আগেরবার বিসিবিকে অনেকটা উপেক্ষা করেই বিদায় নিয়েছিলেন তিনি। সেই কোচকে আবার ফিরিয়ে এনেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ড।
Published : 01 Feb 2023, 06:47 PM
বাংলাদেশ দল তখন দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে। সময়টা ২০১৭ সালের অক্টোবর। শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর, বাংলাদেশের দায়িত্ব ছেড়ে শ্রীলঙ্কার কোচ হতে যাচ্ছেন চান্দিকা হাথুরুসিংহে। সফরের মাঝপথেই একদিন তিনি বিসিবিতে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। এরপর বোর্ড সভাপতি ও প্রধান নির্বাহী বারবার টেক্সট ম্যাসেজ ও ফোন করলেও কোনো সাড়া দেননি হাথুরুসিংহে। কদিন পর তিনি দায়িত্ব নেন শ্রীলঙ্কার।
সেই বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান ও প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরি এখনও আছেন নিজেদের দায়িত্বে। তাদের সময়েই এবং তাদের প্রবল চাওয়া ও উদ্যোগে আবার জাতীয় দলের প্রধান কোচ হয়ে বাংলাদেশে ফিরছেন হাথুরুসিংহে।
গুঞ্জনটা অবশ্য ছিলই। বছর দেড়েক আগে একবার শোনা গিয়েছিল হাথুরুসিংহেকে ফেরানোর উদ্যোগের কথা। এরপর সম্প্রতি আবার দেশের ক্রিকেটে ভেসে বেড়াতে থাকে তার নাম। আবার তার দায়িত্ব পাওয়াটা তাই খুব একটা চমক হয়ে আসেনি। তবে তার আগের দফায় বিদায়ের প্রেক্ষাপট ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের কথা মনে করলে, তার এদেশে ফেরার মতো বিস্ময়কর কিছু আর নেই।
২০১৪ সালে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল দুই বছরের জন্য। ২০১৬ সালে সেই মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০১৯ বিশ্বকাপ পর্যন্ত। কিন্তু নতুন করে সেই তিন বছরের মেয়াদের দেড় বছরও তিনি পূর্ণ করেননি। ক্রিকেটারদের অনেকের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতির খবরও তো শোনা যেত প্রায়ই। সেটি হয়ে থাকলে অবশ্য নানা কারণেই হতে পারে, দায় ক্রিকেটারদেরও থাকতে পারে। চুক্তিপত্রের কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকলে পদত্যাগও তিনি করতে পারেন। সবই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু যেভাবে তিনি দায়িত্ব ছেড়েছিলেন, সেটি ছিল ভীষণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
অক্টোবরের মাঝপথে হাথুরুসিংহে পদত্যাগপত্র পাঠান। দক্ষিণ আফ্রিকা সফর শেষে চলে যান সিডনিতে, যেখানে তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন। বোর্ড অপেক্ষা করতে থাকে সিরিজ শেষ হওয়া পর্যন্ত। পরে যখন আলোচনার চেষ্টা করা হয়, কোনোরকম সাড়া তার কাছ থেকে মেলেনি। কথাই বলেননি কারও সঙ্গে।
তবে খবরটি চাপা রেখে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল বিসিবি। নভেম্বরে লঙ্কান সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর অবশেষে ৯ নভেম্বর বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান জানান, মাসখানেক আগেই পদত্যাগ করেছেন কোচ। তখনও পর্যন্ত অনেক চেষ্টা করেও তারা কোচের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি বলেও জানান বোর্ড প্রধান। বোর্ডের অনেকেই তখন বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন হাথুরুসিংহের অপেশাদারিত্ব নিয়ে।
সেই কোচকেই আবার ফিরিয়ে আনা হলো।
পরে অবশ্য তার সঙ্গে কথা বলতে পেরেছিল বিসিবি। এত কিছুর পরও তাকে রাখতে মরিয়া ছিল বোর্ড। কিন্তু তিনি ছিলেন অনড়। ৮ ডিসেম্বর তিনি ঢাকায় আসেন চুক্তি শেষের আনুষ্ঠানিকতা সারতে। ঢাকার একটি হোটেলে তার সঙ্গে সভায় বসেন বিসিবি প্রধান ও শীর্ষ বোর্ড পরিচালকরা। সেই সভা শেষে হাথুরুসিংহে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। বোর্ড কর্তাদের চোখমুখও ছিল বেশ শক্ত।
