বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা কামাল মন্টু বলেন, সুগন্ধার পাড়ের গণকবরের ওপরে ১৯৭৫ সালের আগেই ভাষা শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়।
Published : 24 Feb 2025, 08:17 PM
অ, আ, ক, খ- এই প্রতিটি বর্ণ আজ দেশের সব মিনারের শহীদ বেদিতে বরকতদের রক্তের আলপনায় আঁকা স্মারক।
“এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে/ রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার নিচে/ সেখানে আগুনের ফুলকির মতো/ এখানে ওখানে জ্বলছে রক্তের আলপনা”।
‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ একুশের প্রথম এই কবিতায় ১৯৫২ সালে মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী চট্টগ্রাম থেকে এই লাইনগুলোই সারাদেশে আগুনের ফুলকির মতো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের আমতলায় মায়ের ভাষার স্বীকৃতি আদায়ে দুনিয়া কাঁপানো ৩০ মিনিটের স্মৃতিকে আরও অমর করেছে শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটক। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বসে ১৯৫৩ সালের ১৭ জানুয়ারি তার লেখা ‘কবর’ পরবর্তী ১৯ বছরের মধ্যে এ দেশের মানুষের জীবনে সত্য হয়ে দেখা দেয়।
বায়ান্নর সেই ‘কবর’ থেকে একাত্তরের গণকবরে ঠাঁই হয় স্বয়ং মুনীর চৌধুরীসহ লাখ-লাখ বাঙালির। তেমন একটি গণকবরের ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে ঝালকাঠির সুগন্ধা পাড়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। ‘কবর’ রচিয়তা যেভাবে নিজের জীবন দিয়ে বায়ান্ন-একাত্তরকে এক সুতোয় বেঁধেছে, ঝালকাঠির শহীদ মিনারও মাতৃভাষা ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের এক করেছে।
এ সম্পর্কে বৃহত্তর বরিশাল জেলা ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) সাবেক সভাপতি (১৯৬৮-৬৯) খুরশীদ আলম খসরু বলেন, “একাত্তরের গণকবরের ওপরে একমাত্র শহীদ মিনার বানানো হয়েছে ঝালকাঠিতে। ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশেই বরকত শহীদ হয়েছে। কিন্তু ঠিক শহীদ মিনারের স্থানে নয়। আবার ওখানে কোনো গণকবরও নেই। শহীদের গণকবরের একদম ওপরেই শহীদ মিনার হয়েছে কেবল ঝালকাঠিতেই।”
পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) শফিউল ইসলাম বলেন, “১৯৭১ সালে আমি ঝালকাঠি থানার সেকেন্ড অফিসার ছিলাম। বিজয়ের পরই ওসি হিসেবে একই থানায় ওই বছর ২৭ ডিসেম্বর যুক্ত হই। এর দুই সপ্তাহ পর ১৯৭২ সালের ১৫ বা ১৬ জানুয়ারি আমি লোক ঠিক করে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীর পাড়ের গণকবর খোঁড়ার ব্যবস্থা করি।”
সেসময়ের দুর্লভ ছবি দেখিয়ে বলেন, “প্রায় ২০০ মাথার খুলি ও দেহের বিভিন্ন অংশের হাড়সহ জামাকাপড় এক করা হয়। আত্মীয়-স্বজন জামা-কাপড়ের মাধ্যমে অনেককে শনাক্ত করে নিয়ে যায়। বাকিদের থানার মাঠের দক্ষিণ ও সুগন্ধার চরের পশ্চিম দিকের যে স্থানটিতে সমাহিত করা হয়েছিল সেখানেই বর্তমান শহীদ মিনার। এই শহীদ মিনারটির নিচে অসংখ্য শহীদের দেহাবশেষ রয়েছে।”
ঝালকাঠি জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা কামাল মন্টু বলেন, সুগন্ধার পাড়ের গণকবরের ওপরে ১৯৭৫ সালের আগেই ভাষা শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়।
তার কথার সমর্থন পাওয়া যায় ১৯৭৫ সালে ঝালকাঠি পৌরসভার স্মরণিকায় প্রকাশিত শহীদ মিনারের ছবিটি দেখে।
তখনও ঝালকাঠি শহীদ মিনারটি বানানো হয়েছিল শিল্পী হামিদুর রহমানের নকশা করা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে। যেটি ১৯৭৩ সালে ঢাকায় পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে, তবে ১৯৫৬ সালের নকশাটিও এর কাছাকাছি ছিল।
ঝালকাঠির জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মী নাসির উদ্দিন কবীর একটি চিত্র এঁকে দেখিয়েছেন ১৯৮০ সালের দিকে সুগন্ধা নদী ও শহীদ মিনারটি পরস্পর কতটুকু জায়গার মধ্যে ছিলো।
বীর মুক্তিযোদ্ধা দম্পতি পার্থ সারথি দাস ও রমা রানী দাস বলেন, এই শহীদ মিনারটির মর্যাদা বাংলাদেশের অন্যান্য মিনারের চেয়ে ভিন্ন। এই শহীদ মিনারটি এতোদিন স্টেডিয়ামের দেয়ালে অবরুদ্ধ ছিল, কয়েক বছর আগে উন্মুক্ত করা হয়েছে। এর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ হওয়া দরকার।
ঝালকাঠি প্রেসক্লাবের সেক্রেটারি এবং সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. আককাস সিকদার বলেন, “গণকবরের ওপরে এই ব্যতিক্রমী শহীদ মিনারে ফুল দিতে এসেও যখন দেখি মানুষ জুতা নিয়ে বেদিতে উঠে যায়, ফটোসেশন আর রাজনৈতিক শোডাউন চলে, শহীদের স্মরণের পরিবর্তে দলীয় শ্লোগানে আকাশ কাঁপে, প্রশাসনের ঘোষণা মাইক থেকে নির্বিকার দায়িত্ব পালন- তখন মনেহয়, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ এই গান আমরা শুধু মুখেই বলি। এরপর থেকে আশা করবো আবদুল গফফার চৌধুরীর কথা ও শহীদ আলতাফ মাহমুদের সুরের মতো জাগ্রত হবে সবার মাঝে অমর একুশের সম্মান।”