২০১৪ সালের অক্টোবরে যখন জাপানে আসি, তখন সবে শীতের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সপ্তাহ দুয়েক পর অনেকে শীতের পোশাকে ল্যাবে যেতে শুরু করেছিল।
Published : 16 Jan 2017, 05:25 PM
আমি তখনও টি-শার্ট পড়ে আসতাম। শীতের মাত্রাটা শরীর যে এত সহজে মেনে নিয়েছিল, তা নিজের কাছেই বেশ অবাক লেগেছিল।
যাহোক, একদিন আমার এক ল্যাবমেট জিজ্ঞাসা করলো, “আচ্ছা নাদিম তোমার শীত করে না? তোমার দেশে কি এমন শীত?”
মোবাইলে ওয়েদার অ্যাপসে দেখলাম, সেদিন তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আমি তখন বললাম, “আসলে এখানকার তাপমাত্রা আমার দেশের মতোই। তাই তেমন কিছু মনে হচ্ছে না।”
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুবাদে সাত বছরের বেশি থাকতে হয়েছে। শীতকালে এই অঞ্চলের তাপমাত্রাও ৭ থেকে ১৬ পর্যন্ত। তাই জাপানে এসে শীতের তীব্রতা কিছুটা স্বাভাবিক মনে হয়েছে।
উত্তরে সেই সহপাঠী আমাকে জানালো, “আসলে জাপানের মধ্যে এই ওসাকা শহরের তাপমাত্রা অন্যান্য শহরের তুলনায় মডারেট। এখানে শীতকালে তেমন শীত থাকে না আর গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি পর্যন্ত চলে যায়। তাই বলতে গেলে এই প্রদেশটি অনেকটাই ভিন্ন। আর বছরে কেবল জানুয়ারিতে দুই-তিন দিন তুষার পড়ে। সেটাও খুব বেশি না।”
আসলে ওসাকাকে আমার কাছে বাংলাদেশের রাজশাহী শহরই মনে হয়েছে। নিজ দেশের তাপমাত্রার মতো এই শহরটাকে মেনে নিতে পেরেছি সহজেই।
কিন্তু শীতকালে অন্যন্য অঞ্চলের বাঙালিদের তুষার উদযাপনের ছবি যখন দেখতে পাই, তখন নিজেকে বড্ড অসহায় লাগে। জাপানে থাকি অথচ তুষার দেখতে পারবো না, তা কি করে হয়!
দেশটিতে বছরের শেষ দিকে এক সপ্তাহ ছুটি থাকে। এবার ২৭ ডিসেম্বর থেকে ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত ছুটি ছিল। তাই এইবার মোটা দাগে প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছিলাম, জাপানে যে অঞ্চলগুলোতে তুষার পড়ে, সেখানে ঘুরতে যাব।
কিন্তু মনের চাওয়ার সাথে বাস্তবতার সন্ধি না হলে সেটা যে অতৃপ্ত থেকে যায়, তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। পরিকল্পনা নিয়েও বিভিন্ন কারণে কোথাও যেতে পারিনি। তাই আক্ষেপের পাল্লাটা একটু বেশি ভারি।
টানা ছয়দিন যন্ত্রজাতির ঐতিহ্যবাহী পরিশ্রমের পর ছুটির দিনগুলোকে জাপানিরা ‘আনন্দময় কিংবা উৎসবমুখর দিন’ বলেই মনে করে। আমার কাছেও এই দিনগুলোকে ঈদের মতোই মনে হয়।
কিন্তু আমার ছুটির দিনে ঘুমানোর অভ্যাস থাকলেও নিত্যদিনের অভ্যাসে সকাল ৮টার মধ্যে ঘুম ভাঙে। ক্যাম্পাস থাকে না বলে একটু আনন্দেও ফুলকি মনে লাগিয়ে ফের কম্বলে দেহটাকে এলিয়ে দিই আর ঠিক দুপুরে উঠে পড়ি। গত দুই বছর ধরে এমন বাজে অভ্যাস শরীর যথাযথ মর্যাদায় গ্রহণ করে ফেলছে।
জাপানে সূর্যোদয় হয় ৭টায় আর ৯টার মধ্যে ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য প্রতিদিনই আমার সোয়া ৮টায় ঘুম ভাঙা এক ধরনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। রোববারও যথারীতি ঘুম ভাঙলো সোয়া আটটার দিকে। যদিও আগের রাতে মাইনাস তাপমাত্রা অনুভব করতে হয়েছে। আর আমি যে ডরমিটরিতে থাকি তা বলতে গেলে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সড়কের পাশে।
