জাপানে আসার মাস খানেক পর এক বাঙালি বড় আপু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য এসেছিল। তিনি আমার ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী। তার দু’জন ল্যাবমেটও ছিল বাঙালি।
Published : 13 Apr 2017, 10:42 AM
সাধারণত প্রতিদিন দূপুরের খাবারটা আমরা সব বাঙালি একত্রিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়াতে সারি। একদিন খাবারের পর আমরা কয়েকজন ল্যাবে ফিরছিলাম। ওই সময় ওই আপু তার বাঙালি ল্যাবমেটদের সাথে কথা বলছিল। কথা প্রসঙ্গে তার জ্যেষ্ঠ ল্যাবমেট আপু তাকে জিজ্ঞাসা করলো, “আচ্ছা তুমি আসার আগে তোমার অ্যাপ্লিকেশন অধ্যাপক আমাকে ফরওয়ার্ড করে দিয়েছিল, কিন্তু তোমার ইমেইল দেখলাম ‘সাকুরা’ নাম দিয়ে খোলা হয়েছে। এটার কারণ কী? বাঙালি মেয়ে হয়ে তুমি সাকুরা নাম দিয়ে খুলেছো কেন? প্রফেসর তো মনে করেছে, তুমি জাপানি কেউ?”
উত্তরে ওই আপু বললো, “আমি সাকুরাকে ভালবাসি।”
যা বাবা! আমি তাদের কথাবার্তায় কিছু বুঝলাম না। আমি জানতাম, ওই আপু বিয়ে করেছেন, ওনার একটি সন্তানও আছে। তাহলে সাকুরাকে ভালবাসতে গেল কেন? আমি ভেবেছিলাম, সাকুরা কোন ছেলের নাম।
এই যা! সাকুরার নাম উনি কীভাবে জানলো? আমি তো কিছু না বুঝেই বলে ফেললাম, “হ্যাঁ, সাকুরার নাম শুনেছি। এক বড় আপু ওনাকে খুব ভালবাসে।”
এই কথা শোনার পর ল্যাবে হাসির রোল পড়ে গেল। আমি তো লজ্জায় লাল হয়ে গেছি। এরপর আমাকে বললো, “ডু ইউ নো চেরি ব্লোজম? হ্যাভ ইউ এভার সিন?”
আমি এবার নিজের বোকামিটা বুঝতে পারলাম। সাকুরা সম্ভবত জাপানের কোন কিছু হতে পারে। তাই হয়তো আমার ল্যাবমেটরা আমাকে জিজ্ঞাসা করছে। যাই হোক, আমি এইবার ‘না’ সূচক উত্তর দিলাম।
এইবার তিনি একটু মুচকি হেসে বললেন, “আরে বোকা, সাকুরা হলো জাপানের এক ধরনের ফুল। যা দেখতে অনেক সুন্দর। জাপানিরা সাকুরা ভালবাসে জেনে আমি কৌশলে আমার ইমেইলের নাম সাকুরা দিয়ে খুলেছি।”
সাকুরার প্রথম অভিজ্ঞা এমন হলেও ধীরে ধীরে বসন্তের এই ফুল মনের সুর তুলে দেয়। সাকুরা’কে এই দেশের জাতীয় ফুল মনে করা হয়। বিভিন্ন দেশে এই সাকুরা ‘চেরি ফুল’ হিসেবে পরিচিত হলেও জাপানিরা আদর করে ডাকে ‘সাকুরা’।
তবে মজার ব্যাপার হলো, চেরি বলে দাবি করা ফুলগুলো আসলে চেরি ফলের গাছের নয়। আমাদের মস্তিষ্কে সেই এন্ড্রু কিশোরের সেই গানটি রয়ে গেছে।
‘ও গো বিদেশিনী,
তোমার চেরিফুল দাও,
আমার শিউলী নাও।
দু’জনে প্রেমে হই ঋণী।’
সাধারণত ফুল দেয় এমন গাছের এক সাথে ফুল ফোটাকে ‘চেরি ব্লোজম’ বলা হয়।
ফুলের প্রতি আমার বিশেষ দুর্বলতা আছে। আমি যখন রাস্তা দিয়ে বের হই, পথে কোন ফুল চোখে ধরা পড়লে দাঁড়িয়ে যাই। কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষাও করি। আর হাতে ফোন থাকলে ছবি তোলা মিস যায় না। এই রকম নাম না জানা কত ফুলের ছবি যে আইফোনে জমা পড়েছে, তার হিসাব নাই। তবে সব কিছু ছাপিয়ে আমি সাকুরার একজন অন্ধ ভক্ত।
এই বছর মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তার পাশে শোভা বর্ধনকারী গাছগুলোতে যেন সাদা প্রতিযোগিতা চলছে। যেদিকে তাকাই শুভ্রতার পবিত্রতা ভাব। জাপানে প্রায় দুই শতাধিক সাকুরা প্রজাতি রয়েছে। এইসব গাছের ফুলগুলো সাধারণত রঙিন হয়।
সাধারণত সাকুরার সময় সমগ্র জাপান জুড়ে একটা উৎসব চলে, যাকে জাপানিরা বলে ‘হানামি’। হানামি জাপানি ভাষা, যার অর্থ হলো ‘দল বেঁধে সাকুরা দর্শন’। তাই এই সময়টাতে পার্ক কিংবা দর্শণীয় স্থানগুলোতে উপচে পড়া ভিড় চলে।
