“ভালো কাজ করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে তসবি জপে জপে আমি ঘুমাতে চাই,” বলছেন যুবলীগ সম্পাদক নিখিল।
Published : 24 Dec 2023, 10:30 PM
পৌষের দুপুর শেষে জানা গেল তিনি আসছেন না; অপেক্ষার সময়টা নেহায়েত কম ছিল না। রোববার দুপুর আড়াইটার দিকে জানা গেল, ঢাকা-১৪ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাইনুল হোসেন খান নিখিল বিকালের আগে বের হচ্ছেন না।
ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী দুপুর ১২টায় চিড়িয়াখানার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে মত বিনিময়ের মধ্য দিয়ে গণসংযোগ শুরু করার কথা ছিল নিখিলের। নেতা আসবেন বলে চিড়িয়াখানা গেইটে কর্মীরা অপেক্ষায় ছিলেন। ছিলেন দু-চারজন সাংবাদিকও।
শেষ পর্যন্ত প্রায় দেড় ঘণ্টা পর গেইটম্যানের সহায়তায় চিড়িয়াখানার কর্মকর্তা আব্দুল জলিলের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশের সুযোগ মেলে। সেখানে আরও ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পরও দেখা মিলল না প্রার্থীর।
বেলা আড়াইটার দিকে রাসেল নামের একজন নৌকার কর্মী বললেন, “আজকে প্রার্থী আর আসবেন না।”
তবে বিকাল পৌনে ৫টার দিকে নিখিলকে পাওয়া গেল চিড়িয়াখানা থেকে কিছুটা দূরের মিরপুর-১ এলাকার শাহ আলী মার্কেটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায়।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা হলেও সেখানে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীরা নানা স্লোগান দিয়ে প্রার্থীকে বরণ করে নেন।
এর মধ্যে ভোটারদের কেউ কেউ বললেন, প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্যের মনোনয়ন পাওয়া যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নিখিলের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় প্রচারণায় তার গাছাড়া ভাব দেখা যাচ্ছে।
তবে তার প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগেরই নেতা সাবিনা আক্তার তুহিন, যিনি দলের স্বতন্ত্র হওয়ার সুযোগে এবার নির্বাচনে লড়ছেন নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে।
ঢাকা উত্তর আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক তুহিন দশম সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য ছিলেন। স্বতন্ত্র এ প্রার্থী প্রচার-প্রচরাণায় বেশ সরব। মিরপুরের বড় অংশ নিয়ে গঠিত ঢাকার এ আসনে ট্রাক প্রতীকের ক্যাম্পও চোখে পড়বে।
নিখিল ‘আউটসাইডার’, বলছে প্রতিপক্ষ
চাঁদপুরের সন্তান ৫৯ বছর বয়সী নিখিলের ঢাকায় বাস ৪৩ বছর, যার মধ্যে ৪০ বছরই তিনি মিরপুরে কাটিয়েছেন বলে ভাষ্য তার ব্যক্তিগত সহকারী যুবনেতা কামাল হোসেনের।
তিনি জানান, বাবার সরকারি চাকরির কারণে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে থাকতে হলেও ১৯৮০ সালের দিকে লালবাগ থানা ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন নিখিল। তখন তিনি বসবাস করতেন লালবাগ এলাকায়।
এরপর ১৯৮৪ সালের শুরুতে মিরপুর ১৩ নম্বর এলাকায় বাড়ি করেন নিখিলের বাবা প্রয়াত মো. মোফাজ্জল হোসেন খান। মোফাজ্জল ছিলেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা।
কামাল বলছেন, ছাত্রলীগ হয়ে নিখিল যুবলীগে যোগ দেন ১৯৮৭ সালে। তৃণমূল থেকে উঠে আসা এই রাজনীতিক ধাপে ধাপে উঠে এসেছেন আওয়ামী যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে।
তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবিনা আক্তার তুহিনের সমর্থকরা অবশ্য নিখিলকে মিরপুরে বহিরাগত বলে বর্ণনা করে আসছেন। ঢাকা উত্তর আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক তুহিন দশম সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য ছিলেন।
নিখিলকে বহিরাগত আখ্যায়িত করায় ক্ষোভ ঝেড়ে তার ব্যক্তিগত সহকারী কামাল হোসেন বলেন, “কত বছর বাস করলে মিরপুরের বাসিন্দা হওয়া যায়? নিখিল ভাই আছেন ৪০ বছর ধরে। ঢাকায় কয়টা লোক আছেন স্থানীয়? তুহিনরা কোত্থেকে এসেছেন?”
