“২০২৫ এ যে অর্থনীতি একেবারে সচল হয়ে সমৃদ্ধিশীল হয়ে যাবে ওইটা তো সম্ভাবনা খুবই কম। অর্থনীতি ঘুরে যদি দাঁড়াতে পারে এবং সমৃদ্ধির পথে চলা শুরু করতে পারে, তাহলেই বলব আমরা ঠিক আছি,” বলেন একজন অর্থনীতিবিদ।
Published : 31 Dec 2024, 03:35 AM
অর্থনীতিতে অস্বস্তি আগেও ছিল, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ বছরের প্রথমার্ধে তা নিদারুণভাবে টের পেয়েছে; আর সরকার পতনের পর বেরুতে থাকা বড় বড় ক্ষতে সংস্কারের প্রলেপ লাগিয়ে সাধারণের জীবনযাত্রায় স্বস্তি আনার মূল চ্যালেঞ্জের মধ্যে আসছে নতুন বছর।
সঙ্গীন অর্থনীতিকে গতিশীল করে প্রবৃদ্ধির ফুটো হয়ে যাওয়া ফানুসকে কাঙ্খিত পথে টেনে তোলার কঠিন এ কাজ অন্তর্বর্তী সরকারকে যেমন এগিয়ে নিতে হবে, তেমনি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির ঘেরাটোপের মধ্যেই ব্যবসা-বাণিজ্য আর বিনিয়োগকেও চাঙ্গা করতে হবে।
ঊর্ধ্বমুখী দ্রব্যমূল্যকে বাগে এনে সাধারণের মধ্যে স্বস্তি আনা আর কর্মসংস্থান ও সরকারি ব্যয় বাড়ানোর পথ খুঁজতে হবে বছরের শুরু থেকেই। বছরজুড়ে অর্থনীতিকে পেছনে টেনে ধরা অন্য সব সূচকের পাশাপাশি পোশাকসহ শিল্প-কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ, বিদ্যুৎ-জ্বালানির সরবরাহ সংকট, ব্যাংকে তারল্য সংকট, উচ্চ সুদহার, খেলাপি ঋণে উল্লম্ফনের মত কাঁটা সরানোর দিকেও মনোযোগ দিতে হবে।
তবে কাজগুলো খুব সহজ হবে না নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য। সরকারি ব্যয় সামলাতে রাজস্ব আহরণ বাড়ানো আর অর্থনীতির ভিত্তি ঠিক রাখতে রিজার্ভের ক্ষয় ঠেকিয়ে তা ঊর্ধ্বমুখী রাখার হিসাব কষা জটিলই; সঙ্গে রয়েছে ক্ষমতার পালাবদল ও রাজনৈতিক মেরুকরণের বিষয়াদিও।
বছরজুড়ে অর্থনীতির সবই যে আশাহত করার মত ছিল তা নয়। খারাপ হওয়ার আভাস দিয়েও অর্থনীতিতে স্বস্তি ধরে রেখেছে রপ্তানি আয়। আর রেমিটেন্স দেখিয়েছে আশার জায়গা।
বছর শেষের এমন প্রেক্ষাপটে পেছন পানে ফিরে দেখার বদলে অনিয়মের জঞ্জাল সরিয়ে নতুন লক্ষ্যে এগিয়ে চলার তাগিদ থেকেই অর্থনীতির মেরামতে ছুটতে হবে অর্থ উপদেষ্টা আর তার দলবলকে। ভঙ্গুর অর্থনীতিকে নতুন দিশা দেওয়ার সেই সুযোগ ও সম্ভাবনা তাদের সামনে আছে। ক্ষমতার পালাবদলে আর্থিক খাতের সর্বত্র পরিবর্তন এসেছে; বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সব নিয়ন্ত্রক সংস্থায় পরিচিত মুখ বদলে গেছে, নতুনদের ক্ষমতায়নও করা হয়েছে। দায়িত্ব পেয়ে সবাই সংস্কারের হাওয়ায় বদলে ফেলার মন্ত্রে পথ চলতে শুরু করলেও বছর শেষে আশাবাদী হওয়ার মত চিত্র এখনও সামনে আসছে না।
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন বছরকে তারা বাংলাদেশের অর্থনীতির পাঠে একটি মাইলফলক বছর হিসেবে পরিচিত করে তুলতে পারেন; অবারিত সুযোগ তাদের সামনে। সাধারণ জনগণসহ সবার আকাঙ্খাও অনিয়মের কলঙ্ক থেকে অর্থনীতিকে মুক্ত করে কল্যাণমূলক দিকে নিয়ে যাওয়ার কাজটি যাতে এবার হয়।
এক বছরেই যে তা আমূল বদলে যাবে তেমনটি ভাবছেন না বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। বলেন, “২০২৫ এ যে অর্থনীতি একেবারে সচল হয়ে সমৃদ্ধিশীল হয়ে যাবে ওইটা তো সম্ভাবনা খুবই কম।
“অর্থনীতি ঘুরে যদি দাঁড়াতে পারে এবং সমৃদ্ধির পথে চলা শুরু করতে পারে, তাহলেই বলব আমরা ঠিক আছি।”
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে জোর কদমে ঢুকে যাওয়া চব্বিশের জুলাই-অগাস্টের গণআন্দোলনের সুফল পেতে তাই ২০২৫ সাল অর্থনীতির বিবেচনাতেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শেষ হতে যাওয়া ঘটনাবহুল বছর যেমন শুরু হয়েছিল নির্বাচনি ডামাডোলে; নতুন বছরেও ভোটের ঢাকঢোল মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে অনেক কিছুর। রাজনীতির মাঠের হাওয়ায় তেমন কথাবার্তা ভেসে বেড়াতে শুরু করেছে। যে কারণে নতুন বছরের অর্থনীতিতে রাজনীতিও থাকবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে।
এদিকে সর্তক দৃষ্টি রেখে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার পূর্ব শর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এটা নিয়ে অনিশ্চয়তা যদি থেকেই যায়, রাজনৈতিক দলগুলো রাস্তাঘাটে নামা শুরু করে, তখন কিন্তু অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয় না।
“রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলেই যে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে তা বলা যায় না; কিন্তু না থাকলে যে আসবে না, তা নিশ্চয়তা দেওয়া যায়।”
এর পাশাপাশি নতুন বছরে ‘খাদ্য সংস্থানে’ গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক হুমায়রা ফেরদৌস।
তিনি বলেন, ‘‘মূল্যস্ফীতির চাপ না কমা ও ব্যবসায়ীদের আস্থা না ফেরায় সামনের দিকে বড় চ্যালেঞ্জ হবে খাদ্য সংস্থান। উৎপাদন বাড়াতে না পারলে সমস্যা আরও বাড়বে। কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে যে কোনোভাবেই।’’
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান জোর দিয়েছেন অর্থনীতির শক্ত ভিত তৈরির ওপর। তার মতে, এটি করা গেলে পরে সব ঠিক হয়ে যাবে।
“একটু স্বল্প প্রবৃদ্ধি মেনে নিতে হবে আগামী বছরের জন্যও।”
নতুন বছরে এজন্য প্রথমেই অর্থনীতির প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রাজস্ব খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে রাজস্ব আহরণ ঊর্ধ্বমুখী রেখে আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতের তাগিদ দেন তিনি।
বছরজুড়ে ভোগাল মূল্যস্ফীতি
বছরের শুরুটাই হয়েছিল অর্থনীতিতে একগাদা সংকট নিয়ে; নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা জেরবার করে দিয়েছিল সীমিত আয়ের মানুষের জীবন। সরকার পতনের পর তাদের মধ্যে জিনিসপত্রের দাম কমে আসা নিয়ে প্রত্যাশার যে বুদবুদ উঠেছিল তা মিইয়ে গেছে অল্প দিনেই। একইসঙ্গে গতি হারিয়েছে অর্থনীতিও, যা মূল্যস্ফীতিকে বাগে আনার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চড়তে থাকা মূল্যস্ফীতির যাতাকলে সারাবছর মানুষের ওপর যেমন চাপ ছিল, তেমনি সরকারও ছিল বেকায়দায়। ক্ষমতার পালাবদলে সৃষ্ট অস্থিরতা তা শুধু খারাপ হওয়ার বার্তা দিয়েছে বছরের শেষ অর্ধেও। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে বারবার নীতি সুদহার বাড়ানোয় হোঁচট খাচ্ছে বিনিয়োগ, উৎপাদন আর ব্যবসা-বাণিজ্যও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না।
পণ্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৯ এর নিচে নামেনি বছরজুড়ে। সবচেয়ে কম ছিল ফেব্রুয়ারিতে ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ; আর আন্দোলনের মাস জুলাইয়ে গিয়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে ঠেকে। এর পরের দুই মাস কিছুটা কমলেও নভেম্বরে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এরমধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে নভেম্বরে ১৪ শতাংশ ছুঁইছুঁই হয়ে যায়।
অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকারের নীতি সুদহার বাড়ানোর ইতিবাচক ফল পেতে সময় লাগবে। এর আগে সরবরাহ চেইন ও বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে হবে।
“বাজারে এখনও সিন্ডিকেটের খবর পাই, এটা কিন্তু বন্ধ করা যায়নি। সরবরাহ চেইনে চাঁদাবাজি এখনও আছে।”
সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য বড় মাথাব্যথা তৈরি হওয়া মূল্যস্ফীতির এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক আবু ইউসুফ বাজার ব্যবস্থাপনাকে দায়ি করে এ ক্ষেত্রে সরকারের আরও মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন।
সীমিত আয়ের মানুষকে নিদারুণ কষ্ট থেকে রক্ষায় সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি।
অনিয়মের ক্ষত
উত্তরাধিকার সূত্রে অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতি কোন হালে পেয়েছে তা উঠে এসেছে শ্বেতপত্রের পরতে পরতে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলে দুর্নীতি ও অনিয়মের বলি হয়েছে দেশের অর্থনীতি- প্রথমবারের মত তৈরি এ প্রতিবেদনে সেসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে সবিস্তারে।
উন্নয়ন বাজেটের ৪০ শতাংশ অর্থ ‘তছরুপ’, প্রতিবছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার বা এক লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা বিদেশে ‘পাচার’; অনিয়ম-কারসাজি করে ব্যাংক ও পুঁজিবাজার থেকে অর্থ লোপাট; বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতির তিন বিলিয়ন ডলার অবৈধ লেনদেনসহ সব খাতে দেদারসে ‘ঘুষ ও দুর্নীতির’ চিত্র বর্ণনা করা হয়েছে ৪০০ পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদনে।
এ প্রতিবেদন ১ ডিসেম্বর সরকারের কাছে জমা দেওয়ার দিন প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “শেখ হাসিনার শাসনামলের ‘দুর্নীতি, লুণ্ঠন এবং ভয়ংকর রকমের আর্থিক কারচুপির’ চিত্র রিপোর্টে পাওয়া গেছে তা আতঙ্কিত হওয়ার মত।”
সুবিধাভোগীদের লোভের বলি ব্যাংক খাত
কারসাজি ও জালিয়াতিতে বছরের পর পর বছর ধরে সরকারের সুবিধাভোগী ও প্রভাবশালীরা টাকা বের করে নিয়ে যাওয়ায় খেলাপি ঋণের স্তূপের নিচে চাপা পড়ার অবস্থা ব্যাংক খাতের। নতুন অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নর দায়িত্ব নিয়ে অতীতের অনিয়ম-দুর্নীতির কথা বলছেন; সংস্কারের কথাও জোরেশোরে উচ্চারণ করছেন।
পালাবদলের হাওয়ায় গভর্নর ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ সব পদে বদল এসেছে। আগের সরকারের সুবিধা নিয়ে অনিয়ম ও কারসাজির কেন্দ্র হয়ে ওঠা সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকের নেতৃত্বেও ঢেউ লেগেছে পরিবর্তনের।
গভর্নরের দায়িত্ব নিয়ে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর আলোচিত-সমালোচিত ব্যবসায়ী এস আলম ও ব্যাংক খাতের মোড়ল হিসেবে পরিচিত নজরুল ইসলাম মজুমদারের নিয়ন্ত্রণ থেকে যথাক্রমে ইসলামী ও এক্সিম ব্যাংকসহ ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ মুক্ত করে দেন। নতুন পর্ষদের পাশাপাশি প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয় এগুলোতে।
ঋণ কেলেঙ্কারি ও খেলাপি ঋণে ন্যুব্জ ব্যাংকিং খাত সংস্কারে ছয় সদস্যের টাস্কফোর্সও করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
তবে পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি এখনও হয়নি। অনেকগুলো ব্যাংক নগদ টাকার সংকটে খাবি খাচ্ছে। ডলারের দাম এক লাফে ১০ টাকা বাড়ানোর কয়েক মাস না যেতেই নতুন করে আরও বাড়তে শুরু করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ব্যাংক খাতে সংস্কার ও নানা উদ্যোগের মধ্যে খেলাপি ঋণ আরও বেড়েছে; সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা। মোট বিতরণ করা ঋণের যা ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮২১ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল।
