মুশকিলে পড়লেন সৈয়দ মুজতবা আলী। যদিও পূজার আচার-নিয়ম জানতেন তিনি। তাই বলে বামুন সেজে সৈয়দ যাবেন সরস্বতীর পূজা করতে? অবশেষে বৃদ্ধার অনুরোধ এবং তার নাতনির উপোস মুখ উপেক্ষা না করতে পেরে গেলেন তাদের বাড়িতে। বিশুদ্ধ সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণে, নিয়ম-পদ্ধতি মেনে পূজা সারলেন।
Published : 02 Feb 2025, 04:24 PM
সরস্বতী পূজা করার ভেতর দিয়ে আমরা বিদ্যাদেবীকে ডেকে আনি। এই পূজা আর যে কোন পূজার চাইতে গুরুত্বপুর্ণ কেন? এর মাধ্যমে আপনি না শক্তি, না সাহস, না অর্থবিত্ত– কিছুই চাচ্ছেন না। আপনি চাইছেন বিদ্যা। বিদ্যার প্রতি এই শুভবোধকে সম্মান জানাতেই হয়।
সর্বজনীন সরস্বতী পূজা আমাদের ভেতরের শক্তিকে জাগ্রত করে। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ বা বিশ্বের বাঙালি এই আরাধনাকে তাদের হৃদয়ে জায়গা দিয়েছে।জায়গা দিয়ে তারা যেটুকু অর্জন করেছে তার দিকে তাকালেই আপনি বুঝে যাবেন আমাদের আরো অনেকদূর যেতে হবে।কারণ দেশেবিদেশে মেধা আর বিদ্যার যোগ্যতায় বাঙালি এখনো সঠিক অবস্থানে পৌঁছাতে পারেনি। যে দেশ থেকে আমরা দূর প্রবাসে এসে বসত গড়েছি, সেই বাংলাদেশের পরতে পরতে অনেকদিন ধরে চলছে অশান্তি, যা দূরে থাকলেও আমাদের নিষ্কৃতি দেয় না।
হাল-আমলে সবচাইতে কঠিন জায়গায় আছে পড়াশোনা। সেটা প্রায় নিশ্চিহ্ন হবার পথে। আজকাল সংবাদমাধ্য চোখ রাখলেই মারামারি হানাহানি, সহিংসতা আর সংঘাতের খবর পাওয়া যাবে। সহিংসতা আর সংঘাত নতুন নয়। নতুন বাস্তবতা হচ্ছে দেশে তারুণ্য সব নিয়ম-কানুন ভেঙ্গে দিয়েছে। বিদ্যাঙ্গনে এখন সন্ত্রাস আর হানাহানি চলছে। উন্মাদনা আর উত্তেজনা এমন পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে এটা আমরা সেদিনও ভাবতে পারিনি। আমরা ভেবেছিলাম লাঠিহাতে ছাত্রলীগ যাদের দমন করতে মাঠে নেমেছিল, গণ-অভ্যুত্থানে তারাই বিজয়ী হওয়ার পর পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে। অথচ হয়েছে উল্টোটা। ধসে পড়ছে মৌলিক মূল্যবোধ। ভেসে যাচ্ছে নৈতিকতা। বইপত্র, খাতা-কলম বাদ দিয়ে অস্ত্র লাঠি নিয়ে ঘুরে বেড়ানো শিক্ষার্থীদের দেখলে মানুষ স্বস্তি পাবে কিভাবে? মানুষের স্বস্তি দূরে থাক, আজ বাদে কাল বিদ্যাদেবী সরস্বতীর যে পূজা হবে, এই সব বিদ্যাঙ্গনে পূজা নিতে স্বয়ং দেবীই আসতে চাইবেন না হয়তো।
দেশের কথা থাক। দূরপ্রবাসে সরস্বতী পূজা যে শান্তি আর আনন্দে আমরা উদযাপন করে থাকি, সেটা কি দেশে সম্ভব? পূজা যত এগিয়ে আসে তত ভাঙ্গচুরের আতঙ্ক দেখা দেয়। ঘরবাড়ি ব্যবসা বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো দেবদেবীরাও রেহাই পান না। এটা নতুন কিছু নয়। ফ্যাসিবাদ, মৌলবাদ আর জাতীয়তাবাদ– যাই বলি না কেন, সব আমলে দেবদেবীর মাথা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে পেরে কাউকে কাউকে বিকৃত আনন্দ পেতে দেখেছি। সরস্বতী অত্যন্ত নিরীহ এক দেবী। মতান্তরে নদী, মতান্তরে বিশ্বসৃজন কর্তার সৃষ্টি বা পার্বতী ও মহাদেবের কন্যা তিনি।
