বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ নেতা বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, “নির্বাচন হতে দেবে না, এই কথা বলে অবরোধের নামে কত কিছু করছে। কিন্তু এক সময় গতবারের মত অবরোধ প্রত্যাহার না করেই ঘরে ফিরে যাবে।“
Published : 09 Nov 2023, 01:07 AM
তত্ত্বাবধায়ক সরকার চেয়ে বিএনপি ও সমমনাদের অবরোধ দিনের পর দিন বেড়ে চললেও এ দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই সরকারের। সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করার বিষয়ে অটল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করছেন, ওই অবরোধ ভেঙে পড়বে ২০১৫ সালের মতই।
তফসিলের আগে আগে নির্বাচন কমিশন আলোচনার জন্য যে ৪৪টি দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে যে ২৬টি দল সভায় এসেছিল, তারা ভোটে আসছে- এটা ধরে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এখন চেষ্টা চলছে আরও কিছু দলকে এই পথে আনা যায় কি না।
তফসিল ঘোষণার আগে আগে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সাক্ষাতের দিন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের বৈঠকে ডেকেছেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবারের এ বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে জানিয়েছেন নেতারা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, “দেশে সংবিধান অনুযায়ী সময়মতো সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। বিএনপি বা কেউ নির্বাচনে না এলে তাতে কিছু যায় আসে না।”
বিএনপির সাবেক নেতাদের দল তৃণমূল বিএনপি এর নির্বাচনে আসার ঘোষণা এবং একই দিন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজউদ্দিন আহমেদ যা বলেছেন, তাতে আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করছেন, বিএনপি ভোটে না এলেও দলটির অনেক নেতাই নিবন্ধিত দলে যোগ দিয়ে ভোটে চলে আসবেন।
তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার তো প্রকাশ্যেই বলেছেন, তার দল চমক দেখাবে। বিএনপির অনেক পর্যায়ের নেতারাই তাদের দলে আসবেন।
দলের চেয়ারপারসন শমসের মবিন চৌধুরী এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, তারা ভোটে যাচ্ছেন এবং ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার চেষ্টা থাকবে।
জাতীয় পার্টি নিয়েও নির্ভার হয়েছে আওয়ামী লীগ। তারা মনে করে, ২০১৪ সালে দলটি নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত থাকলেও এবার এ ক্ষেত্রে দলে কোনো মতবিরোধ নেই।
জাতীয় পার্টির নেতা ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য সৈয়দ আবুল হোসেন বাবলা এরই মধ্যে লাঙ্গল প্রতীকে ভোট চেয়ে জনসভা করেছেন।
দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের গত ৪ নভেম্বর এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, “আমরা নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গেই আছি। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা ঘোষণা দিয়ে চলে যাব, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে আছি, আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি।”
আওয়ামী লীগের আবদুর রাজ্জাক বলেন, “বিএনপি না এলেও নির্বাচন আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। দলীয়ভাবে না এলেও তাদের একাংশ নির্বাচনে আসতে পারে ও অন্যান্য দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। আন্তর্জাতিক বিশ্ব নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণ করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।”
বিএনপি না এলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে কি না- সেই প্রশ্নে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, “তখনেরটা তখন দেখা যাবে।”
একই প্রশ্নে ১৪ দলের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, “নির্বাচন হলে সেটা গ্রহণযোগ্য না হওয়ার কোন সুযোগ নেই। আর বিএনপিকে নির্বাচনে আসতে হবে এমন কোনো আইন তো নেই, তাহলে বিএনপি নির্বাচনে না এলে গ্রহণযোগ্য হবে না এটা কীভাবে বলে লোকজন।
“১৯৮৬ সালে, ১৯৮৮ সালে, ১৯৯৬ সালে এবং ২০১৪ সালে (বর্জনের মধ্যেও) নির্বাচন হয়েছে, আমরাও বহু নির্বাচন বর্জন করেছি।”
বিএনপিও ভোটে আসবে?
