বন্দি অবস্থায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ‘১৯৭১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মুজিব মেহেদীকে গুলি করে হত্যা করে’।
Published : 16 Dec 2024, 09:34 PM
মুক্তিযুদ্ধের ৩২ বছর পর শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মিলেছিল ঝালকাঠি প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ মুজিবুল হক মেহেদীর; কিন্তু তাকে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবির আজও বাস্তবায়ন হয়নি।
শহীদ মুজিব মেহেদীর সহযোদ্ধাদের দাবি, বাংলাদেশে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবীর’ যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করা আছে, সেই অনুযায়ী তিনি সেই স্বীকৃতির দাবিদার, তাকে সেই সম্মান না দেওয়া দুঃখজনক, হতাশার।
১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ঝালকাঠি প্রেস ক্লাবের প্রকাশনা ও অনারবোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, বন্দি অবস্থায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ‘১৯৭১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মুজিব মেহেদীকে গুলি করে হত্যা করে। যদিও তাকে ঠিক কোথায় হত্যা করা হয়েছে তা নিয়ে মতভেদ আছে। আমৃত্যু তিনি ছিলেন দৈনিক সংবাদের নিজস্ব সংবাদদাতা ও প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক।
১৯৬৮-৬৯ সালে বৃহত্তর বরিশাল জেলা ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) সভাপতি খুরশীদ আলম খসরুর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বৃহত্তর এই অঞ্চলে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের দক্ষিণ এলাকাগুলো পরিচালনা করতেন মুজিব মেহেদী আর উত্তরের অংশ পরিচালনা করতেন তিনি নিজে। একই সঙ্গে তারা যুক্ত হন সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বাধীন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন এবং পরে মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত সর্বহারা পার্টিতে।
বৃহত্তর বরিশালে ‘পেয়ারা বাগান যুদ্ধ’ একটি ঐতিহাসিক যুদ্ধ। সেই যুদ্ধের অকুতভয় সৈনিক ছিলেন মুজিব মেহেদী। হানাদার বাহিনীর আক্রমণের মুখে কৌশলগত নীতির অংশ হিসেবে পেয়ারা বাগান থেকে পিছু হটার সময় পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েন মুজিব মেহেদী। পরে তাকে হত্যা করা হয় বলে সহযোদ্ধারা জানান।
মুজিব মেহেদীর পরিবার ও সহযোদ্ধারা জানান, তাদের পৈত্রিক বাড়ি ছিল মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরে। পরে পরিবারটি ঝালকাঠিতে ব্যবসা গড়ে তোলে। ব্যবসায়ী আবদুল কাদের ও হালিমা খাতুনের বড় সন্তান ছিলেন মুজিব মেহেদী। তারা ছিলেন পাঁচ বোন ও তিন ভাই। ঝালকাঠিতে তাদের কাপড় ও মনোহারি দোকান ছিল। শহরের মসজিদ বাড়ি সড়কে (তরকারি পট্টি) নিজেদের বাড়িতেই থাকতেন তারা। কালে কালে সবকিছুই পরিবারটি হাতছাড়া হয়ে যায়।
১৯৮৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর রশীদ হায়দারের সম্পাদনায় বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’-এ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটি সংজ্ঞা বা মাপকাঠি বলা হয়। তাতে বলা হয়,
১. ‘শহীদ’ অর্থ ২৫-৩-১৯৭১ থেকে ৩১-০১-১৯৭২ এই সময়কালে যারা দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কিংবা তাদের সহযোগীদের হাতে নিহত কিংবা ওই সময়ে নিখোঁজ হন।
২. বুদ্ধিজীবী অর্থ লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, সকল পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, চলচ্চিত্র ও নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবী ও সংস্কৃতিসেবী।
মুজিব মেহেদি একাধারে সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার, অভিনেতা ও রাজনীতিবিদ।
