশি দুইজনকে ঘিরে।
এই দুইজনের একজন টানা দুইবারের উপজেলা চেয়ারম্যান ও পলাশ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি সৈয়দ জাবেদ হোসেন। আরেকজন ঘোড়াশাল পৌরসভার দুইবারের মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি শরীফুল হক শরীফ, যিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলীপের শ্যালক।
স্থানীয় এ দুই আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে ভোটে রয়েছেন জাতীয় পার্টির সারোয়ার মোল্লা, যিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা জমিয়ে তুলতে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন।
ভোটের মাঠে জাবেদ ও শরীফুলের মধ্যে কথা চালাচালিও নির্বাচনের আমেজ তৈরি করেছে ভোটারদের মধ্যে।
আগামী ৮ মের প্রথম ধাপে অনুষ্ঠিত হবে পলাশ উপজেলা পরিষদের ভোট। এখানে চেয়ারম্যান পদে তিনজন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে তিনজন এবং নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে দুইজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
তিন চেয়ারম্যান প্রার্থীর মধ্যে সৈয়দ জাবেদ হোসেন (কাপ-পিরিচ), শরীফুল হক (দোয়াত কলম) এবং জাতীয় পার্টির সারোয়ার মোল্লা (লাঙ্গল) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
এ ছাড়া পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান পদে কারিউল্লাহ সরকার (বই), সাইফুল ইসলাম গাজী (চশমা) এবং এম এ কাইয়ুম (উড়োজাহাজ) লড়ছেন। আর নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে সেলিনা আক্তার (কলস) এবং নাসিমা সুলতানা লাকী (হাঁস) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রথম ধাপে দেড়শ উপজেলায় ভোট হবে আগামী ৮ মে। এই ধাপে নরসিংদী সদর ও পলাশ উপজেলা রয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে ২৩ মে বেলাব ও মনোহরদী উপজেলা, তৃতীয় ধাপে ২৯ মে রায়পুরা ও শিবপুর উপজেলায় ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
এক নজরে
>> চেয়ারম্যান পদে তিন প্রার্থীর পাশাপাশি সাধারণ ভাইস চেয়ারম্যান পদে তিনজন এবং সংরক্ষিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে দুজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
>> ঘোড়াশাল পৌরসভাসহ চার ইউনিয়নের এ উপজেলায় মোট ভোটার সংখ্যা এক লাখ ৮২ হাজার ৯৭২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৯২ হাজার ৯৮১ জন, নারী ভোটার ৮৯ হাজার ৯৯০ এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার একজন।
>> মোট ৬৩টি কেন্দ্রে ব্যালট পেপারের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ করবে নির্বাচন কমিশন।
>> চতুর্থ ও পঞ্চম উপজেলা চেয়ারম্যানের ভোটে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের সৈয়দ জাবেদ হোসেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার চেয়ারম্যান ছিলেন আওয়ামী লীগের ফারুকুল ইসলাম। প্রথমবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন জাতীয় পার্টির প্রফেসর ফজলুল হক।
এবার উপজেলা নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কোনো প্রার্থীকে দলীয় প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছে। সেইসঙ্গে ভোটে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের স্বজনদের প্রার্থী না হওয়ারও নির্দেশ দিয়েছে দলীয় প্রধান। এরপরও অনেক স্থানে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের স্বজনরা প্রার্থী হয়েছেন।
পলাশেও সংসদ সদস্যের শ্যালক শরীফুল প্রার্থী হয়েছেন। তিনি সংসদ সদস্য দিলীপের স্ত্রী আফরোজা দিলীপের বড় ভাই। আফরোজা দিলীপ উপজেলা মহিলা লীগের সভাপতি।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এ পরিবারের প্রভাব রয়েছে। উপজেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ পদে স্থানীয় সংসদ সদস্যের স্বজনরা আছেন।
সংসদ সদস্যের ছোট ভাইও সাবেক সংসদ সদস্য কামরুল আশরাফ খান পোটন, যিনি এখন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। দিলীপের ভাগনে আল মুজাহিদ হোসেন তুষার ঘোড়াশাল পৌরসভার বর্তমান মেয়র।
এছাড়া চরসিন্দুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোফাজ্জল হোসেন রতন সম্পর্কে সংসদ সদস্যের বেয়াই এবং ডাংগা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাবের উল হাই তার ফুফাত ভাই।
নেতাকর্মীরা বলেন, উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে কোনো প্রার্থী না দিলেও সংসদ সদস্য দিলীপ বর্ধিত সভা করে তার শ্যালককে উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছেন।
এরমধ্যে অপর প্রার্থী ভোটে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ করেছেন সংসদ সদস্যের ভাগ্নে পৌর মেয়র তুষারের বিরুদ্ধে।
সংসদ সদস্যের মতের বাইরে কোনো নেতাকর্মী গেলে তাদের ভয়ভীতি দেখানোসহ চেয়ারম্যান প্রার্থী শরীফুল হকের পক্ষে ভোট করতে চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ আরেক চেয়ারম্যান প্রার্থী জাবেদ হোসেনের।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পলাশ উপজেলায় বিগত ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা কিংবা জাতীয় নির্বাচন সবখানেই সংসদ সদস্য আনোয়ারুলের পরিবারের প্রভাব ছিল। পরিবারটির মতের বাইরে কেউ প্রার্থী হলে ভোটে প্রভাব বিস্তার করে পছন্দের প্রার্থীকে জয়ী করার ঘটনাও ঘটেছে।
তার ভাষ্য, “আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের পদ দখল থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি সবই তাদের পছন্দমত হয়ে থাকে। এবার উপজেলা নির্বাচন সংসদ সদস্যের পরিবার থেকে কতটুকু প্রভাবমুক্ত রাখতে পারবে নির্বাচন কমিশন; সেই শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।”
পোস্টার ছিড়ে ফেলাসহ আমার কর্মীদের মারধর করা হচ্ছে এমন অভিযোগ তুলে জাবেদ বলেন, “দলীয় নেতাকর্মীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। লেমিনেটেড করা পোস্টার সাটানোসহ আচরণবিধি লঙ্ঘন করে চলছেন তারা।”
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে তার প্রতিদ্বন্দ্বী শরীফুল হক বলেন, “ভোট সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হবে বলে আশা করি। ছাত্রলীগের মাধ্যমে রাজনীতি শুরু করি। এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা পরিবারের সদস্য আমি।
“তিলে তিলে গড়া রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংস না করতেই চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছি। এখানে সংসদ সদস্য আত্মীয়ের প্রসঙ্গ কেন আসছে। বর্তমান সংসদ সদস্য যখন সরকারি চিকিৎসক তখন তার সঙ্গে আমার বোনের বিয়ে হয়।”
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নিশ্চিত পরাজয় জেনে সংসদ সদস্যের আত্মীয়ের দোহাই দিয়ে তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন বলে দাবি শরীফুল হকের।
নিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা বলে ঘোড়াশাল পৌর মেয়র আল মোজাহিদ হোসেন তুষার বলেন, “আমিসহ সংসদ সদস্যের পরিবারের কেউ উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করছেন না। আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে চেয়ারম্যান প্রার্থী শরীফুল হকের পক্ষে মাঠে কাজ করছেন। নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার ভয়ে তিনি সংসদ সদস্যের আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন।”
নরসিংদী-২ আসনের সংসদ সদস্য ও পলাশ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলীপ বিদেশে অবস্থান করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে হোয়াটসঅ্যাপে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি; ম্যাসেজ পাঠানো হলেও তিনি তা দেখেননি।
ভোটে নিয়ে কথা বলতে পলাশ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম গাজীকে একাধিকবার ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।
পলাশ উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ জীবন ইবনে মাসুম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শনিবার কাপ পিরিচ প্রতীকের প্রার্থী সৈয়দ জাবেদ হোসেন তার পোস্টার ছিড়ে ফেলাসহ কর্মীদের মারধরের একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন।
“দোয়াত কলমের চেয়ারম্যান প্রার্থী শরীফুল হকের কর্মীদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করেন জাবেদ হোসেন। এ ঘটনায় আমরা বিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি।”
কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী এ উপজেলায় ব্যালটের মাধ্যমে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে জানান এই সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা।