যুবদল নেতা মাকসুদুর রহমান বলেন, “যুবলীগের দখল থেকে ১৬ বছর পর এটি উদ্ধার করেছি আমরা। এটি এখন আমাদের দলীয় কার্যালয়।”
Published : 04 Oct 2024, 09:49 AM
কুমিল্লার লালমাই উপজেলার বাঙ্গড্ডা সড়কের ভুশ্চি বাজারের যাত্রী ছাউনিটিতে বাজারে আসা লোকজনও বসে বিশ্রামের সুযোগ পেতেন। তবে নির্মাণের চার বছর পরেই সেটি যুবলীগের কার্যালয় হয়ে যাওয়ায় সেই সুযোগ হারান তারা।
দীর্ঘ ১৬ বছর পর ক্ষমতার পালাবদলে ছাউনিটি ব্যবহারের সুযোগ ফেরত পাননি যাত্রীরা। সেটি এখনও দখলেই আছে, শুধু পরিবর্তন হয়েছে দখলকারী। আর দেয়ালে যুবলীগের বদলে আঁকা হয়েছে যুবদলের নাম ও লোগো।
এভাবে দখলে হাত বদল হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের শেষ নেই। তারা বলছেন- আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। শুধু দখলের হাত বদল হয়েছে।
তবে শিগগিরই এ ঘটনার তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন লালমাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এহসান মুরাদ।
কুমিল্লা থেকে নাঙ্গলকোট উপজেলার যোগাযোগের অন্যতম পথ বাঙ্গড্ডা সড়ক। দুই লেনের ব্যস্ততম সড়কটির গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে পরিচিত লালমাই উপজেলার ভুশ্চি বাজার।
২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সেখানে সড়কের পশ্চিম পাশে পথচারী ও যাত্রীদের জন্য একটি ছাউনি নির্মাণ করা হয়।
জেলা পরিষদের অর্থায়নে নির্মিত ছাউনিটি যাত্রীদের কল্যাণে ভালো ভূমিকাও রেখেছিল। যাত্রী ছাড়াও ওই বাজারের আসা লোকজন ছাউনিটিতে বসে বিশ্রামের সুযোগ পেতেন।
তবে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার কয়েক মাস পরেই যাত্রী ছাউনিটির দিকে চোখ পড়ে স্থানীয় যুবলীগ নেতা কামরুজ্জামান মজুমদার ওরফে লিটনের।
তিনি ভুলইন দক্ষিণ ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ও ভুশ্চি বাজার পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতির পদে ছিলেন।
কামরুজ্জামান মুক্তিযোদ্ধাদের নাম করে ছাউনি দখলের পর সেখানে নির্মাণ করেন যুবলীগের কার্যালয়। গত ১৬ বছর তা নিজের কবজায় রেখেছিলেন তিনি।
সম্প্রতি বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের শুরুর দিকেই সেটি দখলে নেন কামরুজ্জামান।
প্রথমে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সার্বিক উন্নয়ন সংস্থা’ নামে একটি সাইনবোর্ড লাগিয়ে ছাউনিটি ব্যবহার শুরু করেন তিনি। তবে সেখানে কোনো মুক্তিযোদ্ধাই বসতেন না। বরং যুবলীগের কার্যালয়ের নামে নিজের ব্যক্তিগত কার্যালয় হিসেবেই সেটি ব্যবহার করতেন তিনি।
নির্মাণের সময় ছাউনিটির একটি অংশ যাত্রীদের বসার ব্যবস্থা ছিল। আর আরেকটি অংশে একটি দোকান ছিল। দখলের পর রাতারাতি দোকানের দেয়াল ভেঙে এবং সামনে আরও কিছু অংশ বাড়িয়ে পুরো জায়গাটি দখল নিয়ে ফেলেন তিনি।
এতে ছাউনির আকার পরিবর্তন হয়ে যায়। পরে যাত্রী ও পথচারীরা যেন ওইদিকে যেতে না পারে সেজন্য সড়কের পাশে দেড় ফুট উচ্চতার দেয়ালও তোলেন তিনি।
বাজারে কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল না যুবলীগ নেতা কামরুজ্জামানের। ক্ষমতার প্রভাবে তিনি যাত্রী ছাউনিকে নিজের ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে বাজার পরিচালনা কমিটির সভাপতির পদ বাগিয়ে নেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, ছাউনিটি ছিল আসলে কামরুজ্জামান মজুমদারের টর্চারসেল। চাঁদার জন্য মানুষকে তুলে এনে এখানে নির্যাতন করতেন তিনি। সাবেক অর্থমন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্য আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছের লোক হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কেউ ভয়ে কথা বলত না।
ওই যাত্রী ছাউনিতে বসেই বাজারের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা উত্তোলন করা হত। বিশেষ করে সপ্তাহের প্রতি মঙ্গল ও শনিবার হাটের দিন বেপরোয়াভাবে চাঁদা উত্তোলন করতেন ওই যুবলীগ নেতার অনুসারীরা।