আগের প্রান্তিক থেকে জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে এ অঙ্ক বেড়েছে প্রায় ৭৪ হাজার কোটি টাকা, যা আগের তিন মাসের তুলনায় আড়াই গুণেরও বেশি।
ব্যবসায়ী নেতা পোশাক খাতের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ২০২৫ সালে সংস্কারের ছাপ দেখতে চান ব্যাংক খাতের পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরে। বলেন, আর্থিক খাত বিশেষ করে ব্যাংক ও কাস্টমস আইন সংস্কার বেশি জরুরি।
রেমিটেন্সে স্বস্তি, রিজার্ভে চাপ
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আগের দেনা পরিশোধে আকু পেমেন্ট করলে বিপিএম ৬ হিসাবে রিজার্ভ নেমে যায় ১৯ বিলিয়নের নিচে। দুই মাস ধরে এর আশপাশে থাকার মধ্যে ডলার কিনে তা বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয় বাংলাদেশ ব্যংক। এতে ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে এ সরকারের সময়ে প্রথমবার তা ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়।
আইএমএফের শর্ত মানতে ডিসেম্বর শেষে নিট রিজার্ভ থাকতে হবে ১৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার। এজন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে থাকা অতিরিক্ত ডলার কিনছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে নতুন করে ডলারের দর বাড়তে শুরু করেছে।
রিজার্ভ নিয়ে গত কয়েকবছর থেকে চলতে থাকা এ চাপ থেকে কঠিন এসময়ে কিছুটা স্বস্তি মিলছে ব্যাংকিং চ্যানেলে আসা রেমিটেন্স বাড়তে থাকায়।
এর সঙ্গে রপ্তানি আয়ও ইতিবাচক ধারায় থাকায় এর সুফল অর্থনীতিতে কাজে লাগানোর কথা তুলে ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক আবু ইউসুফ বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়াতে পারলে রিজার্ভ সংকটের পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব।
রিজার্ভের সংকট কাটাতে তিনি উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে হওয়া বড় ঋণ চুক্তির অর্থ দ্রুত ছাড় করার পরামর্শ দেন।
চলতি বছর মার্চ ও জুলাই ছাড়া প্রতি মাসে দুই বিলিয়নের ওপর প্রবাসী আয় এসেছে।
চলতি বছর মে মাসে ডলারের বিনিময় হারে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালুর পর ১০ টাকা বেড়ে প্রতি ডলার এখন ১২০ টাকা। সবশেষ কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, রেমিটেন্স কিনতে ১২৩ টাকাও দিতে পারবে ব্যাংক। এ কারণেই ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলার আসছে বেশি বলে মনে করেন সিটিজেনস ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মাসুম।
স্থবির বিনিয়োগে উচ্চ সুদহারের কোপ
শুধু বিদেশি বিনিয়োগে ভাটার টান এ বছরেও বজায় রয়েছে তা নয়। বছরের শুরুতে প্রথমে নির্বাচন এবং মাঝামাঝিতে আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহে দেশি উদ্যোক্তারা ছিলেন অতি সতর্ক। সেই অবস্থার এখনও বদল হয়নি। সুদহার চড়তে থাকার মধ্যে শ্রম অসন্তোষের একের পর এক ঘটনায় দেশি-বিদেশি সব বিনিয়োগকারীরা এখনও চুপচাপ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে নিট বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে ১ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার, আগের ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে যা ছিল ১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে কমেছে ১৪২ মিলিয়ন ডলার।
বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ব্যাংক ঋণের সুদহার ব্যবসার মুনাফার হারের সঙ্গে সাজুয্য রেখে নির্ধারণের দাবি করে বলেন, সুদহার বেশি হলে বিনিয়োগ কমে যাবে। এটি ১৪ শতাংশের বেশি হওয়ায় এখন কোনোমতে ব্যবসা টিকেয়ে রাখা হচ্ছে। যারা বেশি সুদে ঋণ নিয়েছে, তারাই খেলাপি হয়েছে।’
কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বিনিয়োগে ধারাবাহিকতা রক্ষায় ব্যবসায়ীদের আস্থা ফেরাতে সরকারকে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।
এডিপি বাস্তবায়নে ভাটা
জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ঘিরে নৈরাজ্য আর আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে সরকারের পতন ঘটলে উন্নয়ন কর্মসূচি ধাক্কা খায়। আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালকরা গা ঢাকা দেন। পালায় দলটির ঠিকাদাররাও। প্রকল্পের কাজ থেমে যায় মাঝপথে।
এতে সরকারি উন্নয়ন কার্যক্রম পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়ার চিত্র উঠে এসেছে চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে এডিপি বাস্তবায়নের তথ্যে। এসময়ে কাজের অগ্রগতির হার ১২ দশমিক ২৯ শতাংশ; যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১৭ দশমিক ০৬ শতাংশ। প্রথম পাঁচ মাসে এডিপির অগ্রগতি এত কম হওয়ার তথ্য নেই গত ১৫ অর্থবছরেও।
কৃচ্ছতা সাধনসহ বিভিন্ন কারণে সরকারি ব্যয় কমে যাওয়ার প্রভাব পড়ছে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতেও।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, এডিপি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে 'সিলেক্টিভ প্রজেক্ট' নিতে হবে।
ঋণাত্মক রাজস্ব আহরণ বাড়াচ্ছে চিন্তা
চলতি অর্থবছরে বাজেটে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু জুলাই থেকে শুরু হওয়া অস্থির সময়ে প্রবৃদ্ধি তো দূরের কথা এখনও নেতিবাচক ধারা থেকে বের হতে পারেনি এনবিআর।
সবশেষ হালনাগাদ পরিসংখ্যান বলছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে এনবিআর আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১ দশমিক ০৩ শতাংশ কম রাজস্ব আহরণ করতে পেরেছে, যেখানে আগের বছর একই সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। একক মাস হিসাবে গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের অক্টোবর থেকে চলতি অর্থবছরের অক্টোবরে রাজস্ব আদায় শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ বাড়লেও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির এ ধারা থেকে বেরিয়ে আসা যায়নি।
আমদানি, রপ্তানি ও উৎপাদনসহ অর্থনীতির সব সূচক যখন ধীরগতিতে চলছে, তখন এসবের বিপরীতে রাজস্ব আহরণ কম হওয়ার ধারা অব্যাহত থাকাই স্বাভাবিক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এর মধ্যেই বেড়েছে আইএমএফের চাপ। সংস্থাটি ঋণের চতুর্থ কিস্তি দেওয়ার আগে চলতি অর্থবছরে কর-জিডিপি অনুপাত শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ বাড়ানোর কঠিন শর্ত দিয়েছে।
সিপিডির গবেষক তৌফিকুল ইসলাম বলেন, কঠিন পদেক্ষেপের সংস্কারের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে সরকারকে। রাজস্ব আদায় বাড়াতে কর ছাড় কমিয়ে দেওয়ার দিকে যাচ্ছে। এজন্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক ধরনের অনাস্থা কাজ করতেও পারে। তবে কর ফাঁকি রোধ না করতে পারলে রাজস্ব আদায় বাড়বে না।
রপ্তানি আয়ে সুবাতাসে শ্রম অসন্তোষের ধাক্কা
প্রকৃত রপ্তানির চেয়ে আয় বেশি দেখানোর বিতর্কও বছরজুড়ে ছিল আলোচনায়। আগের প্রচলিত হিসাব বদলে যাওয়ার তথ্য প্রকাশিত হলে তা চমকে দেয় সবাইকে; রপ্তানি আয় ও আগের দেওয়া তথ্যের মধ্যে ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ফারাকের চিত্র সামনে আসে। এরমধ্যেই ঘটে সরকারের পালাবদল। আন্দোলন আর সহিংসতার প্রভাব পড়ে তৈরি পোশাকসহ রপ্তানিমুখী খাতে। শ্রম অসন্তোষে একের পর এক কারখানা বন্ধ থাকে অনেক দিন। এতে বাড়তি চাপ তৈরি হয় শিল্পখাতে।
