এই রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, সরকারও এবার ‘খুব সতর্ক’ থাকবে; কারণ শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, পুরো বিশ্ববাসী এ নির্বাচনের দিকে লক্ষ্য রাখছে।
Published : 15 Oct 2023, 09:52 PM
নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার একসময় কিছু ইতিবাচক ফল আনলেও সর্বশেষ এক-এগারো সরকারের অভিজ্ঞতার কারণে এমন অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাপনার দিকে যাওয়ার আর কোনো কারণ দেখেন না সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোজাম্মেল হোসেন।
বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তিনটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেছেন, “আমরা বলতে পারি তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনো সমাধান নয়, এমনকি আদর্শ সমাধান বা স্থায়ী সমাধানও নয়। এটা সবসময় প্রত্যাশিত ফলাফল দিতে পেরেছে এমনও নয়।
“সুতরাং আমাদেরকে স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক চর্চায় অবিচল থাকতে হবে, যেটা পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোতে অনুসরণ করা হয় এবং এশিয়ার অনেক দেশেও।”
দৈনিক সমকালসহ একাধিক জাতীয় দৈনিকে বিভিন্ন সময় সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা মোজাম্মেল হোসেন একজন কলানিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবেও পরিচিত। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠান ইনসাইড আউটে তিনি খোলামেলা কথা বলেছেন দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নির্বাচন সামনে রেখে পরিস্থিতির গতি প্রকৃতি নিয়ে।
রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফেইসবুক পেইজ (https://www.facebook.com/bdnews24/) ও ইউটিউব চ্যানেলে (https://www.youtube.com/@bdnews24) সম্প্রচার করা হয় অনুষ্ঠানটি।
মোজাম্মেল হোসেন বলেন, বিরোধী দল সরকারের পদত্যাগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করলেও এখন পর্যন্ত তারা ‘শান্তিপূর্ণ’ উপায়ের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর সরকারও ‘খুব সতর্ক’ থাকবে; কারণ শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, পুরো বিশ্ববাসী এ নির্বাচনের দিকে লক্ষ্য রাখছে।
মূল কথা ‘আস্থা’
একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়টি প্রথম এসেছিল ১৯৯১ সালে, তবে তা সংবিধানে যুক্ত হয় পাঁচ বছর পর।
আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের মুখে সংবিধানে সংশোধন করে ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে তৎকালীন বিএনপি সরকার। সর্বশেষ অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতি ওই নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হবেন– এমন বিধান করা হয় সেখানে।
ওই বছর বিচাপতি সাহাবউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ওই সরকারের মেয়াদ শেষে অনুষ্ঠিত ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ী হয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট।
২০০৬ সালে এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়েই রাজপথে বিক্ষোভ ও সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হয়। ওই সময় বিরোধীরা অভিযোগ করে, ‘পছন্দের লোক’ বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার জন্য বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে দিয়েছে বিএনপি সরকার।
বিক্ষোভ-সহিংসতার মধ্যে বিচারপতি কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকার হতে অপারগতা প্রকাশ করলে বিএনপি সরকারের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের দায়িত্ব নেন। এরপর আওয়ামী লীগসহ বিরোধীদের আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়।
অস্থির ওই সময়ে সেনা হস্তক্ষেপে ভেঙে দেওয়া হয় ইয়াজউদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দিন আহমদকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠন করা হয় নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দেশে জারি হয় জরুরি অবস্থা।
৯০ দিনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব পালনের কথা থাকলেও জরুরি অবস্থার মধ্যে ওই সরকার প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় ছিল। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ বহু রাজনীতিককে সে সময় দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে কারাগারে যেতে হয়।
নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন হয়, তাতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট।
সেই নির্বাচনের প্রসঙ্গ ধরে মোজাম্মেল হোসেন বলেন, “আমরা তিনটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পেয়েছি। তুলনামূলকভাবে সেগুলো ছিল শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য এবং ওই নির্বাচনের কোনোটিতে ক্ষমতাসীন দল আবার আসতে পারেনি বা বিজয়ী হতে পারেনি- এগুলো ছিল বিশেষত্ব।
“কিন্তু বিষয় হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গণতন্ত্রের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বা নির্বাচনের গণতান্ত্রিক চর্চার আদর্শ সমাধান হিসেবে প্রমাণিত হয়নি।”
প্রথম নির্বাচনে বিএনপির পক্ষ থেকে ‘সুক্ষ্ম কারচুপির’ অভিযোগ, ২০০৬ সালে এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে ‘নিজেদের মত’ করে প্রভাবিত করার উদাহরণ টেনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার না চাওয়ার পক্ষে নিজের যুক্তি তুলে ধরেন এই বিশ্লেষক।