প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা ও ঢাকা-১ আসনের সংসদ সদস্য সালমান এফ রহমান বৃহস্পতিবার তার নির্বাচনী এলাকায় জনসভায় বলেছেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে কি আসবে না, এটা তাদের ব্যাপার। …অন্য আরও অনেক দল আছে যারা নির্বাচনে অংশ নেবে।“
তবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, “বিএনপি ভোটে আসবে না, এটা আমরা এখনও ধরছি না। তারা এবারের নির্বাচনে না এলে হারিয়ে যাবে। নিজেদের টিকিয়ে রাখতেই নির্বাচনে আসতে হবে।”
কিন্তু যদি না আসে? এই প্রশ্নে সেই নেতা বলেন, “তখন বিএনপিকে বাদ দিয়েই নির্বাচন হবে। তখন বিএনপি থেকে বেরিয়ে বহু নেতা নির্বাচনে অংশ নেবে। অনেক নেতা নির্বাচন করবেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে।”
তারা কারা? এ প্রশ্নে ওই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, “কয়েকদিন পরেই বুঝতে পারবেন কারা। বিএনপি না এলে বিপুল পরিমাণ জনগণের সম্পৃক্ততায় এবারের নির্বাচন অন্যান্য সময়ের থেকে বেশি গ্রহণযোগ্য হবে।”
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী বলেন, "নিবন্ধিত সব দল নির্বাচনে আসবে বলে আমরা মনে করি। আমরা বারবার তাদের নির্বাচনে এসে জনগণের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করার জন্য। কে নির্বাচনে আসবে কে আসবে না সেটা সময় বলে দেবে।"
কেন্দ্রে ভোটার আনার চ্যালেঞ্জ
আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে কেন্দ্রে ভোটারদের আসতে বিএনপির নেতা-কর্মীরা যেভাবে বাধা দিয়েছিলেন, এবার তাদের সেই সক্ষমতা নেই। এবার অবরোধে সহিংসতাও সেই সময়ের তুলনায় কম বলে মনে করছেন তারা। একে বিএনপির ‘শক্তি ক্ষয়’ হিসেবেই দেখতে চান তারা।
ক্ষমতাসীন দল এবার কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোতে জোর দেবে বলে জানিয়েছেন নেতারা। তারা বলছেন, বিএনপি না থাকলেও যে ভোটার আসে, এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচন তার প্রমাণ।
কোথাও ৫০ শতাংশ, কোথাও তার চেয়ে বেশি ভোট পড়েছে সিটি নির্বাচনে। এমনকি বরিশালে একটি কেন্দ্রে হাঙ্গামার পর সিলেট ও খুলনা সিটি নির্বাচন থেকে ইসলামী আন্দোলন সরে যাওয়ার পরও সিলেটে ভোট পড়েছে ৪৬ শতাংশ।
২০১৪ সালের মত কোনো আসন যেন প্রতিদ্বন্দ্বীহীন না হয়ে যায়, সেদিকেও নজর থাকবে ক্ষমতাসীন দলের। নেতারা মনে করছেন, চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো প্রার্থী থাকলেই ভোটারকে কেন্দ্রে আনা সহজ হবে।
আওয়ামী লীগের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিএনপি না এলেও নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে। জনগণ এই নির্বাচনে ভোট দিতে আসবে।
“কে নির্বাচনে এল, আর কেএল না, সেটা বিষয় নয়, নির্বাচনে জনগণের সম্পৃক্ততা থাকলেই হল। জনগণ ভোট দিতে এলে নির্বাচন অবশ্যই গ্রহণযোগ্য হবে।”
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, “রাজনৈতিক দলের দায়িত্বই হল নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট নেওয়া। আমরা তো আর শক্তি প্রয়োগ করে জোর করে কাউকে নির্বাচনে আনতে পারি না। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হোক, তা তারা চায় না, তাহলে তাদের উদ্দেশ্য কী। এটা আমরাও জানি দেশের জনগণও জানে।
“যদি নির্বাচন করে, তাহলে জনগণ ঠিক করবে। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা জনগণই ঠিক করবে।”
সুজিত রায় নন্দী বলেন, "গেল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বহু দলই নির্বাচনে আসে নাই, কিন্তু ভোটের হার ৬০ ভাগও হয়েছে। জনগণ ভোট দিতে আসবে, জনগণের সম্পৃক্ততা থাকলে ভোট অব্যশ্যই গ্রহণযোগ্য হবে।"
অবরোধ ভেঙে পড়বে?
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, ২০১৩ ও ২০১৫ সালে আন্দোলনে নেমে ব্যাপক সহিংসতার পরেও বিএনপির কর্মসূচি ভেঙে পড়ে। এবারও তাই হবে।
গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ ঘিরে সহিংসতার পরদিন হরতাল এবং এক দিন বিরতি দিয়ে টানা যে অবরোধ বিএনপি, জামায়াত ও সমমনারা ডেকে আসছে, তা ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে আসছে বলে মনে করেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপির ‘গণতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন করার শক্তি ও সামর্থ্য নেই’ বলেই তারা বরাবরের মত ‘অগ্নিসন্ত্রাসের পথ’ বেছে নিয়েছে।
উচ্চ আদালত অসাংবিধানিক ঘোষণা করার পর ২০১১ সালে নির্বাচিত সরকারের অধীনে ভোটের ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনে জাতীয় সংসদ। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চেয়ে আন্দোলনে যায় বিএনপি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি তা প্রতিহত করতে দেওয়া হয় নানা কর্মসূচি।
তবে ভোট ঠেকানো যায়নি। অবশ্য আগেই দেড়শর বেশি আসনে প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়ে যায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। অল্প কয়েকটি ছাড়া বাকি সব আসনে সহিংসতার মধ্য দিয়ে ভোট হয়।
এরপর ১২ জানুয়ারি শপথ নেয় নতুন সরকার। আর সেদিন থেকে অবরোধ কর্মসূচি স্থগিত করে বিএনপি।
দশম সংসদ নির্বাচনের এক বছর পূর্তিতে ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি দিনভর নাটকীয়তার পর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অবরোধের ডাক দেন। বেশ কয়েকদিন জোরাল কর্মসূচি চললেও এক পর্যায়ে তা শিথিল হয়ে আসে।
পরে অবরোধের পাশাপাশি আসে হরতালের ঘোষণা। পরে ভেঙে পড়ে সেই কর্মসূচিও, স্বাভাবিক হয়ে আসে জীবনযাত্রা। এক পর্যায়ে কর্মসূচি প্রত্যাহার না করেই ওই বছরের ২৯ এপ্রিলের ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি।
বিরোধী দলের বর্জনের মুখে এর আগেও দেশে দুইবার নির্বাচন হয়। এরশাদ শাসনামলে ১৯৮৮ সালে এবং খালেদা জিয়ার আমলে ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারির সেই ভোটের পর সরকার টিকতে পারেনি। তবে ২০১৪ সালের ভোটের পর আওয়ামী লীগের সরকার মেয়াদ পূরণ করে।
এরপর ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলে ওই নির্বাচনে প্রথমে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দেয় বিএনপি। পরে ২০ দলীয় জোটের পাশাপাশি নতুন জোট ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে তাতে অংশ নেয়। সে নির্বাচনে ভরাডুবির পর ‘আগের রাতে ভোট হয়ে যাওয়ার’ অভিযোগ আনে বিএনপি। ফিরে যায় তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে।
বিএনপির চলমান কর্মসূচি নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তারা যত হরতাল-অবরোধ দেবে জনগণের কাছ থেকে হারিয়ে যাবে, দিনে দিনে তারা হারিয়ে যাচ্ছে। তাদের এই আন্দোলনে দেশের মানুষের মধ্যে কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলেই অবরোধের মধ্যে গাড়ি চলছে, অফিস আদালত, দোকান পাট খোলা থাকেছে।”
তফসিলের পরবর্তী সময়ে এসব কর্মসূচিতে নির্বাচনে কোনো প্রভাব পড়বে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “নির্বাচন হওয়ার ক্ষেত্রে এটা কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না।”
ক্ষমতাসীন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, “নির্বাচন হতে দেবে না, এই কথা বলে অবরোধের নামে কত কিছু করছে। কিন্তু এক সময় গতবারের মতো অবরোধ প্রত্যাহার না করেই ঘরে ফিরে যাবে।
“খালেদা জিয়া অবরোধ দিয়েছিল, সেই অবরোধ (২০১৫ সালে) এখনও ওঠে নাই। একই ধারায় জনগণ এবারের অবরোধও ভুলে যাবে। জনগণই তাদের ভুলিয়ে দেবে।”