‘দা বয় হু হার্নেস দা উইন্ড’ সিনেমার সেই ছেলেটির মতোই পুরো মরক্কো দল যেন আফ্রিকার আশার পালে বাতাস দিয়ে যাচ্ছে।
Published : 08 Dec 2022, 11:30 AM
এই দলে কেউ উইলিয়াম কামকাওয়াম্বা নন। আফ্রিকার দেশ মালাবিকে বদলে দেওয়া কামকাওয়াম্বাকে নিয়ে নির্মিত হয়েছিল ‘দা বয় হু হার্নেস দা উইন্ড’ সিনেমা। যে ছেলেটি সাইকেলের চাকায় মটর লাগিয়ে উইন্ড টারবাইন তৈরি করে বাতাসকে কাজে লাগিয়েছিল। ভূগর্ভ থেকে পানি তুলে এনে খরা পীড়িত অঞ্চলটিকে ভরিয়ে দিয়েছিল সবুজের সমারোহে। কাতারে পুরো মরক্কো দলটিই যেন কামকাওয়াম্বা। বিশ্বকাপের আঙিনায় সাফল্য-খরা পীড়িত আফ্রিকার আশার পালে এখন পর্যন্ত বাতাস দিয়ে চলেছে তারাই।
ব্রাজিলকে হারিয়ে ইতিহাস গড়া ক্যামেরুন এবং ঘানা, সেনেগাল ও তিউনিসিয়া মরুর আসর থেকে এরই মধ্যে ঝরে গেছে। দোর্দণ্ড প্রতাপে টিকে আছে কেবল উত্তর-আফ্রিকার দেশ মরক্কো। যাদের নেই লিওনেল মেসি, নেইমার, ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো কিংবা কিলিয়ান এমবাপের মতো তারকা কিন্তু লালের বুকে এক তারকায় সাজানো পতাকাটি ঠিকই মরুভূমির বুকে উড়ে চলেছে।
এই দলে কাউকে যদি কামকাওয়াম্বা বলতে হয়, তিনি ওয়ালিদ রেগরাগি। মাত্র তিন মাস হলো দায়িত্ব নিয়েছেন মরক্কোর এই সাবেক রাইট-ব্যাক। খেলোয়াড়ি জীবনের মতো তিনি রক্ষণ জমাট রেখে দলকে তুলেছেন কোয়ার্টার-ফাইনালে। ২০১০ সালে ঘানার পর এই প্রথম আফ্রিকার কোনো দল উঠেছে শেষ আটের মঞ্চে। উত্তর আফ্রিকার এই দেশটির আরব ঘেঁষা বলে এটিকে ‘আরব নেশন’ও বলা হয়, সে হিসাবে প্রথম আরব দেশের কোয়ার্টার-ফাইনালে ওঠার গল্পও লিখেছে তারা। তাও যেন-তেন দল নয়, সাবেক চ্যাম্পিয়ন স্পেনকে টাইব্রেকারে হারিয়ে।
দারুণ এই পথচলা ফ্লুক নয় মোটেও। গত সাত ম্যাচে ওয়ালিদের অধীনের খেলা মরক্কোর জালের নাগাল পায়নি কোনো প্রতিপক্ষ। তিন প্রীতি ম্যাচে চিলিকে ও জর্জিয়াকে হারায় তারা, স্কোরলাইন যথাক্রমে ২-০ ও ৩-০। মাঝে গোলশূন্য ড্র করে প্যারাগুয়ের বিপক্ষে।
প্রীতি ম্যাচের সুর ধরে রেখে কাতার বিশ্বকাপেও দারুণ গতিতে ছুটছে তারা। গত আসরের রানার্সআপ ক্রোয়েশিয়াকে গোলশূন্য ড্রয়ে রুখে দিয়ে কাতার বিশ্বকাপে পথচলা শুরু মরক্কোর। এরপর বেলজিয়ামকে ২-০ গোলে উড়িয়ে, কানাডাকে ২-১ গোলে হারিয়ে গ্রুপ সেরা হয়ে উঠে আসে শেষ ষোলোয়। কানাডার বিপক্ষে ম্যাচে আত্মঘাতী গোল করেন নায়েফ আগের্দ।
শেষ ষোলোয় ইউরোপের সেরা দলগুলোর একটি স্পেনের বিপক্ষে মরক্কোর পক্ষে বাজি ধরার লোক খুব কমই ছিল। কিন্তু দৃঢ় রক্ষণ আর গতিময় পাল্টা আক্রমণে গ্রুপ পর্বে একের পর এক জয় তুলে নেওয়া আশরাফ হাকিমি-হাকিম জিয়াশরা শেষ পর্যন্ত বাজিমাত করে ছেড়েছেন। নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময়ে লুইস এনরিকের দলকে গোলশূন্য ড্রয়ে আটকে রেখে টাইব্রেকারে ৩-০ গোলে জিতে উঠে এসেছে কোয়ার্টার-ফাইনালে।
স্পেনকে হারানোর পর ওয়ালিদ বলেছেন, “আমি ম্যাজিশিয়ান নই।” এই মরক্কো দলে আসলেই কোনো জাদুকর নেই। এমবাপের মতো ৫টি, মেসির মতো ৩ গোলের পরিসংখ্যান কারো নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে না। কেউ নেই গোল্ডেন বুটের দৌড়ে। গ্রুপ পর্বে একটি করে গোল করেছেন চার জন- রোমাঁ সাইস, জাকারিয়া আবুখলাল, হাকিম জিয়াশ, ইউসুফ এন নেসরি। এই দলটিতে যেন সবাই নায়ক।
শেষ ষোলোর টাইব্রেকারে মরক্কোর জয়ের নায়ক অবশ্য গোলরক্ষক ইয়াসিন বোনো। পাবলো সারাবিয়ার শট পোস্টে লেগে ফিরে আসার পর কার্লোস সলের ও সের্হিও বুসকেতসের শট আটকান ৩১ বছর বয়সী এই গোলরক্ষক। এরপর চতুর্থ শটে হাকিমি লক্ষ্যভেদ করলে উল্লাসে ফেটে পড়ে মরক্কো, আফ্রিকাসহ আরবের অনেক অলি-গলি।
স্কুলে পড়া বয়সে ময়লার ভাগাড় থেকে কুড়িয়ে আনা ইলেক্ট্রনিক সরঞ্জাম দিয়ে রাত-দিনের প্রচেষ্টায় যেদিন কামকাওয়াম্বা উইন্ড টারবাইন তৈরি করে সেঁচের, তেষ্টা নিবারণের পানি তুলেছিলেন ভূমি গর্ভ থেকে, সেদিন আধুনিক সভ্যতার আলো থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে থাকা জনপদ কাসুঙ্গু গ্রামের দরিদ্র, ভুখা-নাঙ্গা মানুষগুলো দলাদলি ভুলে মেতেছিল বাঁধনহারা উচ্ছ্বাসে। আনন্দ অশ্রুতে ভিজতে ভিজতে পেয়েছিল নতুন আলোর দিশা। স্পেনকে হারিয়ে একই উন্মাদনার স্রোতে আফ্রিকার ফুটবলপ্রেমীদের ভেসে যাওয়ার উপলক্ষ্য এনে দিল মরক্কো।
দোহার আল থুমামা স্টেডিয়ামে আগামী শনিবার সেমি-ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে পর্তুগালের মুখোমুখি হবে মরক্কো। এ বাধা পেরুতে পারলে বিশ্বকাপের ইতিহাসে আফ্রিকার প্রথম দল হিসেবে সেরা চারে উঠবে তারা। যদি নাও পারে, তাহলেও মরক্কো থাকবে আফ্রিকার ফুটবলপ্রেমীদের মনে। মুরুভুমির বিশ্বকাপে যে আফ্রিকার আশার পালে সুবাতাস বইয়ে দিচ্ছে তারাই। অনাগত দিনে হয়ত তাদের নিয়েও নির্মিত হবে সিনেমা, নাম হবে ‘দা টিম হু হার্নেস দা উইন্ড।’