২০০৬ সালে মেয়াদের শেষে খালেদা জিয়ার সরকার যে ব্যক্তি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন, তার দিকে লক্ষ্য রেখে কিছু কৌশল হাতে নিয়েছিল।
“একজন নির্দিষ্ট বিচারপতির চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়া হয়, যিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরবর্তী প্রধান উপদেষ্টা হবেন। এটা ছিল প্রক্রিয়াটিকে নিজের মত করে পাল্টে দেওয়া। আওয়ামী লীগ এর প্রবল বিরোধিতা করে এবং তারা বেশ বড় আন্দোলন গড়ে তোলে। ফলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। দুবছরের জন্য সেখানে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল। এরপর ২০০৮ সালে নির্বাচন হয়।”
আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন ‘বিশ্বাসযোগ্য না হওয়ার’ প্রেক্ষাপটও আলোচনায় তুলে ধরেন মোজাম্মেল হোসেন।
২০১৪ সালে বর্জনের পর বিএনপি ২০১৮ সালের নির্বাচনে এলেও তাদের প্রচার বাধাগ্রস্ত হওয়া এবং ব্যালটে অবৈধভাবে সিল মারার প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, “এটা মনে করা হয় যে, এমনভাবে কারচুপি করা হয়েছে, রাতের বেলায়ও ব্যালটে সিল মারা হয়েছে।
“যদিও সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করছে, তবুও জাতীয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এক্ষেত্রে ঐকমত্য আছে যে, এতে বৈধতার অভাব রয়েছে। সুতরাং, এ বছর এমন কিছু ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে, যাতে সরকার ও নির্বাচনের কমিশনের উপর অংশগ্রহণকারী সবার আস্থা থাকে।”
‘সংলাপেই সমাধান’
রাজনৈতিক দলগুলোর বিপরীতমুখী অবস্থানের মধ্যে সংলাপের পরামর্শ দিয়ে মোজাম্মেল হোসেন বলেন, “সংলাপে বসার মাধ্যমে সমাধান বের করার উপর সবকিছু নির্ভর করছে। রাজনৈতিক নেতাদের দায়িত্ব সমাধান বের করা, বিরোধ তৈরি করা নয়। নির্বাচনের আস্থা তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে এবং সেটাই নিশ্চিত করবে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন।”
তার মতে, তত্ত্বাধায়ক সরকার একটি পরীক্ষা নিরীক্ষার বিষয়। কিন্তু নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ‘নিখাদ’ করতে হবে চর্চার মধ্য দিয়ে।
সংবিধান মেনে চলা এবং যুক্তরাজ্যের ওয়েস্টমিনস্টার ধরনের গণতন্ত্র চর্চার যে কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন, সে বিষয়েও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন মোজাম্মেল হোসেন।
তিনি বলেন, “তিনি (প্রধানমন্ত্রী) এটা খুব ভালো কথা বলেছেন। কিন্তু ওয়েস্টমিনস্টার হচ্ছে সংসদীয় সরকার পরিচালনার সম্পূর্ণ ব্যবস্থা… নির্বাচন, সংসদীয় সরকার, সংসদীয় কমিটির কার্যক্রম, জবাবদিহিতা- ওয়েস্টমিনস্টার ধরনের গণতন্ত্রে এর সবকিছু পরিচালনার কথা বোঝানো হয়।”
মোজাম্মেল হোসেন বলেন, “যুক্তরাজ্যে রাজা বা রানী সরকারপ্রধানকে বলেন, তুমি পদত্যাগ কর এবং নির্বাচনের সময় আদতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দ্বারাই পরিচালিত হয়।
“সুতরাং, যখন আমাদের সরকার প্রধান বলেন, আমরা ওয়েস্টমিনস্টার ধরন মেনে চলব, তাদেরকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে তারা নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ সরকার প্রশাসন হিসাবে কাজ করবে; তারা অন্য প্রার্থীদের আতঙ্কিত করার জন্য পুলিশ ও প্রশাসন এবং দলীয় কর্মীদের ব্যবহার করবে না।”
সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে এমন ‘বোঝাপড়ার’ ওপরই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নির্ভর করছে বলে মন্তব্য করেন এই বিশ্লেষক।
‘যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কী প্রভাব’
বাংলাদেশের নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের আগ্রহের বিষয়ে এক প্রশ্নে মোজাম্মেল হোসেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ‘চাপ দেওয়ার চেষ্টা করছে’।
“প্রশ্ন হচ্ছে, এতে ফল আসবে কি আসবে না। এটা আমাদের নির্বাচনকে কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে।”
র্যাব এবং এর সাবেক-বর্তমান সাত কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের সংখ্যা ‘ব্যাপকমাত্রায়’ কমে আসার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “সুতরাং আমাদের জনগণ স্বীকার করে যে, যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কিছু ফলাফল পাওয়া গেছে। কিন্তু নির্বাচনের ব্যাপারে কী হবে?
“বাস্তবিক অর্থে, ভিসা বিধিনিষেধ আমাদের নির্বাচনে বড় রকমের প্রভাব ফেলবে না। তবে, এটা আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করবে কিছুটা, সেটা আসলে নৈতিক প্রভাব। কিছু ক্ষেত্রে মানুষ কিছুটা সংযত হবে।”
পরাশক্তিদের খেলা
একদিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের অবস্থান এবং তার বিপরীতে চীন-রাশিয়ার বক্তব্যের বিষয়ে এক প্রশ্নে মোজাম্মেল হোসেন বলেন, “গণতন্ত্রে অগ্রাধিকার চীন ও রাশিয়ার নেই। কেননা নিজেদের দেশে তারা গণতন্ত্র নিয়ে অতোটা সিরিয়াস না। এটা ভিন্ন রকম।”
তিনি বলেন, “‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’, এমন প্রতিপাদ্যের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে সরকার সাবলীলভাবে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি মেনে চলছে। এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রক্ষা করে চলছে।
“কিন্তু এই অঞ্চলে অন্যান্য পরিবর্তনের কারণে এবার বাংলাদেশের উপর বাড়তি দৃষ্টি আছে। এখানে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ হচ্ছে চীনের প্রভাব যাতে বেড়ে না যায়। সুতরাং এমন জটিল বিশ্ব ও আঞ্চলিক পরিস্থিতিতে আমাদেরকে আমাদের নীতি ও সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে খুব সতর্ক থাকতে হবে।”