তবে গত ৫ আগস্ট তীব্র গণআন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের যুবলীগ নেতা কামরুজ্জামান এলাকা থেকে গাঢাকা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। এসব বিষয়ে জানতে তার মোবাইলে একাধিক কল করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
এই সুযোগে গত প্রায় এক সপ্তাহ আগে যাত্রী ছাউনিটি নতুন করে দখল করে নিয়েছেন মাকসুদুর রহমান ওরফে মাসুদ নামে স্থানীয় এক যুবদল নেতা।
মাসুদ উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য হলেও পোস্টার, ব্যানারে নিজেকে লালমাই উপজেলা যুবদলের ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব হিসেবে পরিচয় দেন।
এরই মধ্যে অনুসারীদের নিয়ে ছাউনিটিতে রং করিয়েছেন মাসুদ। ভেতরের তিনটি দেয়ালে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী যুবদল’ লিখে দলীয় লোগো আঁকা হয়েছে। যুবলীগের ব্যবহৃত আসবাবপত্রও অন্যত্র সরিয়ে নেন যুবদলের নেতাকর্মীরা।
যুবদল নেতা মাকসুদুর রহমানও যাত্রী ছাউনিটি দখলে নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তবে তার ভাষ্য, যুবলীগ নেতার কবজায় থাকা যাত্রী ছাউনিটি ‘উদ্ধার’ করেছেন তিনি।
ছাউনিটিকে লালমাই উপজেলা যুবদলের কার্যালয় দাবি করে তিনি বলেন, “যুবলীগের দখল থেকে ১৬ বছর পর এটি উদ্ধার করেছি আমরা। এটি এখন আমাদের দলীয় কার্যালয়।”
যুবদলের এই নেতা আরও দাবি করেন, “শুরুতে যাত্রী ছাউনির ভেতরে থাকা দোকানটি আমাদের দলেরই আবদুল মালেক নামে একজন ইজারা এনেছিলেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই সেটি দখল হয়ে যায়।
তিনি প্রশ্ন করেন, “লালমাই উপজেলায় এমন অনেক দখল করেছে আওয়ামী লীগ। এতো বছরতো এগুলো নিয়ে কেউ কোনো কথা বলেনি। তাহলে এখন কেন?”
যুবদল নেতা মাকসুদুর বলেন, “প্রশাসন বিষয়টি তদন্ত করে দেখুক। তারা যদি মনে করে একটি অংশ যাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে, তাহলে সেটি আমরা দেব। আমরা মানুষের জন্য এটি উদ্ধার করেছি।”
এবিষয়ে সামছুল আলম নামে লালমাই উপজেলার এক বাসিন্দা বলেন, “অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। দখলে শুধু হাত বদল হয়েছে। লালমাই উপজেলার আরও বিভিন্ন স্থানেও এভাবে দখল-পালটা দখল হচ্ছে। ওই যুবদল নেতা চাইলে জনগণকে যাত্রী ছাউনিটি ফিরিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনিও যুবলীগের মতোই আচরণ করেছেন।”
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় আরেক বাসিন্দা বলেন, আগে আওয়ামী লীগের ভয়ে কেউ কথা বলেনি। আর এখন বিএনপির ভয়ে কেউ কথা বলছে না। দখলের মাঠে যুবলীগের মতো যুবদলকে দেখে হতাশ ভুশ্চি বাজারের ব্যবসায়ীরা। আমাদের দাবি যাত্রী ছাউনিটিকে যাত্রী ও পথচারীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক।
এ প্রসঙ্গে লালমাই উপজেলা যুবদলের সদস্য সচিব মাহফুজুর রহমান বলেন, “মাকসুদুর রহমান আমাদের কমিটির সদস্য। ভুশ্চি বাজারটির অবস্থান উপজেলা সদরে নয়। সেখানে যুবদলের উপজেলা কার্যালয় হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এই দখলের সঙ্গে দলের কোনো সম্পর্ক নেই।”
তিনি আরও বলেন, “আমি বিষয়টি ভালোভাবে জানি না। যদি দখল হয়ে থাকে, তাহলে সেটি তিনি ব্যক্তিগতভাবে করেছেন। আমি বিষয়টি দলের সিনিয়র নেতাদের জানাব। আশা করছি, তারা এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।”
আর শিগগিরই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন লালমাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এহসান মুরাদ।
তিনি বলেন, “বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি এখানে সম্প্রতি এসেছি। তবে খোঁজ নিয়ে শিগগিরই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। যাত্রী ছাউনি এভাবে দখল করে রাখার কোনো সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।”