খুরশীদ আলম খসরু বলছিলেন, “মুজিব মেহেদী অবশ্যই বাম বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অন্যতম। বরিশাল অঞ্চলে আমি পার্টির দায়িত্বে থাকার সময় সবার লেখাও তদারকি করতে হতো আমাকে। তখন মনে হতো আমাদের লেখা কখনও কখনও আবেগমিশ্রিত আর মুজিব ভাইর লেখা সম্পূর্ণ বস্তুনিষ্ঠ। তিনি রাজনীতি না করে শুধু লেখালেখি নিয়ে পরে থাকলেও বিখ্যাত হতেন।”
মুজিবুল হক মেহেদীর স্ত্রী হামিদা আক্তার মেহেদী জানান, তার স্বামীর লেখা ‘শেষ থেকে শুরু’ নামের একটি উপন্যাস মুক্তিযুদ্ধের আগেই বের হয়েছিল। তখন প্রকাশকের কাছ থেকে দেড়শ টাকাও পেয়েছিলেন। নাটক ও ছোটগল্পের কয়েকটি পাণ্ডুলিপিও তার সংগ্রহে আছে। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে চিঠিপত্রসহ কিছু সংগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। কিছু নিজে অনুলিপি করেও রেখেছেন।
ঝালকাঠি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক জেলা কমান্ডার ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মোস্তফা কামাল মন্টু বলেন, “অনেক আক্ষেপের পর ২০০৩ সালে মুজিব মেহেদী ভাইকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত করাতে পেরেছি আমরা। তবে রাষ্ট্র এখনও তার মত এত মেধাবী একজনকে শহীদ বুদ্ধিজীবীর মর্যাদা দেয়নি এটা সত্যিই দুঃখজনক, হতাশার। তার অকাল প্রয়াণে সন্তানরাও সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। তার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেট নম্বর ০৬০২০১০৬৪৪।”
যেভাবে ধরা পড়েন
‘পেয়ারা বাগান যুদ্ধের ৫০ বছর’ সংকলনের ভূমিকায় বলা হয়েছে, তখনকার ৭২ বর্গমাইল এলাকার পেয়ারা বাগানে ১৯৭১ সালের ৮ মে পাকিস্তানি হানাদাররা লঞ্চে করে যাওয়ার সময় সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করে। এতে কমপক্ষে ২৪ জন পাকিস্তানি নিহত হয়।
“তখন বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদভাষ্যে বলা হয়, ২৫ মার্চের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা এই প্রথম কোনো প্রতিরোধের মুখে ক্ষতির শিকার হলো। এই যুদ্ধটির কথা ৯ নম্বর সেক্টরের সদরদপ্তর থেকে প্রকাশিত ও নুরুল আলম ফরিদ সম্পাদিত ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’ এর আগস্ট-১৯৭১ সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে।”
ওই যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেওয়া খুরশিদ আলম খসরু ও পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত এআইজি শফিউল ইসলাম জানান, সেদিন তাদের সঙ্গে মুজিবুল হক মেহেদীও উপস্থিত ছিলেন। যুদ্ধকালে তাদের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান ছিলেন মেহেদী। পেয়ারা বাগানের একটি সেক্টরের পলিটিক্যাল কমিশার হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে জনসংযোগ বিভাগের সহকারী প্রধান ছিলেন খসরু। এই দলের উল্লেখযোগ্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন মনিকা রায়।
পেয়ারা বাগান এলাকায় গেরিলা ইউনিটগুলো ১২টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। প্রত্যেক সেক্টরের প্রধান হিসেবে ছিলেন একজন পলিটিক্যাল কমিশার ও একজন সামরিক কমান্ডার।
বীর মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ২৪ জন নিহত হওয়ার কয়েকদিন পর পাকিস্তানি বাহিনী সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু করে। তারা পেয়ারা বাগান কাটা শুরু করে। সব দিক থেকে আটকে ফেলে। সব দিকের নদীতেও টহল চালায়। এর মধ্যে ৩ জুন সর্বহারা পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয় পেয়ারা বাগানে। সিদ্ধান্ত হয়, রিট্রিট বা পিছিয়ে যেতে হবে। যেকোনোভাবে পেয়ারা বাগান থেকে বের হতে হবে।
সেই সময় সর্বহারা পার্টির সদস্য ছিলেন ফজলুল হক মিলু; যিনি পেয়ারা বাগানেও যুদ্ধ করেছেন।