বিসিবি প্রধান তখন সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে বলেছিলেন, ক্রিকেটারদের নিয়ে বিস্তর অভিযোগ জানিয়ে গেছেন হাথুরুসিংহে। সাকিব আল হাসান দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাননি বলে দেশ ও দলের প্রতি এই অলরাউন্ডারের দায়িত্ববোধ ও নিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বিদায়ী কোচ, ক্রিকেটারদের মানসিকতার সমস্যার কথাও বলেছিলেন। বাংলাদেশকে আর দেওয়ার কিছু নেই, হাথুরুসিংহে এমন কথা বলেছিলেন বলেও তখন জানিয়েছিলেন বোর্ড সভাপতি।
প্রায় সাড়ে ৫ বছর পর সেই কোচকেই ফিরিয়ে আনা হলো।
বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার কদিন পরই শ্রীলঙ্কার কোচের দায়িত্ব নেন তিনি। বাংলাদেশে তার পারিশ্রমিক ছিল এই দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া কোচদের একজন ছিলেন তিনি তখনই। শ্রীলঙ্কার দায়িত্ব নেন তিনি আরও অনেক বেশি পারিশ্রমিকে। বলার অপেক্ষা রাখে না, অর্থের সেই চোখধাঁধানো অঙ্ক নিশ্চিতভাবেই তাকে প্রভাবিত করেছিল বাংলাদেশের দায়িত্ব ছাড়তে।
সেটি অবশ্য সমস্যা নয়। পেশাদার জগতে নিজের পছন্দ তিনি বেছে নিতেই পারেন। কিন্তু বিদায়ের সেই অপেশাদারী ধরন ও ক্রিকেটারদের বিরুদ্ধে একগাদা অভিযোগের পর এই দেশের ক্রিকেটে আবার তাকে দেখতে পাওয়া কল্পনা করাও ছিল কঠিন। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটে যে শেষ কথা বলে কিছু নেই, তা প্রমাণ হলো আবার।
যাদের বিরুদ্ধে তিনি অভিযোগ করেছিলেন, সেই ক্রিকেটারদের অনেকেই এখনও আছেন দলে। ড্রেসিং রুমের পরিবেশ নিয়ে তাই সংশয়ের অবকাশ থাকছে তীব্রভাবেই। বাংলাদেশ থেকে তিনি শ্রীলঙ্কায় যাওয়ার কিছুদিন পর সেখানেও ড্রেসিং রুমে অস্থিরতার খবর প্রকাশিত হতে থাকে।
ক্রিকেটারদের কয়েকজনের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বের খবর ‘ওপেন সিক্রেট’ হয়ে ওঠে সেখানে। এক পর্যায়ে স্রোত চলে যায় তার বিরুদ্ধেই। তিন বছরের মেয়াদের অর্ধেক পূরণ হওয়ার আগেই প্রথমে তার ক্ষমতা কমানো, পরে ‘ওএসডি’ করা, ও সবশেষে তাকে বরখাস্ত করে লঙ্কান বোর্ড। চুক্তির অর্থ সংক্রান্ত ব্যাপারে বোর্ডের সঙ্গে অনেক দিন আইনী লড়াইও চলে তার।
এমন ভাবমূর্তির একজনকেই কোচ করে আনা হলো আবার।
এমনিতে ক্রিকেটীয় দিক থেকে তার কোচিং সামর্থ্য কিংবা দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সামান্যই। বাংলাদেশের ক্রিকেট তার সময়ে কোন উচ্চতা ছুঁয়েছে, কত কত সাফল্য এসেছে, এসবও প্রায় সবার জানা। এদেশে তার প্রবল সমালোচকরাও লঙ্কান এই কোচের প্রশংসা করেছেন ট্যাকটিশিয়ান হিসেবে, কৌশলী ও কার্যকর হিসেবে। কিন্তু জাতীয় দলে কোচিংয়ের একটি বড় অংশ তো ‘ম্যান-ম্যানেজমেন্ট।’ এখানে ফাঁক থেকে গেলে গড়বড় হয়ে যায় অনেক কিছুই।
হতে পারে, হাথুরুসিংহে এবার অন্য রূপে ফিরবেন। হতে পারে, তিনি এখন আরও পরিণত, আরও অভিজ্ঞ। এই দেশের ক্রিকেটের ভেতর-বাহির তার জানা আছে ভালোভাবে। হয়তো সেভাবেই প্রস্তুত হয়ে আসবেন এই দফায়। সেই আশা তো আপাতত করতেই হবে।
তবে যেভাবে তাকে আনা হচ্ছে, সেটিই আবার ভয় দেখাচ্ছে আশাবাদী হতে। আগের দফার দায়িত্বে প্রথম মেয়াদের দুই বছরে তাকে নিয়ে অভিযোগ-আপত্তি কোনো দিক থেকেই তেমন ছিল না। পরে যখন মেয়াদ বাড়ানো হলো তিন বছর, ক্রমে তার ক্ষমতা বাড়িয়ে দিল বিসিবি, একটা সময় তিনি হয়ে উঠলেন প্রায় বাংলাদেশের ক্রিকেটে অধিপতি, সেই সময়টা থেকেই তার আচরণ ও অন্যান্য পারিপার্শ্বিকতায় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। এবারও তো সেই প্রেক্ষাপট তৈরি!
আগেরবার এত কিছু হওয়ার পর তাকে আবার আনা হচ্ছে অনেকটা মরিয়া চেষ্টা করে, বেতন আগের চেয়েও আরও বেশ কিছুটা বেশি বলে শোনা যাচ্ছে, সুযোগ-সুবিধা-ক্ষমতা, সবই বেশি হওয়ার কথা। একচ্ছত্র আধিপত্য তো অনেক সময়ই টেনে নেয় স্বেচ্ছাচারিতার পথে। হাথুরুসিংহের আগেরবারের দায়িত্বে তেমনটিই দেখা গিয়েছিল।
বিসিবির মরিয়া চেষ্টার প্রমাণ মিলে গেছে হাথুরুসিংহেকে আবার নিয়োগ দেওয়ার দিনেই। আগের কোচ রাসেল ডমিঙ্গোর ক্ষেত্রে বিসিবি জানিয়েছিল, গত ২৭ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেছেন এই দক্ষিণ আফ্রিকান কোচ। অথচ মঙ্গলবার কোচ ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনে বিসিবি সভাপতি পরিষ্কার বললেন, অস্ট্রেলিয়ায় গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময়ই হাথুরুসিংহের সঙ্গে একরকম পাকা কথা হয়ে যায় তাদের।
যেটির মানে, ডমিঙ্গো কোচের দায়িত্বে থাকার সময়ই হাথুরুসিংহেকে প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলা হয়। ডমিঙ্গো আদৌ পদত্যাগ করেছেন নাকি পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে কিংবা বরখাস্ত করা হয়েছে, এই প্রশ্নও এখন তোলা যায়।
কোচিংয়ের ক্ষেত্রে বিসিবির মরিয়া চেষ্টার সবশেষ নজির খুব ভালো ফল দেয়নি। গত বছর অ্যাশওয়েল প্রিন্স ব্যাটিং কোচ থাকার সময়ই জেমি সিডন্সের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিসিবি। যদিও শুরুতে বলা হয়েছিল ডেভেলপমেন্টে বা তরুণ ক্রিকেটারদের নিয়ে কাজ করার জন্য সিডন্সকে আনা হচ্ছে, কিন্তু এই অস্ট্রেলিয়ান কোচকে জাতীয় দলের ব্যাটিং কোচের দায়িত্বই দেওয়া হয়। প্রিন্সকে বলা হয় ডেভেলপমেন্ট পর্যায়ে কাজ করতে। পরে পারিবারিক কারণ দেখিয়ে দায়িত্ব ছেড়ে দেন প্রিন্স।
কিন্তু সিডন্সের কোচিংয়ে ব্যাটসম্যানদের উন্নতির চিহ্ন খুব একটা দেখা যায়নি। বরং এই সময়ে ব্যাটিংয়ের দুর্দশা চলছে ম্যাচের পর ম্যাচ। পরে সম্পতি তাকে কাজে লাগানো হয়েছে বাংলাদেশ ‘এ’ দলে। সামনেও এভাবেই তাকে কাজে লাগানোর সম্ভাবনা বেশি।
সিডন্সের মতোই প্রেক্ষাপট হাথুরুসিংহের। শঙ্কা তাই জেগে ওঠার কারণ আছে বৈকি!
ওয়ানডে বিশ্বকাপের আর বাকি আছে মোটে ৯ মাস। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ধারাবাহিক এই সংস্করণেই, সবচেয়ে বড় স্বপ্ন এই দলকে ঘিরেই। কিন্তু নতুন করে কেউ দায়িত্বে এলে সাধারণত পরিবর্তন করতে চান অনেক কিছুই। হাথুরসিংহে কী করতে চাইবেন, তা বলে দেবে সময়ই। তবে বেশি নাড়াচাড়া করতে গিয়ে থিতু তরণী টালমাটাল হওয়ার ভয় তো থাকেই।
শ্রীলঙ্কায় বরখাস্ত হওয়ার পর বড় কোনো দায়িত্বে বা শীর্ষ পর্যায়ে কোচিং করাননি হাথুরুসিংহে। ২০২০ সাল থেকে নিউ সাউথ ওয়েলসের সহকারী কোচ হিসেবে কাজ করছিলেন। আন্তর্জাতিক কোচিং থেকে প্রায় চার বছরের যে বিচ্ছেদ, সেখানেও প্রশ্ন থেকে যায় যে, এই সময়ের কোচিংয়ের সঙ্গে কতটা পরিচিত তিনি।
এটা অবশ্য খুব বড় কোনো সমস্যা নয়। এখানে ঘাটতি কিছু থাকলেও দ্রুত নিজেকে হয়তো তিনি সমৃদ্ধ করে নিতে পারবেন তিনি। কিন্তু কোচিংয়ের মতো অতটা সহজ হওয়ার কথা নয় নিজের সহজাত মানসিকতা কিংবা আচরণ হালনাগাদ করা।
হাথুরুসিংহের নতুন অধ্যায় নিয়ে সবচেয়ে বড় শঙ্কার জায়গা এখানেই। কোচ পুরনো হলেও নতুন দফায় নতুন সম্ভাবনার হাতছানি অবশ্যই আছে। তবে সামনে তাকিয়ে, ওই হাতছানির চেয়ে নানা শঙ্কার চোরাস্রোতই বেশি দেখা যাচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত সবকিছু নির্ভর করছে হাথুরুসিংহের ওপরই, নতুন অধ্যায়ে তিনি কোন চরিত্র ধারণ করেন!