‘দেবী সরস্বতী ও হিন্দু ধর্মশাস্ত্র’ শিরোনামে বিশ্বজিৎ দেবের সূত্রে পাওয়া লেখা থেকে একটু উদ্ধৃত করছি– “আমরা যে দেবী সরস্বতীকে আরাধনা করি তিনি হলেন মা দুর্গার কনিষ্ঠ কন্যা এবং কার্তিক-গনেশের ভগিনী। কিন্তু দেবীর এই তথ্য হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুমোদন করেনি। হিন্দু ধর্মশাস্ত্রানুসারে, মা সরস্বতী হলেন ত্রিদেবীর অন্যতমা।
“মানবমনের অন্তঃজ্ঞান ও বহিঃজ্ঞানের পূর্ণ জ্যোতি সর্বদা প্রজ্জ্বলিত হয়। ঋগবেদে এই জ্ঞানকে ব্রহ্মজ্ঞান বলে। এই ব্রহ্মজ্ঞানের জ্যোতিই হলেন দেবী সরস্বতী। তিনি সর্বদা জ্যোতির্ময়া। তাই তিনি সর্বশুক্লা।”
“আদিবেদে খরস্রোতা নদীর সঙ্গে মা সরস্বতীর তুলনা করা হয়েছে। তিনি জ্ঞানের প্রবাহরূপে অনন্ত সমুদ্রে মিলিত হন। সামবেদের গায়করা মধুর সুরে বেদের মন্ত্র উচ্চারণ করতেন। এই সামবেদের ঋষিদের প্রতীক ছিল বীণা। তাই দেবী সরস্বতীর হাতে বীণা স্থান পেয়েছে। আগে বেদ লেখা হত না। আগে বেদ ছিল শ্রুতি, তখন অনন্ত জ্ঞানকে পুস্তকের মাধ্যমে প্রকাশ করা হত না। আর্য ঋষিগণ পুস্তকের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেন এবং পুস্তক রচনায় অনুপ্রাণিত করার উদ্দেশ্যে দেবীহস্তে পুস্তক দিয়েছেন।”
“স্কন্দপুরাণে দেবী সরস্বতীকে প্রবহমান নদীরূপে কল্পনা করা হয়েছে।এই জ্ঞানের প্রবাহ গুরুর থেকে শিষ্যে, বড়দের থেকে ছোটদের মধ্যে সর্বদা প্রবাহিত হচ্ছে।”
এগুলো সব শাস্ত্রের কথা। আমরা আমাদের জীবনবোধে যদি সরস্বতীকে খোঁজার চেষ্টা করি তাহলেই তার স্বরূপ দেখতে পাব। সেই সুদূর আমলে আমাদের বাড়িতে বাড়ির উঠোনে প্যান্ডেল খাটিয়ে তার আরাধনা করা হতো। আমার কোন ভাই নেই, তাই দিদিরাই ছিল এর আয়োজক। স্পষ্ট মনে পড়ে সামিয়ানা ব্যতীত বাকি যত সজ্জা তার সিংহভাগই ছিল মায়ের শাড়ি। সেই শাড়ি দিয়ে বানানো মণ্ডপে সরস্বতী আসতেন কিনা জানি না, তবে সন্ধ্যার পর দলে দলে মানুষ আসতেন। তখনকার সঙ্গে এখনকার তফাৎ এই, সাধারণ মানুষেরা আসতেন ভক্তি নিয়ে। প্যান্ডেল বা আলোকসজ্জা দেখার জন্য ভিড় করতেন না তারা। বাড়িতে বানানো মিহিদানা, নিমকি বা এক-দুইখান লুচি এই প্রসাদেই তৃপ্ত ছিলেন তখনকার মানুষ।
আমার মেজদি ব্যতীত আমাদের পরিবারের আর কেউই পড়ালেখায় তেমন কৃতিত্ব দেখাতে পারেনি। অথচ বিয়ের পর দেখলাম দীপাদের বাড়ির সবাই চৌকস মেধাবী, কেউ ডাক্তার, কেউবা ইঞ্জিনিয়ার ।কিন্তু ছেলেবেলার পর তাদের সঙ্গে সরস্বতী পূজার কোন যোগ আছে বলে মনে হয়নি। তারা আনন্দ করত, ঘুরে বেড়াত, বাড়িতে মা-কাকিরা পূজা করাতেন বটে, কিন্তু সেটা ওই সৈয়দ মুজতবা আলীর পূজার মতো।
গল্পটা এমন– সরস্বতী পূজার দিন, গোসল করবেন গঙ্গার ঘাটে গিয়েছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। তারপর একটু হাঁটবেন। বেলা ১২টা পেরিয়েছে। হঠাৎ এক বৃদ্ধা তার ছোট্ট নাতনিকে নিয়ে সৈয়দ সাহেবের সামনে এসে করজোড়ে দাঁড়ালেন। অনুনয় করে বললেন, ‘বাবা, আমার বাড়ির পূজাটা করে দাও না, পুরোহিত এখনও আসেনি। আমি পুরোহিত খুঁজতে বেরিয়েছি. বাচ্চাটা অঞ্জলি দেবে বলে না খেয়ে বসে আছে।’
মুশকিলে পড়লেন সৈয়দ মুজতবা আলী। যদিও পূজার আচার-নিয়ম জানতেন তিনি। তাই বলে বামুন সেজে সৈয়দ যাবেন সরস্বতীর পূজা করতে? অবশেষে বৃদ্ধার অনুরোধ এবং তার নাতনির উপোস মুখ উপেক্ষা না করতে পেরে গেলেন তাদের বাড়িতে। বিশুদ্ধ সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণে, নিয়ম-পদ্ধতি মেনে পূজা সারলেন।