চেরি গাছের নিচে ছোট ছোট তাবু বসিয়ে দুপুরের খাবার আর নাস্তা যেন জাপানের আদি কোন সংস্কৃতি। এই জাতি যে যুগে যুগে দেশটির সংস্কৃতিকে হৃদয়ে লালন করতে পারে, তা বিশ্বের অন্য কোন দেশ ততোটা পারে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ জাগতেই পারে।
সেই ১৭২০ সালে তকুগায়া ইয়োশিমুনে নামক এক ব্যক্তি আসুকায়ামা পার্কে একটি বড় গাছ লাগিয়েছিলো। আর সেই গাছের নীচে সাকুরা ফুলের আভাসে ‘সাকে’ (জাপানি মদ) পান করার রীতি চালু করার পর থেকে চলে আসছে ‘হানামি’ উৎসব।
আর উৎসব করবেই বা না কেন? এই সাকুরা কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই দেশের যোদ্ধাদের কম অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে? লোক মুখে শুনেছি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি সৈন্যরা সাকুরার বিভিন্ন প্রজাতির নাম অনুসারে দল তৈরি করতো, গোপানে বার্তা আসতে সাকুরার নামে। জাপানি দেশপ্রেমের অংশ হিসেবে সাকুরার সৌন্দর্য সৈন্যদের মনোবল শক্ত করতো।
আর এজন্যই দল বেঁধে সাকুরা দেখতে যাওয়া জাপানিরা নিজেদের মনে জাপান প্রেমই মনে করে। আমরাও বাঙালিরা যে হানামি করি না, তা নয়। গেল বছর, আমরা ওসাকার স্থানীয় একটি পার্কে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করেছিলাম। ওই সময় সাকুরার পূর্ণ প্রস্ফূটন রথ দেখা, কলা বেচার সমতুল্য।
আর আমার ল্যাবের ডেক্সের পাশে জানালা দিয়ে দেখতে পাই সাদা মেঘমালা কাঁচের জানালাকে চুমু দিয়ে যাচ্ছে। তবে আমার ল্যাবে বছরের পর বছর ধরে একটি ঐতিহ্য ধরে রেখেছে, তা হলো- সবাই মিলে কোন এক বিকেলে সাকুরা দর্শন। এই তো গেল সপ্তাহে ক্যাম্পাসেই সাকুরা গাছের নীচে চললো স্নাক, সফট ড্রিংকস, গাল-গল্প আর ছবিবাজি।
সারি সারি গাছের নীচে খাবার-দাবার নিয়ে বসে পড়েছে শত শত মানুষ। সেই সাথে চলছে ফুড ফেয়ার। কেউ তুলছে সেলফি, কেউ বা গ্রুফফি। মজার ব্যপার হলো, এরা অত্যন্ত শান্ত। কোথাও কোন হৈ চৈ নেই। নিরিবিলি পরিবেশে যে যার মতো করে আনন্দ করে যাচ্ছে। নানার বয়সের মানুষের আড্ডায় মুখরিত হয়ে গিয়েছিল পুরো পার্ক।
সাকুরা পার্কে বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে ছিল- টিউলিপ বাগান। বেগুনি, রক্তাভ, হলুদ, সাদা রং টিউলিপে ছেঁয়ে গেছে একটি এলাকা। আহা, শান্তি শান্তি শান্তি! যে মনগুলোতে প্রেমের বাতাস লাগেনি, যে ব্যক্তি গম্ভীর, তারা যদি এই টিউলিপ বাগানে ঘুরতে আসতেন, তাহলে অনায়াসে প্রেমে পড়ে যেতেন! কাব্যিক মনে কবিতাও কিলবিল করে বেড়াতো।
এই রূপের বর্ণনা দিতে অনেকে জাপানি কবি-সাহিত্যেকদের হিমশিম খেতে হয়েছে। আমাদের মতো বাঙালিদের মনে সাকুরার প্রেম যে মানবিক, তা টের পাই যখন সাকুরারা ঝরে পড়ে। মাত্র দুই কিংবা তিন সপ্তাহের মধ্যে পাপড়ি বিচ্যুত করে নব কুঁড়িকে আহ্বান করে। আর তাকে সহায়তা করে বৃষ্টি।
অভিজ্ঞতার তিন বছরে এই সময়গুলোতে বৃষ্টির দৌরাত্ম্য বেশি বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে। এরপর কালের পরিক্রমায় হানামি ঐতিহ্য জাপানিদের কাছে অতিপ্রিয় হয়ে থাকছে। আর প্রবাসে এসে তার প্রেমে হাবুডুবু খেতে হয় আমাদের। একদিন হয়তো এই সৌন্দয্যের জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠবো। তারপরও ভালবাসা অফুরান হয়ে স্মৃতিপটে জমা থাকবে প্রেয়সী সাকুরা।
ছবি কৃতজ্ঞতা: এস এম নাদিম মাহমুদ, ওমর ফারুক, ওয়ানক্য থোঁইন (নিং নিং)
লেখকের ইমেইল: [email protected]
এই লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |