জার্মানি আমার কাছে স্বপ্নের দেশ৷ অফিস থেকে যখন সেই দেশে চারমাসের ইন্টার্নশিপে পাঠানোর কথা জানালো হলো, দারুণ খুশি হয়ে ছিলাম। আহা স্বপ্নের দেশ, এতো দিনে সেখানে যাওয়া সুযোগ পাচ্ছি।
Published : 20 Mar 2020, 05:26 PM
যদিও মনের কোণে কোথায় জানি তাল খানিকটা বেসুরে বাজছিল। ইউরোপ দেখার মজা তো গ্রীষ্মে, অথচ আমাকে যেতে হচ্ছে ডিসেম্বরে। যা হোক তবুও স্বপ্নের দেশ বলে কথা, লাগেজ গুছিয়ে চলেই এলাম। প্রথম দিকের উত্তেজনায় তীব্র ঠাণ্ডাও টের পাচ্ছিলাম না। নতুন সহকর্মীরা তা নিয়ে কিঞ্চিৎ হাসাহাসিও করেছে৷
দিন চলে যাচ্ছিল, চীনে উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস তত দিনে বিশ্ব উদ্বেগের কারণ হয়ে গেছে। ইউরোপ, বিশেষ করে ইতালিতে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে৷ বিস্তার ঠেকাতে বন্ধ হচ্ছে সীমান্ত৷ মনের কোণে কিছুটা উদ্বেগ দেখা দিলেও বরাবরের মত ডে অফের দিনগুলোতে বাসে- ট্রামে শহরময় ঘুরে ঘুরে কোথায় আগে ভাগে চেরি আর ম্যাগনোলিয়া ফুটবে তা দেখে রাখছি।
জার্মানিতেও ততদিনে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়া শুরু হয়েছে৷ অফিসে রীতিমত যুদ্ধ প্রস্তুতির তোড়জোড়৷ আর আমি আছি চেরি ফোটা নিয়ে৷ বন শহরের কোথায় কোথায় চেরি ফুটতে শুরু করেছে তা খুঁজে বেড়াচ্ছি৷ আর তো মার্চ মাসটাই আছি, তারপর ফিরে যাব নিজ দেশে; আপন ঘরে৷
ইতালিতে ততদিনে ভয়াবহ অবস্থা৷ স্কুল কলেজ বন্ধ, লকডাউনের ঘোষণা আসতে পারে যেকোনও সময়। দলে বাঙালি দেশের পানে ছুটছে। সরকার তাদের কোয়ারান্টাইনে রাখতে চাই, কিন্তু অব্যবস্থাপনার কথা বলে তারা থাকতে রাজি নয়। রীতিমতো ভাংচুর, আলোচনা-সমালোচনা, গরম ফেইসবুক৷ আমাদের অফিসেও পক্ষ-বিপক্ষ, খবর প্রকাশ, দায়িত্ব পালন, উত্তেজনা সবই আছে।
৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের ঘোষণা আসে৷ পরিবারের জন্য আমার চিন্তা বাড়ে৷ তারাও আমার জন্য দুশ্চিন্তা করছে৷
পরিবারের জন্য উদ্বেগের পাশাপাশি আমার মাথায় নতুন এক দুশ্চিন্তা ভর করেছে৷ দেশে ফিরতে পারবো তো? সহকর্মীদের বললাম কী হবে, তাদের উত্তর চিন্তার কিছু নেই। আমি তো নিশ্চিত হতে পারছি না৷ এরমধ্যে আচমকাই এলো ঘোষণা, যুক্তরাজ্য বাদে ইউরোপের অন্যান্য দেশের জন্য ৩১ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের দরজা বন্ধ৷ পরবর্তী সিদ্ধান্ত পরে জানানো হবে৷
মনে মনে তাড়াতাড়ি ফুল ফোটার প্রাথর্না করেছি, সে গাছের সব ফুল ফুটেছে। কি স্বর্গীয় তার সৌন্দর্য! আমি কেন খুশি হতে পারছি না৷ শুধু আমি না, পুরো বন শহরে কোথাও যেন খুশি নেই৷ জার্মানিতে অফিস আর স্কুল টাইম ছাড়া বাসে-ট্রামে তেমন ভিড় আমি দেখিনি৷ যদিও শুনেছি সামারে নাকি পুরো ভিন্ন চিত্র থাকে৷
গ্রীষ্ম এসেছে৷ চারিদিকে কত রঙের ফুল ফুটছে! গাছে গাছে নতুন পাতা৷ রাস্তায় সারি করে লাগানো চেরি গাছগুলো চোখে বড্ড আরাম দিচ্ছে৷ কিন্তু কেউ খুশি হতে পারছে না৷ খুব প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বের হচ্ছে না কেউ৷ ব্যতিক্রম আমিও নই৷ ডে অফ এখন ঘুমিয়ে, সিনেমা দেখে বা ফেইসবুকে কাটে৷ বই সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি৷ প্রতিদিন ঝলমলে রোদ উঠছে৷ অথচ এই সাড়ে তিন মাসে রোদের জন্য হাপিত্যেশ করেছি৷ প্রতিদিন প্যাচপ্যাচে বৃষ্টি কেমন হাঁপ ধরিয়ে দিত৷ এ ঘণ্টার রোদেও মন কেমন বাইরে যাওয়ার জন্য আকুপাকু করতো৷
জার্মানিতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেড়ে ১৩ হাজার ছাড়িয়েছে৷ যদিও অন্যান্য দেশের তুলনায় মৃত্যুর সংখ্যা কম৷ তারপরও মারা গেছেন ৩১ জন৷ আমার শহরেই ৭৫ জন আক্রান্ত৷
আমি জানি আমার এখন দেশে ফেরা উচিৎ না৷ আমি ফিরতে চাইও না৷ ভিসা জটিলতা আছে, অফিস থেকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও পেয়েছি৷ এই দুর্যোগে ছোট্ট ছেলেটাকে নিয়ে তার বাবার একা সব সামলাতে বেগ পেতে হচ্ছে, জানি সে পারবে৷ কিন্তু আমার দু:শ্চিন্তা তো কমছে না৷
এ দুশ্চিন্তা আমার আপনার সবার মাঝেই থাকুক৷ মনটা খারাপই থাকুক, দুঃখও পাই৷ কিন্তু সেই সঙ্গে যেন সচেতন হতে পারি৷ দয়া করে সচেতন হন, সামান্য ঝুঁকি থাকলেও নিজেকে আলাদা রাখুন। অন্তত নিজের পরিবারের জন্য৷
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |