এ দৃশ্য কল্পনা করাও কঠিন। কোপাকাবানার নরম বালুর সৈকতে, ব্রাজিলের অলিতে-গলিতে, ঘরের লবিতে-ব্যালকনিতে যে সাম্বা নৃত্যের নুপুর নিক্কন ধ্বনিত হয় সকাল-সন্ধ্যা হয়ে গভীর রাত অবধি, সেই নৃত্য ওলে…ওলে…ওলে কোরাসের সুরের ডানায় ভর করে আরও অদ্ভূত এক মুগ্ধতা ছড়িয়ে বাজল কাতারের মরুপ্রান্তরে, তাও আবার শিপিং কন্টেইনারের উপরে!
সত্যিই তাই। কাতার বিশ্বকাপে ব্রাজিলের প্রথম ম্যাচের ভেন্যু ছিল লুসাইল স্টেডিয়াম। মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্যের ছোঁয়ায় তৈরি এই স্টেডিয়ামের আকৃতি বাটির মতো। ভেতরের সবকিছু অবশ্য কনক্রিটের। সার্বিয়ার বিপক্ষে ২-০ গোলে জেতা ম্যাচে ব্রাজিলিয়ান সমর্থকরা সাম্বা নাচের মূর্ছনায় মাতিয়েছিলেন লুসাইয়ের আঙিনা। সে উদযাপনের সুরে-শব্দে অবশ্য আকাশ-বাতাস কাঁপেনি। কাপঁল স্টেডিয়াম ৯৭৪-এ এসে।
দ্বিতীয় ম্যাচের ভেন্যু ছিল এই অদ্ভূতুড়ে নামের মাঠে; স্টেডিয়াম ৯৭৪। বিশ্বকাপের ইতিহাসে পুরোপুরি অপসারণযোগ্য এই স্টেডিয়ামটি তৈরি হয়েছে ৯৭৪টি শিপিং কন্টেইনার দিয়ে। বিশ্বকাপের পর ভেঙে ফেলা হবে, শিপিং কন্টেইনারগুলো ব্যবহার করা হবে পুরান কাজে। কন্টেইনারে মোড়ানো এই মাঠে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে ব্রাজিলের ম্যাচ ছিল সোমবার সন্ধ্যায়।
সাম্বা নাঁচের জন্য সময়টা ছিল মোক্ষম, কিন্তু নাচের মঞ্চ যে টিনের পুরু পাতে তৈরি কনটেইনারের উপরে! এখানে নরম তুলতুলে বালির স্পর্শ নেই, প্রিয়জনের বাহুডোরে গলিয়ে পড়ার সুযোগ নেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশটির রক্ষণশীলতার কারণে, কিন্তু সেলেসাও সমর্থকদের তাতে কিছু যায় আসে না। ৪৪ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এর গ্যালারি তাই দুপুর থেকে প্রায় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে হলুদ জার্সির স্রোতে। ম্যাচ শুরুর বাঁশির অপেক্ষায় থাকার সময়ও নেই তাদের। ‘ব্রাজিল, ব্রাজিল’ স্লোগান, ‘ওলে…ওলে…ওলে’ কোরাসের সুরের মূর্ছনায় চারদিক হয়ে উঠতে থাকে মুখরিত।
সাম্বা নৃত্যের জন্য যতটুকু প্রয়োজন, তার তুলনায় সিটের সারিগুলোর মধ্যে জায়গা কম। ফলে নাচতে সুবিধে হয়না তেমন একটা। একাকী, জুটি হয়ে, চক্রাকারে, বৃত্তাকারে দলবদ্ধ হয়ে-যেভাবেই হোক না কেন, এই নাচের মুদ্রায় দুই পায়ের কারুকাজ বেশি, ছন্দের তালে তালে কোমর এবং পুরো শরীর হেলিয়ে-দুলিয়ে দারুণ দ্যেতনা তৈরির ব্যাপারও আছে। ধীরলয়ে, কখনও সে নাঁচ উদ্দাম, বাধঁনহারা। সিটের ফাঁকে সে জায়গা না মেলায় সমর্থকদের উচ্ছ্বাস তাই পুরোপুরি ভর করল পদযুগলে।
মাঠে আসা সমর্থকের মধ্যে সুইসদের সংখ্যা হাতে গোনা; সিংহভাগই ব্রাজিলিয়ান। কখনও বসে, কখনও পরস্পরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাজারো পদযুগলের দাপাদাপি চলল সারাক্ষণ। নেইমারহীন ব্রাজিলের আক্রমণের তেজ অতটা না থাকলেও ভিনিসিউস জুনিয়র, রিশার্লিসনদের অনুক্ষণ তারা অনুপ্রেরণা জুগিয়ে গেল। কন্টেইনারের উপর বলে সে দাপাদাপি মোটেও বাজখাই, বেসুরো নয়, বরং গগনবিদারি শব্দের ভিন্ন স্বাদের মূর্ছনায় মোড়ানো।
এই সাম্বা নৃত্য নিয়ে বলা হয়ে থাকে, এটি পুরোপুরি ব্রাজিলের নয়। আফ্রিকান দাসদের নাচের মুদ্রার সঙ্গে ব্রাজিলিয়ান সংস্কৃতির মিশেলে এর জন্ম। এই শব্দের উৎপত্তি আরবি শব্দ জুম্বা বা জাম্বা থেকে-এমন ধারনাও বেশ শক্ত। এ তথ্য সত্যি হলে আরবি অধ্যুষিত সেই কাতারের মরুদ্যানে সাম্বার ফিরে আসা চমকপ্রদ ব্যাপার বটে। কে জানে, হয়ত কোনো কন্টেইনারে বন্দি হয়ে কোনো দাস সাম্বা নিয়ে নোঙর ফেলেছিল রিও দে জেনেইরোর পাড়ে, নতুন রূপে তারাই স্টেডিয়াম ৯৭৪-এর আঙিনায় ফিরে এলো কি না?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার দায়িত্ব নৃতাত্ত্বিকদের। তবে ব্রাজিলিয়ানরা যে এর সুর, ছন্দ, তাল, লয়ের সঙ্গে গভীর আত্মিক বন্ধন তৈরি করে নিয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন নেই। তাই ভিনিসিউস জুনিয়র, রিশার্লিসনের সুযোগ নষ্টে, অফসাইডের খাঁড়ায় গোল না পাওয়ার দুঃসময়ে, বিস্ময়করভাবে ৪৪তম মিনিটে স্টেডিয়ামের আলো ক্ষণিকের জন্য কমে যাওয়ার ক্ষণেও বন্ধ হয় না সাম্বা। করতালির ছন্দে, পদযুগলে টুক-টুক, দুপ-দুপ দ্যেতনা তুলে বাজতেই থাকে। ৮৩তম মিনিটে কাসেমিরোর গোলের মুহূর্তে তা যেন পায় পূর্ণতা। এবার সে শব্দ কাপিয়ে দেয় মরুপ্রান্তর।
কিন্তু কন্টেইনারের উপর সাম্বা! কীভাবে সম্ভব? এই প্রশ্নে সাও পাওলো থেকে আসা মারিয়া দা সিলভা নামের ফুটবলপ্রেমী তরুণীটির এককথার উত্তরেও থাকল ব্রাজিল আর সাম্বার নিবিড় বন্ধনের সুর।
“উই কান দান্স এবরিহয়ার”