“দ্রব্যমূল্য যাতে নিয়ন্ত্রণ হয় তার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা আমরা গ্রহণ করব", সংসদের প্রথম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে বলেন তিনি।
Published : 05 Mar 2024, 10:53 PM
রমজান মাসে নিত্যপণ্যের দর বাড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতাকে অদ্ভুত আখ্যা দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলেছেন, তারা কৃষকের স্বার্থও দেখবেন, ক্রেতাদের স্বার্থও দেখবেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের সমাপনী ও রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় তিনি এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য যাতে সহনশীল থাকে।”
রোজায় মজুদ করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতাকে ‘অদ্ভুত’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, “সেগুলো লক্ষ্য রেখেই মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
"কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্যপণ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিচ্ছি। ৮টি বিভাগে ৮টি সংরক্ষণাগার করার ব্যবস্থা নিচ্ছি। কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্য পায় সেটা দেখা হবে। কৃষিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখব।"
রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা নিষেধাজ্ঞা ও কোভিড মহামারীর পর এই মূল্যস্ফীতি উন্নত দেশেও দেখা দিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের দেশে যাতে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেজন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছি।
“দ্রব্যমূল্য যাতে নিয়ন্ত্রণ হয় তার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা আমরা গ্রহণ করব।"
সব ওয়াদা পূরণ হবে
নির্বাচনের আগে জনগণকে দেওয়া সব প্রতিশ্রুতি পূরণ হওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, বাংলাদেশের অগ্রগতি থেমে থাকবে না।
গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখা ও দেশের মানুষের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “এ দেশের মানুষ সুফল পেয়েছে বলেই আমাদের ওপর বার বার আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছে। আমাদের বার বার নির্বাচিত করে তাদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছে।”
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, “জনগণের কাছে আমরা ওয়াদা দিয়েছি। আমাদের লক্ষ্য নির্বাচনি ইশতেহার বাস্তবায়ন করা। ৫ বছর মেয়াদি সরকারের সময় ওয়াদা বাস্তবায়ন করব। এটাই আমাদের একমাত্র প্রতিজ্ঞা।”
সংসদে কাজে সহযোগিতা করার জন্য সরকারি দল, বিরোধী দলীয় ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের ধন্যবাদও জানান প্রধানমন্ত্রী। টেবিল চাপড়ে অন্যরা এই বক্তব্যকে স্বাগত জানান।
স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের টেবিল চাপড়ানোর শব্দ বেশি জোরে হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর হাসির ছলে বলেন, “মনে হচ্ছে স্বতন্ত্রদের চোটপাট বেশি।”
গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকলে দেশের উন্নয়ন হয় মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “১৫ বছরে এটা প্রমাণ হয়েছে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারা আছে বলেই দেশটা এগিয়ে যাচ্ছে। আজকে আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি। আমাদের লক্ষ্য দেশকে উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলব। এ লক্ষ্য নিয়ে আওয়ামী লীগ কাজ করছে।”
স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে
মন্ত্রীদের দেওয়া নির্দেশনার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, "নতুন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে জনগণের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিদেশি ঋণ ও সহায়তা গ্রহণের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে। কেউ আমাদের এখানে এসে বলল, আমরা সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ব না। আমরা বিবেচনা করে নেব।
“সরকারি কেনাকাটায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।”
সামাজিক নিরাপত্তার উপকারভোগী নির্বাচনের ক্ষেত্রে যারা সত্যিকার প্রাপ্য, তাদের খুঁজে বের করা হবে বলেও ঘোষণা দেন তিনি।
সরকারের কর্মসূচির প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, "আমরা রপ্তানি বহুমুখী করব। প্রতিটি দূতাবাসকে নির্দেশ দিয়েছি। এখনকার কূটনীতি হবে অর্থনৈতিক কূটনীতি, শুধু রাজনৈতিক নয়।
“কোন দেশে আমরা কী রপ্তানি করতে পারি; নতুন নতুন পণ্য উৎপাদন ও নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করা আমাদের লক্ষ্য। কৃষিজাত পণ্যের শিল্প বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ দৃষ্টি দেব।”
তারা রাজবন্দি কীভাবে?
‘আগুন সন্ত্রাস’ এর ভিডিও এবং ছবি প্রকাশের পরও বিএনপি নেতারা কীভাবে গ্রেপ্তার নেতাকর্মীদের রাজবন্দি দাবি করেন, সেই প্রশ্নও রাখেন প্রধানমন্ত্রী।
মানুষ খুন আর অগ্নি সন্ত্রাসের ঘটনায় কোনো ছাড় দেওয়া হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, "বিএনপি-জামায়াত দিনের পর দিন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে, অগ্নি সন্ত্রাস করছে, পুড়িয়ে মানুষ মরছে। এ ধরনের অপরাধ যারা করে তাদের ক্ষমা করা যায় না। তাদের শাস্তি পেতেই হবে। হুকুমদাতা, অর্থপ্রদানকারী আর সরাসরি জড়িত কেউ রেহাই পাবে না।"
শেখ হাসিনা বলেন, "বিএনপির তরফ থেকে দেশে বিদেশে বার বার লেখা হচ্ছে, ‘তাদের এত লোক অ্যারেস্ট’, সব দেশে বিদেশে নালিশ করছে।
“বিএনপির সব নাকি রাজবন্দি। যারা এভাবে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ মারে তারা কি রাজবন্দি হয়? তারা তো সন্ত্রাসী, তারা জঙ্গিবাদী এবং তারা অপরাধী।
“রাজনৈতিক কারণে তো কেউ গ্রেপ্তার নেই। যারা গ্রেপ্তার আছে, তারা হয় হুকুমদাতা না হয় সরাসরি অগ্নি সন্ত্রাসে জড়িত অথবা অর্থপ্রদানকারী। এই হুকুমদাতা, অর্থপ্রদানকারী আর সরাসরি জড়িত কেউ রেহাই পাবে না।"
বিদেশে নালিশ করে কোনো ফায়দা হবে না বলেও জানিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, “বিদেশিরা কী বলল, সেটা দিয়ে চলবে না। সব দেশের নির্বাচন আমাদের দেখা আছে। এই বারের মত সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন দেশে আর হয়নি।"
সংসদ সদস্যদের উদ্দেশ করে সংসদ নেতা বলেন, "নিজ নিজ এলাকায় যারা এ ধরনের অপরাধ করেছে, যেসব মামলা চলছে, সেই মামলাগুলো যেন যথাযথভাবে চলে। সাক্ষীসাবুদ যেন হয়। শাস্তি যেন তারা পায়।"
‘বিএনপির কর্মীদের কি আক্কেল নেই?’