তিনি বলছিলেন, “প্রথমে সিরাজ সিকদার, তার স্ত্রী জাহানারা ও শিশুসন্তানসহ এক পরিচারিকা নৌকা ধরে এক পাশে ভাসতে ভাসতে নদী পার হন। এভাবে চারপাশের বিভিন্ন নদী দিয়ে হাজার হাজার মানুষ পার হয়। পার্টির নেতা সেলিম শাহনেওয়াজ বরগুনার পাথরঘাটার দিকে যায় অনেককে নিয়ে। কিন্তু মুজিব মেহেদী ভাই যেতে দেরি করায় রাতে একটি বাড়িতে ধরা পড়েন।
“গোলাগুলির আওয়াজ পাই আমরা শ্রীরামকাঠি থেকে। লঞ্চে তাকে ঝালকাঠি হয়ে বরিশালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।”
খুরশীদ আলম খসরু বলেন, “ধরা পড়ার পর মুজিব মেহেদীকে বরিশালে নয়, যশোর ক্যান্টনমেন্টে নেওয়া হয়েছিলো। কারণ এই অঞ্চলের সব বুদ্ধিজীবীদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সেখানেই নেওয়া হত।”
খুরশীদ আলম খসরুর এই বক্তব্য সমর্থন করেন কীর্ত্তিপাশা সেক্টরের পলিটিক্যাল কমিশার বীর মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর কবিরও। তিনি বলেন, “রাজনীতিতে মুজিব মেহেদী ভাই ও ন্যাপের (ভাসানী) আব্দুল বারি ভাই ছিলেন আমাদের আইকন।”
এ ছাড়া কেউ কেউ মনে করেন, মুজিব মেহেদীকে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীর তীরে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। যদিও এটি সর্বহারা পার্টির কেউ সমর্থন করেন না।
স্বচ্ছলতা থেকে নিঃস্ব
বেশ সচ্ছল পরিবারের সন্তান ছিলেন মুজিব মেহেদী। কিন্তু রাজনীতি-সাংবাদিকতা আর লেখালেখির কারণে পরিবারের সম্পদ আর ধরে রাখতে পারেননি। ১৯৬৪ সালের দিকে তিনি সাড়ে ১১ বছরের হামিদা আক্তারকে বিয়ে করেন। সাত বছরের সংসার জীবনে মাত্র দুই বছর তিনি স্বামীকে কাছে পেয়েছিলেন। হামিদা আক্তার সন্তানদের নিয়ে থাকতেন মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরে। সেসময় রাজনীতি আর কারাবরণে বরিশাল, ঝালকাঠি আর ঢাকায় কাটে মেহেদীর সময়।
বড় ছেলে ইমদাদুল হক শামীমকে পাঁচ বছরের এবং আনোয়ারুল হক সুখনকে দেড় বছরের রেখে শহীদ হন মুজিব মেহেদী। তার মৃত্যুর পর স্ত্রী দুই সন্তানকে নিয়ে কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়েন। কারণ, ততদিনে মুজিব মেহেদীর পৈত্রিক সম্পদের আর বিশেষ কিছু অবশিষ্ট ছিল না।
মুজিব মেহেদীর স্ত্রী হামিদা আক্তার মেহেদী বলছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দুই হাজার টাকার একটি চেক কেবল সহযোগিতাস্বরূপ পেয়েছিলেন। তিনি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। ফলে কোনো চাকরি করার সুযোগ ছিল না। দুই বছর বিভিন্ন জনের কাছ থেকে বইপত্র ধার করে এবং আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে বাড়িতে বসে পড়াশোনা করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি মেট্রিক (এসএসসি) পাস করেন।
এরপর বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ফেমিলি প্ল্যানিং সমিতিতে চাকরি নেন ১৯৭৫ সালে। তখন থেকে কোনো মতে সংসার চলতে থাকে। ১৯৯৫ সালে তিনি অবসরে যান। দুই ছেলে খুব বেশি পড়াশোনাও করতে পারেননি।
দুই ছেলের কাছে বাবার বিশেষ কোনো স্মৃতিও নেই। বড় ছেলে ১৯৭০ সালে পাঁচ বছর বয়সে মামার সঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটে গিয়েছিলেন বাবা মুক্তি পেয়েছেন শুনে। ছেলেকে কোলে নিয়ে মুজিব মেহেদী বলেছিলেন, “তুইও একদিন দেশের কাজ করবি।”
সেদিন জেল গেইট থেকে তিনি আর বাড়ি ফেরনেনি। গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে বলে ঝালকাঠিতে চলে যান। আর কোনোদিন তার ঘরে ফেরা হয়নি।
ঝালকাঠি প্রেস ক্লাবের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আককাস সিকদার বলেন, “ক্লাবের সবাই আমরা তাকে নিয়ে গর্বিত। ক্লাবের সামনের সড়কটি তার নামে করা হয়েছে। যেমন ঝালকাঠি প্রেসক্লাবের ঠিকানা ০৯, শহীদ মেহেদী সড়ক।
“যেসব মানদণ্ডে একজন মানুষ শহীদ বুদ্ধিজীবীর স্বীকৃতি পেতে পারে তার সবই মুজিব মেহেদীর রয়েছে। সরকারের কাছে ঝালকাঠি প্রেসক্লাবের দাবি থাকবে, দ্রুত তাকে শহীদ বুদ্ধিজীবীর স্বীকৃতি দেওয়া হোক।”