কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের সুগন্ধা ও সি-গাল পয়েন্টের মাঝামাঝি বালিয়াড়িতে দাঁড়িয়ে আছে প্লাস্টিকে তৈরি ভয়ঙ্কর এই ‘দানব রোবট’।
Published : 04 Dec 2024, 08:45 PM
প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে প্রদর্শিত হচ্ছে বিশাল আকৃতির একটি ‘দানব’।
সমুদ্র উপকূল থেকে সংগৃহীত পরিত্যক্ত প্লাস্টিক দিয়ে একদল স্বেচ্ছাসেবী এই ‘দানবটি’ তৈরি করেন। এই ‘দানব’ প্লাস্টিক দূষণে প্রাণ-প্রকৃতির বিরূপতার সাক্ষ্য দিচ্ছে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে নির্মিত সৈকতের সুগন্ধা ও সি-গাল পয়েন্টে প্রদর্শিত হচ্ছে এ ‘দানব’ ভাস্কর্যের।
বুধবার সকাল ১০টায় ভাস্কর্য উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন।
এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিজাম উদ্দিন আহমেদ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. ইয়ামিন হোসেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) মো. জসীম উদ্দিন চৌধুরী, ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার অঞ্চলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান ও বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের পরিচালনা কমিটির সদস্য জামাল উদ্দিন।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের সুগন্ধা ও সি-গাল পয়েন্টের মাঝামাঝি বালিয়াড়িতে দাঁড়িয়ে আছে প্লাস্টিকে তৈরি ভয়ঙ্কর এক ‘দানব রোবট’। যে দানবটি রক্ত-মাংসহীন প্রতীকী হলেও যার হিংস্র থাবায় প্রতিনিয়ত ক্ষত-বিক্ষত মানবদেহ, প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্য। সৈকতে ঘুরতে আসা যে কেউ এটি প্রথম দর্শনে মনে ভয় বিরাজ করলেও কাছে যেতেই সে ভয় কেটে যাবে। আর জানবে দানবটির দেহে বয়ে বেড়ানো প্লাস্টিক দূষণে প্রাণ-প্রকৃতির ক্ষতির মাত্রা।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন ও কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিনই সমাগম ঘটে লাখো পর্যটকের। যারা সৈকতের বালিয়াড়ি ও সাগরের পানিতে ফেলছে প্লাস্টিক পণ্য সামগ্রীর বর্জ্য। এতে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে দূষণ এবং হুমকির মুখে পড়ছে সামুদ্রিক জীব ও মানবজীবন।
আর প্রাণ-প্রকৃতির দূষণ রোধে এবং সচেতনতা সৃষ্টিতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন নিয়েছে প্লাস্টিক বর্জ্যে তৈরি দানব ভাস্কর্যের প্রদর্শনীর মত ভিন্নধর্মী এ উদ্যোগের।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন বলেন, “প্লাস্টিক যে দানবের মত সমুদ্র ও জনজীবন ধ্বংস করছে এবং ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকা এই ভয়াবহতা যে দ্রুতই রুখে দিতে হবে। এই সতর্কতা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যই ভাস্কর্য প্রদর্শনীর এই উদ্যোগটি নেওয়া হয়েছে।”
এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে মানুষ প্লাস্টিক ব্যবহারের আরো সতর্ক হবেন বলে আশা করেছেন তিনি।
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মুহম্মদ নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় যে কোনো মহৎ উদ্যোগে প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে এবং থাকবে। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনকে সঙ্গে নিয়ে জেলা প্রশাসনের এই উদ্যোগে স্থানীয় জনগণ এবং পর্যটকরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। সমুদ্র সৈকতে প্লাস্টিক না ফেলে এক্সচেঞ্জ স্টোরে জমা করেছে, যা প্লাস্টিক দূষণ রোধে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের পরিচালনা কমিটির সদস্য জামাল উদ্দিন বলেন, “বর্তমান সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয় প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। সরকারের পলিসির সঙ্গে সমন্বয় করে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন সারাদেশ থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে ৫০০ টন পরিত্যক্ত প্লাস্টিক রিসাইকেল করার উদ্যোগ নিয়েছে।”
“এতে করে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সরকারি খরচ যেমন কমবে, তেমনি মানুষও জানতে পারবে কীভাবে রিসাইকেলের মাধ্যমে বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তর করা যায়।”
দেশব্যাপী এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে কক্সবাজারে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় চার মাসব্যাপী প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন কাজ করে যাবে বলে জানান স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের এ কর্মকর্তা।
ভাস্কর্যটি নির্মাণে ৭ নভেম্বর থেকে কাজ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের আট শিল্পী এবং ২০ স্বেচ্ছাসেবক। মঙ্গলবার রাতেই তারা ভাস্কর্যটির নির্মাণকাজ শেষ করেছেন।
এটি নির্মাণের দলনেতা ভাস্কর ও শিল্পী আবীর কর্মকার বলেন, বিদ্যানন্দের ভিন্নধর্মী উদ্যোগ প্লাস্টিক দানবটি তৈরি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের একদল শিল্পী। এতে তারা প্লাস্টিক বর্জ্যের পাশাপাশি ব্যবহার করেছেন কাঠ, পেরেক ও গামসহ আরো কয়েকটি উপকরণ।
ভাস্কর্য শিল্পীদের দাবি, এটি ওসান প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি বিশ্বের সর্ববৃহৎ “রোবট দানব”। এটির উচ্চতা ৬২ ফুট। এটি বানাতে প্রায় ১০ মেট্রিক টন প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়েছে। বিশাল আকৃতির দানবটির পাশে রয়েছে ১৫ ফুট উচ্চতার ছোট আকৃতির আরো দুটি দানব।
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের দায়িত্বরত স্বেচ্ছাসেবক মুহাম্মদ মুবারক জানান, গত প্রায় এক মাস ধরে কক্সবাজার, ইনানী ও টেকনাফের সেন্টমার্টিন সমুদ্র সৈকত থেকে সংগ্রহ করেছে অন্তত ১০ টন সামুদ্রিক প্লাস্টিক বর্জ্য। এসব বর্জ্য দিয়ে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে নির্মাণ করেছেন এ ‘প্লাস্টিক দানব’।
৭ নভেম্বর কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের জন্য ‘প্লাস্টিক এক্সচেঞ্জ স্টোর’ ও স্থানীয়দের জন্য ‘প্লাস্টিক এক্সেঞ্জ মার্কেট’ উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন।
যেখানে প্লাস্টিক বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেওয়া খালি পাত্র, বোতল ও পলিথিনের প্যাকেটের বিনিময়ে যে কেউ নিতে পারবেন চাল, ডাল, তেল, চিনি ও লবণসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি এবং পর্যটকরা জিতে নিবেন বই, কলম, ক্যাপ ও ব্যাগসহ বিভিন্ন উপহার। এই কার্যক্রম থেকেই মূলত ১০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ হয়।
এদিকে বুধবার প্লাস্টিক বর্জ্যে নির্মিত এ দানবটি দেখতে ভিড় করেছেন সৈকতে ঘুরতে আসা পর্যটকরা।
ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে ঘুরতে আসা পর্যটক শরীফুল ইসলাম বলেন, এটি দেখতে এসে মানুষ দৈত্য-দানবের ভয়ঙ্কর রূপের মত প্লাস্টিক বর্জ্যের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন হবেন। পাশাপাশি নিজেরাও প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারে সজাগ থাকবেন। বিদ্যানন্দের ভিন্নধর্মী এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়। এতে মানুষ প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত হবেন।
২০২২ সালে সর্বপ্রথম কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ‘প্লাস্টিক দানব’ নির্মাণ করে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। এবার সেই দানব আরো ভয়ঙ্কর রূপে ফিরে এসেছে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে আরো দুইটি দানব। তার মানে সমস্যা কমেনি বরং আরো বেড়েছে।
সমুদ্র থেকে উঠে আসা এই দানব মানবজাতিকে ধীরে ধিরে গ্রাস করছে। পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করছে। মানুষ যদি সচেতন হয়ে প্লাস্টিক ব্যবহার কমিয়ে দেয় ও রিসাইকেল করে তবেই এই দানব থেকে মুক্তি মেলবে।
এই ভাস্কর্য নির্মাণে সার্বিক সহযোগিতা দিয়েছে সৃষ্টিশীল প্রতিষ্ঠান পপ-ফাইভ অ্যাডভারটাইজিং লিমিটেড।