“এক বস্তা চাউলে ৩৮ কেজি মুড়ি হয়। রমজান মাসে এক দিনে ৬০ কেজি মুড়ি বিক্রি করতে পারি।”
Published : 02 Mar 2025, 09:29 PM
অলিগলি কয়েকটি বাঁকা পথ হাঁটতে হাঁটতে তিতাস নদীর পাড় পর্যন্ত যেতেই মট-মট শব্দ আর বাতাসে ভেসে এলো সুঘ্রাণ। একটু যেতেই বুঝা গেল মুড়ি ভাজার শব্দ।
সেখানে কয়েকজন নারী নিজের সংসার নিয়ে কথা বলছেন; আর হাতে চলছে মুড়ি ভাজার কাজ। দেখতে দেথতে পুরাতন পদ্ধতিতে গরম বালুর স্পর্শে ফুটে তৈরি হচ্ছে সুস্বাদু মুড়ি।
মুড়ি ভাজার স্থানে যেতেই একজন নারী বল উঠলেন, “বাবু মুড়ি লাগবে? কত কেজি দেব
বলো? তাকে সাংবাদিক পরিচয় দিতেই হেসে দিলেন।
বাবু ডাকে সম্মোধন করা নারীই হলেন হাতে ভাজা মুড়ির মূল কারিগর অর্চণা দাস। ৫৫ বছর বয়সী অর্চণা ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরশহরের পাইকপাড়া পাটগুদাম রোড দাস পাড়ার ঝান্টু দাসের স্ত্রী। ঝান্টু পেশায় মাছ ব্যবসায়ী।
অর্চণা দাসের চার মেয়ে ও এক ছেলে। চার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন এবং ছেলে এ বছর বিবিএ শেষ করেছে।
অর্চণার সমসাময়িক আরও অনেকে এ পেশায় ছিলেন। কিন্তু শ্রমিক সংকট, মুড়ি ভাজতে মেশিনের ব্যবহারসহ আরও বিভিন্ন কারণে এ কাজ থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছেন তারা।
অর্চনা বলছিলেন, “মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই শাশুড়ি তরঙ্গ বালা দাস হাতে ভাজা মুড়ি ভাজতেন। এরপর আমি এই বাড়ির বউ হয়ে আসি। আমার শাশুড়ি আমাকে খুব ভালোবাসতেন। তার কাছাকাছি থাকতে থাকতে আমিও মুড়ি ভাজা শিখে ফেলছি।
“শাশুড়ি ২০১৯ সালে মারা যাওয়ার পর ছেলে-মেয়েরা মুড়ি ভাজতে নিষেধ দিয়েছিল। কিন্তু শাশুড়ির ৫০ বছরের পেশাটাকে বাঁচিয়ে রাখতেই মুড়ি ভাজার দায়িত্বটা আমি কাঁধে নেই।”
মুড়ি ভাজতে কী কী উপকরণ লাগে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, “হাতে ভাজা মুড়ি দেশি চাউল দিয়েও হয়। তবে রমজান আসলে মুড়িগুলো সুন্দর হতে ভারতীয় ‘শান্তি সিলভার’ নামে এক কম্পানির চাউল আছে সেটা ব্যবহার করি।
“আমি চাউলগুলো লবণ পানি দিয়ে মেখে দেই। আমার ভাইয়ের মেয়ে সুলেখা দাস লবণ পানি দেওয়া চালগুলো তাওয়াতে (করাই) ৪-৫ মিনিট গরম করে। তারপর আমার ভাসুরের ছেলের বউ বন্দনা দাস গরম বালুতে সেই চাউলগুলো ঢেলে চিকন কাঠি দিয়ে হাতে নাড়া দিলেই হয়ে যাচ্ছে হাতে ভাজা মুড়ি।”
অর্চণার প্রতিবেশী নিদু দাস বলছিলেন, “আমরা ২০ বছর হাতে ভাজা মুড়ি বিক্রি করেছি। বর্তমানে শ্রমিক সংকটের কারণে পেশাটা ছেড়ে দিয়েছি। আমাদের যা কাস্টমার ছিল, এখন অর্চণা দাস থেকে মুড়ি নিয়ে যায়। ক্যামিকেল মুক্ত হওয়ায় অনেকেই আসে মুড়ি নিতে।
“রমজান মাসে চাহিদা বেশি থাকে। আগে ১০টা পরিবারের মতো হাতে ভাজা মুড়ি তৈরি করতো। কিন্তু বর্তমানে লোকবল সংকটের কারণে এই পেশা থেকে মানুষ দূরে চলে গেছে।”
মুড়ি ক্রেতা ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবের সভাপতি জাবেদ রহিম বিজন বলেন, আমি ১০ বছর ধরে অর্চণার বাড়ি থেকে মুড়ি কিনি। সুস্বাদু ও ক্যামিকেল মুক্ত হওয়ায় আমার পরিবারের পছন্দ এই মুড়ি।”
দুই কেজি মুড়ি ২৪০ টাকা দিয়ে কিনেছেন বলে তিনি জানান।
কুমারশিল মোড়ের নিউ স্টোরের সত্ত্বাধিকারী হৃদয় রায় বলেন, “পাইকপাড়া থেকে হাতে ভাজা মুড়ি আমরা কিনে রাখি। হাতে ভাজা মুড়ির পুরাতন কাস্টমা যারা আছে তারা কিনে নিয়ে যায়। ক্যামিকেল মুক্ত হওয়ায় অনেকেই নিয়ে যায়। তবে হাতে ভাজা মুড়ির চাহিদা কমে গেছে, কারণ মেশিনের মুড়ির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায়।”
মুড়ির দাম প্রসঙ্গে অর্চণা দাস বলেন, “আমার শাশুড়ির বাড়িতে এসে আমি দেখেছি, ১৯৯০ সালে এক কেজি মুড়ি ২৪ টাকা ধরে বিক্রি করতাম। এখন বাড়িতে মুড়ি বিক্রি করি ১২০ টাকা দরে।”
দাম বাড়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “এক বস্তা চালের দাম ৩ হাজার ৪০০ টাকা। লবণ লাগে ৩০ টাকার। রিকশাভাড়া ৩০ টাকা, ভাজা খরচ ১৪০ টাকা। এক বস্তা চাউলে ৩৮ কেজি মুড়ি হয়। রমজান মাসে এক দিনে ৬০ কেজি মুড়ি বিক্রি করতে পারি। রমজান মাস ছাড়া ২৫ কেজি বিক্রি হয়।”