মরুঝড়ের বেগে বয়ে যাওয়া সময়ের কত টুকরো টুকরো স্মৃতি জায়গা করে নেয় মনে।
Published : 19 Dec 2022, 01:58 PM
সময় এমনই স্রোতস্বিনী! এই তো ২০ নভেম্বর পর্দা উঠল কাতার বিশ্বকাপের। এরপর যেন এক লহমায় চলে এলো ১৮ ডিসেম্বর। লুসাইল স্টেডিয়ামের রুদ্ধশ্বাস ফাইনালে ফ্রান্সকে টাইব্রেকারে হারিয়ে শিরোপার হাহাকার ঘোঁচাল আর্জেন্টিনা। জাদুকর লিওনেল মেসি পেলেন প্রথম বিশ্বকাপের অনির্বচনীয় স্বাদ।
মেসির মুখে এই প্রাপ্তির হাসি দেখতে পারার তৃপ্তি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। তেমনি কঠিন কিলিয়ান এমবাপের না পাওয়ার বেদনার ছবি আঁকা। নেইমার যে জ্বলে উঠলেন না, আরেক মহাতারকা ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো যে ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বিকেলে একেবারেই দ্যুতিহীন থাকলেন, তা দেখাও সমান কষ্টের।
বিশ্বকাপের আঙিনায় এক মাসেরও বেশি সময়ের পথচলায় কত ঘটনা, দুর্ঘটনা, স্মৃতির উঁকিঝুঁকি ইয়াত্তা নেই। এতদিন যাদেরকে টিভির পর্দায় খেলতে দেখা, সেই মহাতারকা মেসি, রোনালদো, নেইমারকে সকাল-সন্ধ্যা অনুশীলন করতে দেখা, খুনসুঁটি করতে দেখা অন্যরকম অভিজ্ঞতা। যদিও নানা নিয়মের বেড়াজালে হাত ছোঁয়া দূরত্বে থাকলেও কিছু বলতে না পারার আক্ষেপও কম নয়। কোনো সাবেক তারকার সঙ্গে কথা বলতে না পারার দুঃখ অপূরণীয় থাকবে।
ফাইনালের পর প্রথম মনে পড়ে দুজন গণমাধ্যমকর্মীর কথা। একজন লেকিপের উগো গিয়েঁমে। ফ্রান্সের সম্ভাবনা নিয়ে আসর শুরুর দিকে তার সঙ্গে কথা। ভ্রু কুঁচকে তরুণ ওই সাংবাদিক বলে দিলেন, “ফরাসিদের আশা নেই। বেনেজমা নেই, কঁতে নেই। আশা নেই।”
আরেকজন ১০টি বিশ্বকাপ কাভার করা ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিক বাতিস্তা নাদাল। ব্রাজিল, ফ্রান্সকে বাদ দিয়ে বলেছিলেন ফেভারিট আর্জেন্টিনা। দুজনেই কথা ফলেও গেল!
এই বিশ্বকাপে ভলান্টিয়ার থেকে শুরু করে অনেক কাজের সঙ্গে জড়িত দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ। ভারত থেকে আসা এক দল তরুণের সঙ্গে দেখা হয় আল বাইত স্টেডিয়ামে। এবার তাদের কলেজ থেকে ৫০ জন এসেছে দোহায় একটা ফুড কোম্পানির হয়ে ইন্টার্ন করতে। রবিন নামের ছেলেটি জানাল, এর আগে তারা আরব কাপেরও কাজ করেছে। বলল বেশ ভালো পারিশ্রমিক পাওয়ার কথা।
মেট্রোর মধ্যে নানা বয়সের, কত রং-বে রংয়ের মানুষের, ফুটবলপ্রেমীদের সঙ্গে দেখা। আট-দশ বছর বয়সী ছেলেটির নাম মোহাম্মদ হাদী। বাবা-মায়ের সঙ্গে সেমি-ফাইনাল দেখে ফিরছিল সে। গায়ে মেসির জার্সি পরা দেখে জিজ্ঞেস করলাম, “আজ কয়টা গোল দিলে?” একটু লাজুক হাসি দিয়ে বলল “একটা।” ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ৩-০ গোলে জেতা ম্যাচে একটা গোলই করেছিলেন মেসি। মনে মনে ভাবি, মেসি এভাবে স্বপ্নের বীজ বুনে দিচ্ছেন নাম না জানা এমন কত হাদীর মনে।
নিউজের প্রয়োজনে আল শাহানিয়া, আল সাদ স্পোর্টস ক্লাব, আল আরাবি স্পোর্টস ক্লাব, কিংবা কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন নম্বর মাঠে ছোটাছুটি করতে। ক্যাবের যাতায়াতে বাংলাদেশ, ভারত, নেপালের লোকজনের সঙ্গে কথা হয়। সবার কথাতে কঠিন বাস্তবতা জড়িয়ে।
পরিবার-পরিজন বাংলাদেশে রেখে দীর্ঘ ১৬ বছর দোহায় থাকার কারণ জানতে চাইলে বয়সী ‘আলী ভাই’ উত্তরের বদলে প্রশ্নই করে বসলেন!
“কত পড়াশোনা করলে বাংলাদেশে প্রতি মাসে দেড়-দুই লাখ টাকা আয় করা যায়? অল্প স্বল্প লেখাপড়া করেছি। বড় জোর ২০-৩০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি পেতাম। এখানে কমপক্ষে দেড় লাখ টাকা আয় করি।”
শুনে ‘থ’ হয়ে যাই, আবার ভালোও লাগে। বিদেশ-বিভূইয়ে পরিশ্রমের ফল অন্তত পাচ্ছেন আলী ভাইয়ের মতো দেশের আরও কত মানুষ, যাদের আমরা মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিক বা রেমিটেন্স যোদ্ধা বলি। এরাই দেশে ফেরার পর বিমানবন্দরে যাচ্ছেতাইভাবে নাজেহাল হওয়ার খবর প্রায়ই আসে গণমাধ্যমে।
নেপালের রাজকুমারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ঠাণ্ডার দেশ থেকে এই গরমের দেশে কেন? তার উপর আরও কঠিন।
“পায়সা কে লিয়ে। ইধার মে প্রাণ নেহি হে, লেকিন পায়সা হে।”
খেটে খাওয়া এই মানুষগুলো কথা মেসি, এমবাপেদের পারফরম্যান্সের মতো মনে ছাপ রেখে যায়। আবারও দাগ কেটে দেয় জাহাঙ্গীর নামের এক বয়সী লোক। লুসাইল স্টেডিয়ামে লাইভ দেওয়ার সময় তিনি এক সহকর্মীর সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত। কাজ শেষ করে তার সঙ্গে হাত মেলান। এরপর তিনি বলেন, “আসেন আপনাদের নিয়ে ফেইসবুক লাইভ করি।” আমরা দুজনেই সাড়া দেই।
“এই যে দেশ থেকে এসেছেন দুই সাংবাদিক ভাই। তাদের সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগল।”-এতটুকু পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু এরপরই তিনি জুড়ে দেন রাজনৈতিক কথাবার্তা। আমরা তো হতভম্ব! তিনিও বিষয়টি বুঝতে পেরে দ্রুত সটকে পড়েন! সমর্থকদের স্রোতে ভেসে আমাদের ধরাছোঁয়ার নাগালের বাইরে চলে যান।
এমন আরও কত কী! বিশ্বকাপ আসলে এমনই।