কোরাসের সুমধুর সুরে আল রাইয়ানের আহমেদ বিন আলি স্টেডিয়ামের গ্যালারি মুখরিত হয়ে থাকল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।
Published : 04 Dec 2022, 10:24 AM
আহমেদ বিন আলি স্টেডিয়ামে যাওয়ার পথে মেট্রোর প্রতিটি কেবিন আর্জেন্টিনা সমর্থকে ঠাসা। একের পর এক গান গেয়ে চলেছেন তারা। যার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝি না। বোঝা যায় কেবল ‘ভামোস আর্জেন্টিনা, ভামোস আর্জেন্টিনা’ কোরাসের সুর।
স্টেডিয়ামে ঢুকেই সেই একই সুর বাজতে থাকল গ্যালারির চারধারে। আর্জেন্টিনা-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ শুরুর সাথে সাথে লিওনেল মেসি অর্কেস্ট্রার কনডাক্ট হয়ে কোরাসের তাল লয় ঠিক করে দিতে থাকলেন। আর্জেন্টিনার আক্রমণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সে সারগাম বাজতে থাকে কখনও উঁচু রাগে, কখনও ধীরলয়ে।
মেসির পায়ে বল গেলেই গগনবিদারী আওয়াজে কেঁপে ওঠে গ্যালারি। ফুটবলের এই মহাতারকা একটু ছুটলে সে সুর যেন পৌঁছে যায় সপ্তমাকাশে। তিনি বল হারালে শব্দের গতি কমে, কিন্তু ঠিকই বাজতে থাকে গুণগুণিয়ে।
চতুর্থ মিনিটে আলেহান্দ্রো গোমেসের শট অস্ট্রেলিয়ার এক খেলোয়াড়ের হাতে লাগলে হ্যান্ডবলের দাবি তোলে আর্জেন্টিনা। সমর্থকদের চিৎকারে সে দাবির জোর বাড়ে আরও, যদিও রেফারির সাড়া মেলেনি। তাতে রাগে-ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন সমর্থকরা।
অস্ট্রেলিয়ার উইং দিয়ে আক্রমণের রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ মুঠোয় নেয় আর্জেন্টিনা। প্রতিপক্ষের বক্সের চারপাশে চাপ দিতে থাকে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার রক্ষণ পাহাড় সমান দৃঢ়তায় সামলাতে থাকে আরেকটি বিশ্বকাপ শিরোপার জন্য ৩৬ বছর ক্ষুধার্ত থাকা আলবিসেলেস্তেদের চাপ। পোস্টের পেছনে হাতেগোনা কিছু অস্ট্রেলিয়ান দর্শক যেন ম্রিয়মান থাকেন।
আর্জেন্টাইন সমর্থকদের কোলাহলের ফাঁকে মাঝেমধ্যে কিছুটা মাথাচাড়া দিতে চান তারা। জানান দিতে চান, “আমরাও মাঠে আছি।” কিন্তু সুবিধে করতে পারেন না। পরক্ষণেই গ্যালারির নিয়ন্ত্রণ নেন আকালি-নীল সাদা জার্সিধারী সমর্থকরা, মেসি-হুলিয়ানদের মাঠের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার মতো করেই।
মেসির পায়ে বল গেলেই উচ্ছ্বাসে, উন্মাদনায়, দারুণ কিছুর সম্ভাবনায় উঠে দাঁড়ান সমর্থকরা। কিন্তু শুরুর দিকে অধিনায়কের পাসগুলো যেন ঠিকঠাক হচ্ছিল না। আর্জেন্টিনাও তেমন আক্রমণ শাণাতে পারছিল না। কিন্তু আলবিসেলেস্তে সমর্থকরা দমে যাননি মোটেও। আশায় বুক বেঁধে গাইতে থাকে “ভামোস আর্জেন্টিনা, ভামোস আর্জেন্টিনা”।
৩৫তম মিনিটে মেসির গোলে আনন্দের ঢেউ বয়ে যায় গ্যালারিতে। মেসি-আলভারেসদের সঙ্গে প্রতিপক্ষ সমর্থকদের চাপে যেন ভুল করে বসেন অস্ট্রেলিয়া গোলরক্ষক ম্যাট রায়ান। বক্সে নিজের পায়ে বল, কিন্তু সামনে রদ্রিগো দে পলকে ছুটে আসতে দেখে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। চোখের পলকে তার পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে জালে পাঠান আলভারেস। কাতার বিশ্বকাপে এটি তার দ্বিতীয় গোল। ব্যবধান দ্বিগুণের সীমাহীন উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে আর্জেন্টাইন সমর্থকরাও।
আহমেদ বিন আলি স্টেডিয়ামের দর্শক ধারণ ক্ষমতা মাত্র ৪৫ হাজার। এরমধ্যে সিংহভাগ সিট ছিল আর্জেন্টিনা সমর্থকদের দখলে। এক কোণে থাকা অল্প কিছু অস্ট্রেলিয়া সমর্থক ম্যাচে একবারই সেভাবে জানান দিতে পারে নিজেদেরকে। সেটা ৭৭তম মিনিটে, ক্রেইগ গুডউইনের জোরাল শট এনসো ফের্নান্দেসের মুখে লেগে দিক পাল্টে যখন দূরের পোস্ট দিয়ে জালে জড়ায়। স্কোরলাইন হয় ২-১। শেষ পর্যন্ত আশা জাগিয়েও ব্যবধান ঘোচাতে পারেনি অস্ট্রেলিয়া। ছিটকে যায় কাতার বিশ্বকাপের নকআউট পর্বের শুরুর ধাপ থেকে।
গোল হজমের এই অস্বস্তিটুকু কাটিয়ে ঠিকই জয়ের বন্দরে নোঙর ফেলে সবশেষ ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপ জেতা আর্জেন্টিনা। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মেসি-আলভারেস-মার্তিনেসদের অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাওয়া সমর্থকরাও মাঠ ছাড়ে তৃপ্তির হাসি চোখে-মুখে নিয়ে, “ভামোস আর্জেন্টিনা, ভামোস আর্জেন্টিনা’ গাইতে গাইতে।