কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি ৩২: বিদ্যুৎ যেভাবে ১৬৫০ ডলার হারাতে বসেছিলেন

কানাডা অভিবাসনে বিশ্বব্যাপী মানুষের আগ্রহকে পুঁজি করে দেশি-বিদেশি প্রতারকচক্র দীর্ঘকাল ধরেই মাঠে সক্রিয়।

এম এল গনিএম এল গনি
Published : 31 August 2023, 07:16 AM
Updated : 31 August 2023, 07:16 AM

বিদ্যুৎ (ছদ্মনাম) নামের একজন দেশ থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। উদ্দেশ্য, তার কানাডা অভিবাসনের সম্ভাবনা নিয়ে প্রফেশনাল কনসাল্টেশন বা পরামর্শ। 

বিদ্যুতের যোগ্যতা কী? পেশায় তিনি একজন অ্যাকাউন্ট্যান্ট। সাত বছরের কাজের অভিজ্ঞতা আছে এক প্রতিষ্ঠানে। ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা ভালো, তবে আইইএলটিএস পরীক্ষা এখনও দেননি। বিদ্যুৎ বিবাহিত। তার স্ত্রী মাস্টার্স ডিগ্রিধারী, তবে গৃহবধূ। এক সন্তান এ দম্পতির।

সরাসরি পিআর (স্থায়ী অভিবাসন) আবেদন দাখিলের উপযুক্ত মনে না হওয়ায় তাকে পরামর্শ দিলাম কানাডায় একটি উপযুক্ত বিষয়ে পড়াশোনা করার চেষ্টা চালাতে। কানাডায় পড়াশোনা করতে আর্থিক সামর্থ্য দরকার। তবে কানাডায় পড়াশোনা চলাকালে একইসঙ্গে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয় বলে দীর্ঘ মেয়াদে পড়াশোনায় আর্থিক ক্ষতি হয় না।

তাছাড়া কানাডায় পড়াশোনা শেষ করতে পারলে পিআর আবেদনে অতিরিক্ত পয়েন্ট পাওয়া যায়। বলা বাহুল্য, কানাডার অভিবাসন পয়েন্টভিত্তিক। যার সিআরএস পয়েন্ট (স্কোর) যত বেশি তার স্থায়ী অভিবাসনের আবেদন অনুমোদনের সম্ভাবনাও ততো বেশি। বিকল্প পরামর্শ হিসেবে কানাডা থেকে সরাসরি জব অফার সংগ্রহের চেষ্টা চালাতে বললাম তাকে। কারণ কানাডার জব অফার থাকলেও পিআর আবেদনে অতিরিক্ত পয়েন্ট পাওয়া যায়।

অবশেষে পড়াশোনার জন্য হাতে পর্যাপ্ত অর্থের যোগান নেই জানিয়ে কানাডা থেকে জব অফার সংগ্রহের আগ্রহ প্রকাশ করলেন বিদ্যুৎ। এ অবস্থায় তার প্রথমেই খুঁজে বের করতে হবে জব অফার দেওয়ার উপযুক্ত একজন কানাডিয়ান নিয়োগকর্তা।

আজকাল কানাডার ভুয়া জব অফার বিক্রি হচ্ছে দেদারসে। তাই খুব পরিচিতজন বা বিশ্বাসযোগ্য রেফারেন্স ছাড়া অন্য কারো মাধ্যমে কানাডা থেকে জব অফার সংগ্রহের চেষ্টা না চালাতে তাকে পরামর্শ দিলাম। কানাডা অভিবাসনে বিশ্বব্যাপী মানুষের আগ্রহকে পুঁজি করে দেশি-বিদেশি প্রতারকচক্র দীর্ঘকাল ধরেই মাঠে সক্রিয়। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইমেজ প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে প্রতারকরা এ অপকর্ম করে থাকে। ফলে বুঝা দুষ্কর হয়ে পড়ে কোনটি প্রকৃত আর কোনটি ভুয়া ডকুমেন্ট। 

যাই হোক, কয়েক মাস ধরে অনলাইনে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে সিভি/প্রোফাইল পাঠিয়ে অবশেষে এক জায়গা থেকে বিদ্যুৎ ইতিবাচক সাড়া পেলেন। উত্তরদাতা নিজেকে রিক্রুটমেন্ট এজেন্ট পরিচয় দিয়ে শুরুতেই বিদ্যুৎকে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা পরীক্ষার জন্য অনলাইনে একটি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে অনুরোধ জানালেন। 

বিদ্যুৎ সে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলেন। নিয়ম মতো, ৩০ মিনিটের পরীক্ষায় পাস করতে ৮০ শতাংশ নম্বর পেতে হয়। তিনি পেলেন ৭০-এর একটু বেশি। দুই সপ্তাহ পর দ্বিতীয়বার পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হলো তাকে। এবার তিনি ৮৬ শতাংশ পেয়ে উত্তীর্ণ হলেন। তারপর কানাডা যাওয়া নিয়ে আশার আলো দেখতে শুরু করলেন বিদ্যুৎ। 

এর কয়েকদিন পর চাকরির প্রথম দফা ইন্টারভিউর জন্য তাকে ইমেইল করা হলো। তিনি ভিডিওর মাধ্যমে ইন্টারভিউতে হাজির হলেন। তাকে অ্যাকাউন্টিং বিষয়ের পাশাপাশি কয়েকটি অ্যাকাউন্টিং সফটওয়্যার নিয়েও প্রশ্ন করা হলো। ইন্টারভিউ নিয়েছেন দুই শ্বেতাঙ্গ। বিদ্যুৎ সে ইন্টারভিউতে দারুণ সাফল্য লাভ করলেন। সঙ্গত কারণেই কানাডা নিয়ে তার আত্মবিশ্বাস আরেক দফা বেড়ে গেলো।

ইন্টারভিউ যারা নিয়েছেন তারা নিজেদের সাবজেক্ট মেটার এক্সপার্ট বা বিষয়বস্তু বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচয় দিলেন। বললেন, তারা তাদের ফাইন্ডিংস বা মতামত কোম্পানির এইচআর (হিউমেন রিসোর্সেস/মানবসম্পদ) বিভাগকে জানিয়ে দেবেন। এইচআর উপযুক্ত মনে করলে তারা পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য প্রার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ করবে, অন্যথায় নয়। তবে ইমেইলে নিয়মিত চোখ রাখতে বিদ্যুৎকে পরামর্শ দিলেন তারা। 

৩ দিনের মাথায় এইচআর বিভাগ ইমেইলে দ্বিতীয় দফা ইন্টারভিউয়ের জন্য তাকে ডাকলো। এই ইন্টারভিউতে ছিলেন এক শ্বেতাঙ্গ নারী ও এক কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ। দেয়ালজুড়ে কোম্পানির কর্পোরেট অফিসের লোগো রয়েছে ওই দুজনের পটভূমিতে। আলো ঝলমলে ফকফকা অফিস। 

এই ইন্টারভিউতে কিছু প্রশ্ন করে তাকে চূড়ান্ত নির্বাচনের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হলো। বলা হলো, কেবল জব অফার নয়, সরাসরি ওয়ার্ক পারমিটের আবেদনও প্রসেস করা হবে তার জন্য। অর্থাৎ, তাকে আর জব অফার নিয়ে ইমিগ্রেশন কন্সালটেন্টের (এক্ষেত্রে আমার) কাছে যেতে হবে না; তারাই ভিসার বিষয়টি চূড়ান্ত করে দেবেন। আরো বলা হলো, কোম্পানির এইচআর ডিপার্টমেন্ট কানাডার হাই কমিশনে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেবেন বিদ্যুৎকে চূড়ান্ত নির্বাচনের বিষয়টি। হাই কমিশন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে একমত হলে বিদ্যুৎকে সরাসরি চিঠি দিয়ে কানাডার ভিসা সম্পর্কে পরবর্তী নির্দেশনা দেবে। 

চার-পাঁচ দিনের মাথায় বিদ্যুৎ কানাডীয় হাই কমিশন থেকে বহুল প্রত্যাশিত সেই চিঠি পেলেন। তাকে অভিনন্দন জানিয়ে চিঠিতে নির্দেশনা দেওয়া হলো কিছু ডকুমেন্ট সরাসরি হাই কমিশনে ইমেইল করতে, একইসাথে ঢাকার কোন এক প্রাইভেট ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্টে ভিসা ও এপ্লিকেশন প্রসেসিং ফি বাবদ কানাডিয়ান ১ হাজার ৬৫০ ডলার দশ দিনের মধ্যে জমা দিতে।  

তড়িঘড়ি পাসপোর্টের কপি, জন্মসনদসহ তালিকার অন্যান্য ডকুমেন্ট ওদের দেওয়া ইমেইল ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলেন বিদ্যুৎ। তারপর, ব্যাংকে জমা দেওয়ার জন্য অর্থ জোগাড়ে নেমে পড়লেন তিনি। কানাডিয়ান ১ হাজার ৬৫০ ডলার কিন্তু বাংলাদেশি মুদ্রায় বেশ বড় অংকের অর্থ। এত টাকা খুব কম মানুষেরই বাসায় বা হাতে থাকে। তাছাড়া এত দ্রুত কানাডা যাওয়ার বিষয়টি ফায়সালা হয়ে যাবে তা বিদ্যুৎ-এর ধারণায়ও ছিল না। 

লাখখানেক টাকার সঞ্চয়পত্র আছে বাংলাদেশ ব্যাংকে বিদ্যুতের। তা ভাঙাতে সেখানে গেলে ব্যাংকের পরিচিত এক অফিসার তার কাছ থেকে সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর কারণ জানতে চাইলেন। কথাগুলো গোপন রাখার শর্তে বিদ্যুৎ তাকে সবকিছু খুলে বললেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সেই অফিসার তাৎক্ষণিক ওই প্রাইভেট ব্যাংকে ফোন করে যে অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিতে হবে ওই বিশেষ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে জানতে চাইলেন ম্যানেজারের কাছে।  

ম্যানেজার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন সেটি একটি জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট যা কয়েক রাজনৈতিক প্রভাবশালীর নামে খোলা। একই সঙ্গে তিনি ব্যক্তি বিশেষের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কেন কানাডার ভিসা প্রসেসিংয়ের ফি জমা হবে তা নিয়েও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন।  

দুই ব্যাংক অফিসারের কথোপকথন শুনে বিদ্যুতের মাথায় এতদিন যেসব প্রশ্ন জাগেনি তা উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলো। সঞ্চয়পত্র ভেঙে এই অর্থ নির্দেশিত অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া ঠিক হবে কিনা তা নিয়ে তিনি নিজেও সংশয়ে পড়লেন। ব্যাংক কর্মকর্তার পরামর্শে সেদিনই বিদ্যুৎ ঢাকাস্থ কানাডিয়ান হাই কমিশনে যোগাযোগ করে তাদের ইস্যুকৃত চিঠির কপি দেখালে সেই চিঠি এবং ইমেইল এড্রেস ভুয়া বলে হাই কমিশন নিশ্চিত করল। 

এমন নাটকীয় ঘটনায় বিদ্যুৎ ও তার পরিবারের কাছে সবকিছু স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছিল। তারা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না দেশি-বিদেশি চক্রের প্রতারণার বলি হতে যাচ্ছিলেন তারা। সোজা কথা, দেশি-বিদেশি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের হাতে পড়েছিলেন এ দম্পতি। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল বলেই সেদিন তাদেরকে এ বিশাল অংকের অর্থ হারাতে হয়নি। 

কিছুদিন আগে সেই বিদ্যুৎ আমার সঙ্গে আবারও যোগাযোগ করে কানাডার জব অফার সংগ্রহের চেষ্টা তিনি আর করবেন না বলে জানালেন। বিকল্প হিসেবে আইইএলটিএস পরীক্ষা দিয়ে স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে পড়াশোনা করতে কানাডা যাওয়ার সিদ্ধান্তই পাকা করলেন তিনি। অর্থাৎ ছাত্রত্ব দিয়ে শুরু করে শেষতক স্থায়ী অভিবাসনের (পিআর) আবেদন দাখিলই তার লক্ষ্য এখন। তিনি হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন, অপরিচিত কোন সূত্র হতে কানাডার জব অফার সংগ্রহের প্রচেষ্টা কতখানি ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

এ লেখা আর দীর্ঘ না করি। উপরের লেখা বা কানাডায় পড়াশোনা বা অভিবাসন বিষয়ে কোনও বিশেষ প্রশ্ন থাকলে আমাকে নিচের ইমেইল ঠিকানায় জানাতে পারেন। পরের কোনও লেখায় আপনার আগ্রহের প্রতিফলন ঘটানোর প্রয়াস থাকবে। তবে বর্তমান পর্বসহ কানাডার ইমিগ্রেশন বিষয়ে এ সিরিজের অন্য পর্বগুলোতে যে সাধারণ আলোচনা করা হয়েছে তা যেন কোনভাবেই আইনি পরামর্শ হিসেবে বিবেচনা করা না হয়। কেননা সুনির্দিষ্ট আইনি পরামর্শ দেওয়া হয় ব্যক্তিগত সাক্ষাতে, পত্রিকার সাধারণ আলোচনায় নয়।

এছাড়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে নিয়মিত চোখ রাখুন কানাডা ইমিগ্রেশন নিয়ে আমার নতুন নতুন লেখা পড়তে। ভবিষ্যতে আপনাদের সঙ্গে আরো অনেক মূল্যবান তথ্য সহভাগের প্রত্যাশা নিয়ে আজ এখানেই শেষ করি। 

লেখক: কানাডীয় ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট, আরসিআইসি। পরিচালক, এমএলজি কানাডা ইমিগ্রেশন সার্ভিসেস।

ইমেইল: info@mlgimmigration.com / ফেইসবুক: ML Gani