বাড়ির লোকজন এসব দেখে খুবই খুশি। তাদের পূজা পালন হলো। ভালোভাবে অ্যাপায়িত হয়ে পূজার দক্ষিণা নিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী বিদায় নিলেন। কেউ টের পেলেন না যে বামুন আসলে মুসলমান সৈয়দ।
পরে সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছিলেন, ‘জানি না মা সরস্বতী এই বিধর্মীর পুজোয় অসন্তুষ্ট হলেন কিনা? তবে আশা করি তিনি উপোসী বাচ্চাটির শুকনো মুখের দিকে চেয়ে এই অধমকে ক্ষমা করবেন।’
পৌরোহিত্য কে করলেন, বড় কথা নয়, বড় বিষয় হলো পূজা। সৈয়দ মুজতবা আলীর সরস্বতী পূজা করার গল্পটা বললাম এই কারণে দেবী কেবল পূজার ওপর ভর করে তার আর্শীবাদ বা করুণা দেন না। মেধা ও হৃদয় কিংবা মগজ বুঝেও দেন বলে ধরে নিতে হবে।
আমাদের প্রবাসী পূজা ক্রমাগত স্মৃতিনির্ভর আর বয়স্কদের আয়োজন হয়ে উঠতে চলেছে। এ কোন অনুমান নয়, এটা বাস্তব। যারা দেশ থেকে ছেলেবেলা বা যৌবন থেকে পূজা দেখে, পূজা করে আনন্দ ও তৃপ্ত তারাই এখানে পূজার কান্ডারি। তাদের বিমল আনন্দ আর দিনভর ব্যস্ততার পাশাপাশি নতুন প্রজন্মকে সেভাবে দেখতে পাওয়া যায় না। আমি জানি তারা আমাদের মতো করে কিছু করবে না। তাদের মতো করেই করুক। পূজায় কথা বলুক। ধারণা বিনিময় করুক। কোন সন্দেহ বা সংশয় থাকলে তা নিয়ে আলাপ হোক। তবেই না তারা মূল জায়গায় যাবার পথ খুঁজে পাবে।
এই মূল জায়গাটি কি? আমি বলব সরস্বতীর ভেতর দিয়ে আত্মানুসন্ধান। অর্থাৎ নিজেকে জানা।আত্মানুসন্ধান মানে নিজেকে জানার কথা বলে গিয়েছিলেন সক্রেটিস।সরস্বতী যেহেতু নিজেকে জানার প্রতীক, তাই তার প্রতিমা থাকে মানুষের ঘরে, তিনি থাকেন মানুষের মনে।হয়তো এই কারণেই অন্য সব দেবদেবীর মতো সরস্বতীর মন্দির নেই; অন্তত বাংলায়– বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে সরস্বতী মন্দিরের দেখা পাওয়া যায় না বললেই চলে।পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ার পঞ্চাননতলার উমেশ চন্দ্র দাস লেনে অবস্থিত শতবর্ষী সরস্বতী মন্দিরটিকে বাংলার সর্বপ্রথম এবং একমাত্র সরস্বতী মন্দির বলা হয়ে থাকে।
বাংলার বাইরে কয়েকটি সরস্বতী মন্দিরের খবর পাওয়া যায়, যেমন কেরালার পানাচিক্কাড় সরস্বতী মন্দির, বলা হয়ে থাকে এটি কেরালার একমাত্র মন্দির, যেখানে দেবী সরস্বতী পূজিত হন। এটি দক্ষিণা মুখাম্বিকা নামেও পরিচিত। ভারতের রাজস্থান ও অন্ধ্র ইত্যাদি অঞ্চলে গুটিকয়েক প্রাচীন সরস্বতী মন্দিরের অস্তিত্ব রয়েছে।
সরস্বতীর জপমন্ত্র প্রতিদিনই শিক্ষার্থীদের জপ করতে বলা হয়। মনে করা হয়, এর ফলে বুদ্ধির বিকাশ ঘটে, পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়ে এবং মানসিক উন্নতি হয়। জ্ঞানবিহীন জানার ভেতর অসংখ্য ভ্রান্তি থেকে যায়। আর জ্ঞান দিয়ে জানলে বুদ্ধের ‘আত্মদীপ ভবঃ’ হবার বিকল্প থাকে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাকে লিখেছেন, “আপনারে দীপ করি জ্বালো/ আপনার যাত্রাপথে/ আপনিই দিতে হবে আলো।”