তবে সরকার বদলের আগে-পরে অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক নানা কারণে রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার শঙ্কার কথা বলা হলেও তা হয়নি। ক্রেতাদের বিমুখ হওয়ার তথ্য আসার মধ্যেই আয় বাড়ার তথ্য এসেছে; সবশেষ পাঁচ মাসে রপ্তানি আয় ছাড়িয়েছে দুই হাজার কোটি ডলার।
শ্রম অসন্তোষ সমস্যা কেটে গেলে তৈরি পোশাক রপ্তানি আরও বাড়তে পারে বলে আশা করছেন নিট পোশাক খাতের ব্যবসায়ীদের নেতা মোহাম্মদ হাতেম।
তবে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে আমদানি বাড়ানোর পরামর্শ এসেছে উন্নয়ন অর্থনীতির শিক্ষক আবু ইউসুফের তরফে। বলেন, এখন এলসি খুলতে কিছুটা হলেও বিধিনিষেধ আছে। বিনিময় হার স্থিতিশীল হয়নি। চাহিদা অনুযায়ী সহজেই ডলার পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। এগুলোর সমাধান করতে হবে।
প্রবৃদ্ধির পিছুটান, ‘সামাজিক ব্যয় বাড়াতে হবে’
চলতি অর্থবছরের বাজেটে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ আশা করেছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হারে অর্থনীতির সম্প্রসারণ ঘটাবে। তবে সার্বিক অর্থনীতির ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকার তা ৫ দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে।
সেটিও সম্ভব হবে না বলে মনে করছে ঋণ সহায়তা নিয়ে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানো আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ। চতুর্থ কিস্তিরি টাকা ছাড়ের আগে সম্প্রতি ঢাকা সফরের পর সংস্থাটির পূর্বাভাস বলছে, এ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৮ শতাংশের বেশি আশা করা যায় না।
এমন প্রেক্ষাপটে সংস্কারের চাপ সামলে অর্থনীতিতে গতি আনার ক্ষেত্রে নতুন বছরে সরকারি ব্যয় বাড়ানোর চেয়েও তা ’যৌক্তিকীকরণ’কে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন ঢাকায় বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। যৌক্তিকীকরণের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “যেগুলো অপচয় আছে সেগুলো কমানো, মানে সেগুলো বাজেট থেকে একদম বাদ দিয়ে দেওয়া।”
তার মতে, “ব্যয়বৃদ্ধির জায়গা হচ্ছে সামাজিক খাতগুলো। বর্তমানে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে অর্থনীতি। সেটা মোকাবেলার সক্ষমতা যেন নিম্ন আয়ের মানুষের থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষাখাতে ব্যয় বাড়াতে হবে, যাতে স্কুলে যাওয়া বন্ধ না হয়। খাদ্য কিনতে হবে তাই স্কুলের বই কিনছে না বা কলম কিনতে পারছে না। টিউশন দিতে পারছি না তাই আপাতত স্কুল থেকে বের করে নিয়ে আসলাম। শুধু পরিবার না তাহলে সারাদেশেই সমস্যায় পড়বে।”
এছাড়া মূল্যস্ফীতির চরম এসময়ে ‘পুষ্টিহীনতা যেন বেড়ে না যায়’ সেজন্য মায়েদের স্বাস্থ্যের জন্য যে কর্মসূচি দেওয়া আছে সেখানে ব্যয় বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি।
রাজস্ব আদায়ে অনেক সমস্যা থাকায় সেটির দ্রুত সমাধান সম্ভব নয় বলে এই অর্থনীতিবিদ এসব খাতে ব্যয় বাড়াতে দীর্ঘদিন থেকে দিয়ে আসা ভর্তুকির খাতগুলো পুনর্বিবেচনার কথা বলেন।
সরকারের খরচ কমানোর প্রসঙ্গে রপ্তানিতে ভর্তুকি দিয়েও বহুমুখীকরণ না হওয়ার কথা তুলে ধরে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “এর ব্যবস্থাপনায় যদি পরিবর্তন না আনা যায় তাহলে যেউ লাউ সেই কদুই রয়ে যাবে।”
একই সঙ্গে এডিপি থেকে অপচয় কমিয়ে আকারটা ছোট করার পক্ষে তিনি।