তারেক রহমানের প্রতি ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, " লন্ডন থেকে হুকুম আসে, তারা এখানে আগুন দেয়। মানুষ খুন করে। আবার তার ছবিও পাঠাতে হয়।
“কী চমৎকার কথা! ভিডিও কনফারেন্সে হুকুম আসে। তারা তামিল করে। আগুন দিয়ে মানুষ মেরে, পুলিশ মেরে সেই ছবি পাঠায়। তাহলে আর তো সাক্ষীসাবুদ কী দরকার? তারা নিজেরাই আলমত রেখে দিচ্ছে।”
হাজার মাইল দূরে বসে দেওয়া হুকুম তামিল করে নিজেদের ‘বিপদে ফেলে দিচ্ছে’ মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, “এটা কি বিএনপির নেতাকর্মীরা বুঝে না? তাদের কি আক্কেলটা নেই।
"আরেকজন বলছে ছবি গোপনে দাও। ছবি না দিলে নাকি তাদের ক্রেডিট থাকে না নেতার কাছে। এ কেমন নেতা? দূরে নিজে নিরাপদে থেকে হুকুম চালায়। আর এরা জানি না কী ধরনের কর্মী। এই মানুষ খুন করে। সাধারণ মানুষকে বলব এই সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধ করতে হবে।"
গাজায় ইসরাইলের হামলার মতই বিএনপি বাংলাদেশেও হাসপাতাল, পুলিশ, ও সাধারণ মানুষের উপর হামলা করেছে বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, “বিএনপি বাংলাদেশের জন্য আজরাইল হয়ে এসেছে। তারা নির্বাচন করবে না, কারণ তারা জানে ভোট পাবে না, সমর্থন পাবে না। জনগণের উপর আস্থা নেই।"
অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ নির্বাচন
বিএনপির বর্জনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, "একটি রাজনীতি দলসহ তাদের জোট অংশগ্রহণ করেনি। তবে ২৮টি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। আমরা মনোনয়ন দেওয়া স্বত্বেও প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দিয়েছিলাম।
“এক হাজার ৯৭০ জন প্রার্থী ছিল, স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিল ৪৩৬ জন। এই নির্বাচন অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে, মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছে। নারী ও তরুণ ভোটারদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য।"
৭৫ পরবর্তী নির্বাচনের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, " সেই হ্যাঁ-না ভোট। নির্বাচন কমিশনে তালা দিয়ে ভোটের রেজাল্ট দেয়। তিন/চারদিন পর রেজাল্ট।”
নির্বাচনের সমালোচনা করে বিরোধীদলীয় নেতা জি এম কাদের এদিন বক্তব্য রাখেন। তার জবাবে তিনি বলেন, “তিনি কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদ নির্বাচনের ফলাফল দেখাননি।
“দ্বিতীয় নির্বাচন কীভাবে করেছিল? তৃতীয় নির্বাচনে বিরোধীদলীয় নেতার ভাই (হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ), আরেক সামরিক স্বৈরশাসক ক্ষমতায়। এক সামরিক স্বৈরশাসক (জিয়াউর রহমান) ভোট চুরির রাস্তা দেখিয়ে গেল, ক্ষমতার দখলটা দেখিয়ে গেল, তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে আরেকজন।
“দুজনেরই একই খেলা। সেনাপ্রধান হলেন। একদিন ক্ষমতা দখল করে রাষ্ট্র প্রধান হয়ে গেলেন।
একই সঙ্গে দুই রূপ। রাষ্ট্রপতির পদ নিয়ে ভোট চুরি।
“খুশি হতাম বিরোধীদলীয় নেতা যদি তার ভাইয়ের ১৯৮৮ এর নির্বাচনটা দেখাতেন। সেই নির্বাচনটা ছিল শুভংকরের ফাঁকি।”
এরশাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে খালেদা জিয়া ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন করেন মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, “তিনি দেখিয়েছেন ২১ শতাংশ ভোট। ২১ শতাংশ কীভাবে হল? সেদিন তো কোনো ভোটার ভোট কেন্দ্রে যেতে পারেনি।
“হোন্ডা-গুন্ডা দিয়ে নির্বাচন ঠান্ডা, এরশাদের নির্বাচন টেকেনি, খালেদা জিয়ার নির্বাচনও টেকেনি। জনগণের রুদ্ররোষে ভোট চুরির অপরাধে বিদায় নিতে হয়েছিল।"