ঘুম থেকে উঠে জানালার পর্দা সরাতে জানালার কাঁচে সাদা চাদরের আস্তরণ দেখতে পেলাম। এরপর সামনে দিকে তাকাতে দেখলাম পুরো রাস্তা সাদা হয়ে আছে। বাড়িগুলোকে মনে হলো মেঘের ভেলা। বিমানে আসার সময় দূরাকাশে যে শুভ্র ভেলা দেখেছিলাম, ঠিক সেই রকম কিছু মনে হলো। রাস্তায় গাড়িও কম চলছে। আর আকাশ থেকে অঝোরে ঝড়ছে তুষার।
‘আহা, স্নো স্নো স্নো!’ বলে একটা চিৎকার দিয়ে উঠলাম। উজ্জ্বল রৌদ্দুর দেখে স্নো আরও বেশি শুভ্রতা ছড়াচ্ছিল। আর ঘরে বসে থাকতে পারলাম না। তুষারকে স্পর্শ করার এক ধরনের তীব্র বাসনা মনের ভেতর যে দীর্ঘকাল লুকিয়ে ছিল, তা আজ হানা দিলো।
ডরমিটরি থেকে বের হয়ে যখন হাঁটছিলাম তখন সিঁড়িতে জমে থাকা তুষারের স্তুপ আমার পা দু’টিকে লুকিয়ে ফেলছিল বারবার। মনে হলো, এই তুষার আমাকে বুঝি দরজা থেকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে।
বাইরে নেমেই দুই হাত আর মুখে ছুটে আসা তুষারের স্পর্শে সমস্ত শরীরে এক ধরনের শিহরণ অনুভব করলাম। এবার রাস্তা দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। গন্তব্য আমার ডরমিটরির পাশে থাকা স্থানীয় এক পার্কে। পুরো রাস্তায় জমে থাকা বরফের স্তুপ। আমি যখন পা দিচ্ছিলাম তখন এক ধরনের ‘কচ কচ’ শব্দ। মনে হচ্ছে আমার স্পর্শে বরফের স্তুপ লাজুক হয়ে পড়ছে।
পার্কে গিয়ে দেখি দুইটি ছয়-সাত বছরের শিশু আর এক মধ্যবয়সী নারী তুষার জড়ো করে পার্কের বেঞ্চে একটি মূর্তি তৈরি করছে। ভদ্র মহিলাকে দেখে ওই দুই শিশুর দাদী বলেই মনে হলো। আমি অবাক হয়ে তাদের কার্যকলাপ দেখছিলাম!
সূর্যের উজ্জ্বল আভায় হাস্যোজ্জ্বল শিশু দুইটি আমাকে দেখে বলতে শুরু করলো, “ইউকি ইউকি ইউকি মাসুরি...।”
জাপানি ভাষায় 'ইউকি' মানে হলো 'স্নো' বা 'তুষার'। আর 'ইউকি মাসুরি' মানে হলো 'বরফের উৎসব'। আমিও বরফের স্তুপ নিয়ে তাদের মূর্তি তৈরি করতে সহায়তা করলাম।
আমার সঙ্গ পেয়ে ভদ্র মহিলা বলতে শুরু করলো, "আনাতাওয়া ইয়াসাসিনে (তুমি খুব দয়ালু)।" এরপর শিশু দুইটির সাথে দৌঁড়-ঝাপ করলাম। বরফের মূর্তির সাথে একটি সেলফি নেওয়ার পর আমার আইফোন ডাউন হয়ে গেল। অনেক চেষ্টা করেও তাকে জাগাতে পারলাম না। মন খারাপ করে ডরমিটরিতে ফিরে গেলাম।
এরপর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ক্যাম্পাসের দিকে রওনা দিলাম। যদিও কোন বন্ধু ছাড়া আমার ঘোরাঘুরি একদম ভাল লাগে না। কিন্তু এখানে এমন বন্ধু পাব কই? এখানে বসবাসরত প্রায় সব বাঙালিই পরিবার নিয়ে ব্যস্ত। তাই একাই রওনা দিলাম।
ক্যাম্পাস ছুটি থাকায় মানুষজনের চলাফেরাও কম। রাস্তাগুলোতে তুষারের স্তুপ জমা হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে স্পঞ্জ দিয়ে তৈরি কোন রাস্তা। রাস্তার পাশে শোভা বর্ধনকারী গাছগুলোর উপর বরফ জমে সাদা আস্তারণ তৈরি করেছে। পাতাগুলোয় জমে থাকা বরফে যখন সূর্যের আলো পড়ছে, তখন সহসাই গাছগুলো যেন মুচকি হাসি দিচ্ছে। অপূর্ব এই দৃশ্য যে কেবল উপভোগের নয়, তা প্রকৃতি প্রেমের একটি অনবদ্য অংশও বটে।
বিকালে সোনা ঝরা রোদে ক্যাম্পাসের অদূরে পাহাড় সেজেছিল অপরুপ সাজে। গাছগুলোর উপর জমে থাকা বরফ দূর থেকে আমার কাছে ‘দৃষ্টিনন্দন মাউন্ট ফুজি’ মনে হচ্ছিল। সাদা মেঘ আর পাহাড়ের শুভ্রতায় এক অপূর্ব মিলন দেখলাম।
সারাদিন ঘোরাঘুরি করে সন্ধ্যায় গেলাম সুপারশপে। যদিও আমি সুপারশপে গেলে আমার ছোট বাইসাইকেল চেপেই বেশি যাই, কিন্তু তুষারের আস্তরণে রাস্তায় বেশ কিছু দুর্ঘটনা দেখলাম। অনেককে বাইসাইকেলে বরফে স্লিপ কেটে পড়ে থাকতে দেখেছি। তাই এদিন সুপারশপে হেঁটে গেলাম।
আকাশ থেকে তুষার ঝরা বন্ধ ছিল তখন। সুপারশপে প্রয়োজনীয় কেনাকাটার পর যখন বের হবো, ঠিক তখনই অঝোর ধারে তুষার পড়তে শুরু করলো। নিমিষেই রাস্তায় ফের তুষারের স্তুপ হয়ে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন তুষার কমছিল না, তখন বের হলাম। প্রধান রাস্তা দিয়ে না গিয়ে অলিগলি দিয়ে হাঁটছিলাম।
জাপানের বড় সমস্যা হলো, এই দেশের রাস্তাগুলো প্রায় সবগুলো দেখতে এক রকম। তাই এরা গুগল ম্যাপ ছাড়া কোথাও বের হয় না। আমি সচারাচর যে গলি দিয়ে ডরমিটরিতে ফিরি, আজ সেই গলি আচমকা হারিয়ে ফেললাম।
আমি যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম তখন রাস্তায় নিস্তব্ধতা। কোথাও কেউ নেই। তুষার তীব্রতর হচ্ছে। আমার জ্যাকেট আর মাথার টুপিতে এতোটাই বরফের স্তুপ পড়েছিল যে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল।
সুপারশপ থেকে আমার বাসায় যেতে যেখানে ১৫ মিনিট লাগে সেখানে আমি পুরো একঘণ্টা হাঁটাহাঁটি করে পৌঁছাতে পারলাম না। এদিকে হাতে থাকা জিনিসপত্রে বরফের আস্তরণ পড়ে গেছে।
হাতের আঙ্গুলের ব্যথা থেকে মুক্তির জন্য হঠাৎ মনে হলো রাস্তার পাশে ভেন্ডার মেশিন থেকে কফি কেনা। গরম কফি খেলে নিশ্চয় শরীরের তাপমাত্রা কিছুটা বাড়বে। রাস্তা ভুল করায় ফের সুপারশপে দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।
কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর একটা ভেন্ডার মেশিন চোখে পড়লো। দ্রুত সেখানে গিয়ে হাতে রাখা জিনিসগুলো ফেলে একটা ‘কফির ক্যান’ কিনলাম। গরম কফির ক্যানে কিছুক্ষণ হাত রেখে অবশ হওয়া হাতে রক্ত সঞ্চালন শুরু হল। আহা শান্তি!
এইভাবে দুই হাতে কিছুক্ষণ কফির ক্যান নেড়েচেড়ে পান করার পর ফের হাঁটা শুরু করছি ডরমিটরির দিকে। অনেক কষ্ট করে চেনা রাস্তা খুঁজে পেলাম। রুমে যখন ফিরলাম, তখন নিজেকে আয়নার সামনে ‘ইউকি মূর্তি’ মনে হলো। আর কিছুক্ষণ বাহিরে থাকলে হয়তো আমার দেহের বাতাস ফুরিয়ে যেত, হয়ে যেতাম কোন জীবন্ত মূর্তি।
একদিনের তুষার বিলাস করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হলো, তা সারা জীবনের স্মৃতি। যদিও শেষটা হুমকির মধ্যে ছিল, তারপরও শুভ্রতার প্রেমে নিজেকে প্রতি বছরই সিক্ত করতে চাই।
প্রেয়সী নয়, প্রকৃতির প্রেমে হাবুডুবু খেতে চাই বারবার।
লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক
ইমেইল: [email protected]
এই লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |