‘৫২ বছর পর প্রথম বাবার স্পর্শ পেলাম’, বললেন শহীদের মেয়ে

সিলেটের এই বধ্যভূমিতে শনিবার ৬৬ শহীদের পরিবারের স্বজনরা জড়ো হয়েছিলেন। 

বাপ্পা মৈত্রসিলেট প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 March 2023, 05:37 PM
Updated : 4 March 2023, 05:37 PM

একাত্তরে গকুলানন্দ চক্রবর্তীকে সিলেটের মিরাবাজার এলাকার বাড়ি থেকে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তুলে নিয়ে যায় তখন তার স্ত্রী ছিলেন সন্তানসম্ভবা। সেদিন গকুলানন্দের সঙ্গে তার বাবা গির্বানী কান্ত চক্রবর্তী এবং বোন গঙ্গোত্রী চক্রবর্তীকে তুলে নেওয়া হয়েছিল।  

কিছুদিন পর পরিবার জানতে পারে, তিনজনকেই সেনারা সিলেট ক্যাডেট কলেজের পেছনে টিলার বধ্যভূমিতে হত্যা করেছে। কিন্তু তাদের মরদেহ পায়নি পরিবার।

গকুলানন্দ হত্যার পর তার স্ত্রী এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। জন্মেই এতিম এই সন্তানের কাছে বাবার কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই; কিন্তু গর্ব করার মতো ছিল বাবার ‘শহীদ’ উপাধিটা। এ নিয়েই এতগুলো বছর কাটিয়ে দিয়েছেন গকুলানন্দের কন্যা রীনা চক্রবর্তী।

৫২ বছর পর, শনিবার এই প্রথমবার বাবার জন্য নির্মিত স্মৃতিফলকে সামনে দাঁড়িয়ে চোখ ভেজে উঠে রীনার। স্মৃতিফলকের লেখাগুলো ছাপসা দেখছিলেন, যেখানে সাদা পাথরের গায়ে খোদাই করে লেখা- ‘শহীদ গকুলানন্দ চক্রবর্তী, মিরাবাজার, সিলেট’।

কাঁপা কাঁপা হাতে রীনা চক্রবর্তী স্পর্শ করেন সেই স্মৃতিফলক। যেন বাবাকে স্পর্শ করার প্রথম অনুভূতি। যে অনুভূতির জন্য সন্তান অপেক্ষা করে যুগ যুগ ধরে।  

চোখ মুছতে মুছতে রীনা বলছিলেন, “আমি তো কখনও বাবাকে দেখিনি; কোথাও তার কোনো স্মৃতিচিহ্নও ছিলো না। আজ ৫২ বছর পর এ বধ্যভূমিতে তার একটি স্মৃতিফলক লাগানো হলো। এই প্রথম যেন আমি বাবার স্পর্শ  পেলাম।”

গলা ধরে আসে রীনার; তাকিয়ে থাকেন বাবার স্মৃতিফলকের দিকে।

“বাবার মৃত্যুর কয়েক মাস পর আমার জন্ম। এতোদিন কেবল গল্প শুনেছি, বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। কিন্তু কোথাও বাবার কোনো স্মৃতিচিহ্ন ছিল না। এখন অন্তত বাবার সামনে দাঁড়াবার একটা জায়গা হলো।”

শনিবার দুপুরে সিলেটের ক্যাডেট কলেজের পেছনের টিলার বধ্যভূমিতে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার শহীদ স্মৃতি উদ্যান-সিলেট’-এ শহীদ গকুলানন্দ চক্রবর্তীর পরিবারের মতো আরও ৬৬ শহীদের পরিবারের স্বজনরা জড়ো হয়েছিলেন।  

এর উদ্বোধন করেন শহীদ সিরাজুল আবদালের স্ত্রী সৈয়দা সকিনা আবদাল। লাল ফিতা কেটে উদ্বোধনের পরই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। স্মৃতি উদ্যান সংরক্ষণ ও নির্মাণের উদ্যোক্তা কর্নেল আব্দুস সালাম বীর প্রতীক তাকে সান্ত্বনা দেন।

পরে শহীদ পরিবারের সদস্যরা স্মৃতিচিহ্নে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। বাবা, দাদা-দাদী, চাচাসহ স্বজনদের খুঁজতে এসেছেন তারা।

সিলেট মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ শহীদ লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ এফ জিয়াউর রহমানের মেয়ে শাহরীন রহমান বলেন, “৫২ বছর পর আমি জানলাম, কোথায় আমার বাবা ঘুমিয়ে আছেন। মা একটি কথা বলতেন, তোমার বাবা ফিরে আসবে। ৫২ বছর পর আমার বাবা ফিরে এসেছেন।”

লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ এফ জিয়াউর রহমান ২৬ মার্চ গৃহবন্দি হন। ১৪ এপ্রিল তাকে চিকিৎসকদের কোয়ার্টার থেকে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। তখন মেয়ে শাহরীনের বয়স মাত্র পাঁচ। 

মায়ের কাছে শোনা স্মৃতি তুলে ধরে শাহরীন বলেন, “মেডিকেলের ছাত্ররা বাবাকে সীমান্ত পার করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাবা যাননি। তাকে টার্গেট করার মূল কারণ, তখন তিনি বাংলাদেশের পতাকা বাড়িতে ও গাড়িতে ওড়াতেন।“

শহীদ সিরাজুল আবদালের স্ত্রী সৈয়দা সকিনা আবদাল বলেন, “আমার স্বামীর কোনো স্মৃতিচিহ্ন ছিল না। বধ্যভূমিতে স্বামীর স্মৃতি চিহ্নটুকু পরম পাওয়া।“

সিলেট সিটি করপোরেশনের ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তাকবির ইসলাম পিন্টু বলেন, “স্বাধীনতার জন্য আমাদের পরিবারের অনেককে জীবন দিতে হয়েছে। আমার দাদা নামকরা ঠিকাদার ছিলেন। যে কারণে আমাদের নয়টি জিপ গাড়ি ছিল।

“আমার চাচা তজমুল আলী গাড়ি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বহন করতেন। সাধারণ মানুষকেও নিরাপদে পৌঁছে দিতেন। যেদিন তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, সেদিন রেললাইনের পাশে তার গাড়ি লক্ষ্য করে তিনটি গুলি করে পাকিস্তানি হানাদাররা। এরপর দুটি গুলি তার পায়ে বিদ্ধ হয়। তাকে রেললাইন দিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় টেনে নেওয়া হয়েছিল। পরে তাকে হত্যা করা হয়।”

পিন্টু বলেন, “ছেলে হারানোর কষ্ট নিয়ে ৯০ বছরে আমার দাদি মারা গেছেন। কিন্তু ছেলের স্মৃতিচিহ্ন দেখে যেতে পারেননি তিনি।”

বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) মো. আব্দুস সালাম বীর প্রতীক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদের উদ্যোগে নির্মিত এ শহীদ স্মৃতি উদ্যানে এ পর্যন্ত ৬৬ জন শহীদকে চিহ্নিত করে তাদের নামে আলাদা স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। কমিটির আরেক সদস্য হলেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক অপূর্ব শর্মা।

আয়োজকরা জানান, পরবর্তী সময়ে আরও শহীদের সন্ধান পাওয়া গেলে তাদের নামও ফলকে যুক্ত করা হবে।

পরিচয় মিলেছে যাদের   

পরিচয় পাওয়া শহীদরা হলেন- নারায়াণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার মোসলেহ উদ্দিন ভুঁইয়ার ছেলে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ড. এ এফ জিয়াউর রহমান, হবিগঞ্জ জেলার আউশকান্দি এলাকার সৈয়দ সাজিদ আলীর ছেলে সৈয়দ সিরাজ আবদাল, সিলেট নগরীর পুরাণ লেন এলাকার উপেন্দ্র কিশোর সেনগুপ্তের ছেলে বিমলাংশু সেন, ছড়ারপাড় এলাকার আব্দুন নুরের ছেলে বাছির মিয়া, সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার দেউল গ্রামের মন্তাজ আলীর ছেলে নুরুল হুদা গউস, ইপিআর ক্যাপ্টেন আলাউদ্দিন।

সিলেট নগরীর মুগলটুলা এলাকার মশরফ আলীর ছেলে সোনাওর আলী, মিরাবাজার এলাকার শারদাচরণ দেবের ছেলে শুভেন্দু শেখর দেব শংকর, একই এলাকার গিরিধারী চক্রবর্তীর ছেলে গির্বানী কান্ত চক্রবর্তী, তার ছেলে গকুলানন্দ চক্রবর্তী ও গঙ্গোত্রী চক্রবর্তী, খাদিমপাড়া দত্তগ্রাম এলাকার ইয়াকুব আলীর ছেলে সিদ্দিক আলী, একই গ্রামের আব্দুল লতিফের ছেলে আব্দুর রব হীরা।

মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার খলাগ্রামের সূর্যকুমার ধরের ছেলে সুরতিমোহন ধর, একই গ্রামের দীনরাম দেবের ছেলে নরেন্দ্র দেব, সিলেট নগরীর জল্লারপাড় এলাকার বলেনদ্র চন্দ্র রায়ের ছেলে শুভন্দ্র শেখর রায়, সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার ছোটদেশ এলাকার আছদ্দর আলীর ছেলে তোতা মিয়া, সিলেট সদর উপজেলার মহালদিক গ্রামের আনোয়ার পাত্রের ছেলে কুমেদ পাত্র, একই গ্রামের কানতুর পাত্রের ছেলে ফরছন পাত্র, রবাই মিয়ার ছেলে ইসরাইল আলী, সৈয়দ আলীর ছেলে আব্দুর রহমান, কনাই মিয়ার ছেলে আব্দুল গনি, মুছন আলীর ছেলে রমজান আলী।

Also Read: ৬৬ শহীদের পরিচয় নিয়ে খুলছে সিলেটের ‘স্মৃতি উদ্যান’

সিলেট সদর উপজেলার ধোপাগুল এলাকার হামিদ উল্লার ছেলে হাজী আমজদ আলী, সিলেট নগরীর আখালিয়া ব্রাহ্মণশাসন এলাকার করুণাময় ভট্টাচার্যের ছেলে কালিপদ ভট্টাচার্য, তার ছেলে হীরেন্দ্র ভট্টাচার্য, নগরীর নয়াটিলা এলাকার সদাই নমঃশুদ্রের ছেলে সুখাই নমঃশুদ্র, সিলেট সদর উপজেলার উমদারপাড়া গ্রামের আলাই মিয়ার মেয়ে ছুরেতুননেছা, একই গ্রামের ওয়াহাব উল্লার মেয়ে রহিমা বেগম ও খলিলা বেগম, দক্ষিণ সুরমা উপজেলার খোজারখলা গ্রামের সুরুজ আলীর ছেলে তজমুল আলী।

সিলেট সদর উপজেলার মহালদিক গ্রামের আব্বাস আলীর মেয়ে ময়না বিবি, গোয়াইনঘাট উপজেলার বীরকুলি গ্রামের ছমেদ আলীর ছেলে আব্দুল খালিক, সিলেট সদর উপজেলার লাখাউড়া গ্রামের হায়দার মিয়ার ছেলে আব্দুল মজিদ, একই উপজেলার পোড়াবাড়ি গ্রামের রামচরণ উড়াংয়ের সন্তান দূর্গা উড়াং ও ভাদুয়া উড়াং, একই গ্রামের লিব উড়াংয়ের সন্তান ঘাটমা উড়াং, একই উপজেলার বাবার হাট এলাকার কিশোরপাত্রের ছেলে শচীন্দ্রপাত্র, মহালদিক গ্রামের ছফর আলীর ছেলে আব্দুল গণি, সিলেট সদর উপজেলার লালবাগ এলাকার আব্দুল আলীর ছেলে জহির আলী, একই গ্রামের ইয়াকুব আলীর ছেলে জফুর আলী।

সিলেট সদর উপজেলার বালিয়াকান্দি গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে আব্দুল ছোবহান, দক্ষিণ সুরমা উপজেলার বরইকান্দি গ্রামের সৈয়দ আহমদের ছেলে আব্দুল আলী, সিলেট সদর উপজেলার জৈনকারকান্দি গ্রামের ইব্রাহিম আলীর ছেলে সাজিদ আলী, একই উপজেলার বাউয়ারকান্দি গ্রামের সফর আলীর ছেলে আব্দুল গনি, গোয়াইনঘাট উপজেলার কচুয়ারপাড় গ্রামের উমেদ আলীর ছেলে আকবর আলী, একই গ্রামের ফুরকান আলীর ছেলে ইউসুফ আলী, সিলেট সদর উপজেলার দাফনাটিলা গ্রামের ইসরাইল আলীর ছেলে কুটি মিয়া, একই উপজেলার কালাগুল এলাকার কেয়ামত আলীর ছেলে সুরুজ আলী।

সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার সিরাজপুর গ্রামের ফজল খানের ছেলে নুরুল হক খান, সিলেট সদর উপজেলার মহাজনপট্টি এলাকার গুরুচরণ মিত্রের ছেলে গজেন্দ্রলাল মিত্র, একই এলাকার মদনমোহন বণিকের ছেলে প্রাণ গোবিন্দ বণিক, শুধাংশু শেখর দত্তের ছেলে সুনীল দত্ত, সিলেট নগরীর সুবিদবাজার নয়াবস্তি এলাকার নারায়ন সিংহের ছেলে আনন্দ সিংহ, তার ছেলে খগেন্দ সিংহ, বড়বাজার রায়হোসেন এলাকর গরবা সিংহের ছেলে গৌরমোহন সিংহ, সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার কর্মকলাপতি গ্রামের বৃন্দাবন চন্দ্র দেবের ছেলে বসন্ত কুমার দেব।

সিলেট নগরীর তাঁতীপাড়া এলাকার বংকেশ দাশ, সিলেটের ওসমানীনগর উপজলার তাজপুর রবিদাশ এলাকার গজেন্দ্র কুমার দেবের ছেলে মিহির লাল দেব এবং মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার নন্দনগর গ্রামের আব্দুল গণি চৌধুরীর ছেলে আব্দুল আহাদ চৌধুরী, সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণবাঘার মসিউদ্দিন চৌধুরী ছেলে সাইফুদ্দিন চৌধুরী।

এ ছাড়া ইপিআরের মেজর আব্দুল্লাহ, ক্যাপ্টেন খালেদ, মেজর চৌধুরী শহীদ হেয়েছেন। তবে তাদের পিতার পরিচয় পাওয়া যায়নি।