তুহিন মিরপুরের সন্তান বলে স্থানীয়রা তাদের আলাদা গুরুত্ব দেন বলে ভাষ্য তার ছোট বোন হালিমা আক্তার লাবণ্যের।
ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক এ সম্পাদকের দাবি, মিরপুরে যখন বসতি গড়ে উঠতে শুরু করে, তখন থেকেই তাদের পরিবার এখানে আছে।
“পাকিস্তান আমলে আমার নানা এখানে বাড়ি করেছেন। তারপর ১৯৭৩ সালে আমার বাবা শাহ আলী থানার ৬ নম্বর রোডে বাড়ি করেন। বাড়ি করার পর থেকে মা-বাবা এখানেই থাকেন। তুহিন আপার জন্ম এখানেই। আমার দাদার বাড়ি বিক্রমপুরে। তুহিন আপা জন্ম থেকেই এই অঞ্চলে বড় হয়েছে। সবাই তাকে মিরপুরের সন্তান বলে বিশেষ গুরুত্ব দেয়।"
মাদকমুক্ত করার ঘোষণা নিখিলের
শাহ আলী মার্কেট প্রাঙ্গণে শামিয়ানা টানিয়ে ব্যবসায়ীদের মতবিনিময় সভায় নিখিল বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নানা ষড়যন্ত্র ও ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই দেশের উন্নয়ন করছেন। রাস্তাঘাট, শিক্ষা ও শিল্পসহ সকল খাতে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু এই উন্নয়ন একমাত্র মাদকের বিস্তার দিয়েই নষ্ট করা যায়। যুব সমাজ মাদকাসক্ত হয়ে পড়লে সেই জাতি আর উন্নয়ন করতে পারে না।
“আমি নির্বাচিত হলে মিরপুরকে আমি মাদকমুক্ত করতে চাই। এখন অনেক মাদক ব্যবসায়ী ছোট ছোট শিশুদের মাসে এক হাজার টাকা দিয়ে মাদক বিক্রির জন্য ব্যবহার করছে। এতে এসব শিশুসহ যুব সমাজের একটা অংশ মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। আমি যদি নির্বাচিত হতে পারি, তাহলে এই মিরপুরকে মাদকমুক্ত করবই।”
শাহ আলী মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজী আকবর হোসেনের সভাপতিত্বে ওই সভায় আওয়ামী লীগের এই প্রার্থী বলেন, “এই মিরপুরের এমপি হয়ে এর আগে অনেকে জমি, বাড়িঘর দখল করেছেন। সেই লোভ আমার নাই। আমি চাই, আমার সময়ে ব্যবসায়ী সমাজ কোনও রকম চাঁদাবাজি ছাড়া ব্যবসা করতে পারবেন।
“কোনও সন্ত্রাসীর কাছে আমি মাথা নত করব না।”
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মিরপুরের এই হেভিওয়েট প্রার্থী বলেন, “আমি শান্তিতে ঘুমাতে চাই। সন্ত্রাস করে অন্যের সম্পদ দখল করে বা অসৎ কাজ করে শান্তিতে ঘুমানো যায় না।
“তাই ভাল কাজ করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে তসবি জপে জপে আমি ঘুমাতে চাই।“
‘শক্তিশালী’ প্রার্থী তুহিন
ঢাকা-১৪ আসনের রূপনগর, চিড়িয়াখানা ও মিরপুর-১ নম্বরের বেশ কিছু এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নৌকার প্রার্থীর বিপরীতে ট্রাক প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী তুহিন প্রচার-প্রচরাণা বেশ জমিয়ে তুলেছেন। যেখানে নৌকার প্রচারণা ক্যাম্প, সেখানেই দেখা যাচ্ছে ট্রাকের ক্যাম্পও।
তুহিন জানালেন, রোববার সকালে চ্যানেল আইয়ের টকশোতে অংশ নিয়ে দুপুর ১২টা থেকে শুরু করে দিয়েছেন প্রচারণা।
দুপুর আড়াইটার দিকেও মিরপুর-১ নম্বরের পাশে ৮ নম্বর ওয়ার্ডে ব্যস্ত জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি অনেক দিন ধরেই এই এলাকায় বসবাস করছি। এর আগেও আমি এই এলাকার এমপি (সংরক্ষিত মহিলা আসনে) ছিলাম। এলাকার প্রায় সকল মানুষ আমাকে চেনেন।
“সুতরাং জেতার বিষয়ে আমি খুবই আশাবাদী।”
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরশেনর ৭, ৮, ৯, ১০, ১১ ও ১২ নম্বর ওয়ার্ড এবং সাভার উপজেলার কাউন্দিয়া ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ আসনের স্থানীয় লোকজন নৌকার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভাবছেন সাবিনা আক্তার তুহিনকেই।
চিড়িয়াখানা রোডের চা দোকানি গোলাম রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিখিল সাহেবরে আমরা অনেক বড় নেতা হিসেবে শুনছি। কিন্তু কোনো দিন দেহি নাই। তবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে উনি জিতবেন, এটাই আমরা মনে করি।
“তবে এই এলাকায় কিন্তু তুহিন আপা (সাবিনা আক্তার তুহিন) অনেক পরিচিত। উনিও শক্ত ক্যান্ডিডেট মনে হয়।”
আরও যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়
ঢাকা-১৪ আসনে আরও যারা নির্বাচন করছেন, তাদের মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী মহিবুল্লাহ ভোট করছেন দালান প্রতীকে। শাহজাদা সৈয়দ সাইফুদ্দিন আহমদের প্রতীক একতারা। স্বতন্ত্র প্রার্থী লুৎফুর রহমানের প্রতীক কেটলি।
বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের (বিএনএফ) এ ওয়াই কামরুল ইসলাম ভোটের লড়াইয়ে আছেন টেলিভিশন প্রতীক নিয়ে। স্বতন্ত্র প্রার্থী জেড আই রাসেলের প্রতীক ঈগল। আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী এমরুল কায়েস খান লড়ছেন রকেট প্রতীকে। বাংলাদেশ সাংসস্কৃতিক মুক্তিজোটের আসিফ হোসেন দলীয় প্রতীক ছড়ি নিয়ে মিরপুরে লড়ছেন।
এই তৃণমূল বিএনপির সোনালী আঁশ প্রতীকে লড়ছেন নাজমুল ইসলাম; আর ন্যাশনাল পিপিলস পার্টির আম প্রতীকে আছেন মাহবুব মোড়ল।
তাদের কারো কারো পোস্টার চোখে পড়লেও প্রচারে তেমন গতি নেই বলেই জানালেন স্থানীয়রা।
ভোটারদের কী ভাবনা
বিএনপির বর্জনের এ নির্বাচনে কে জয়ের মুখ দেখবেন তা নিয়ে তেমন মাথাব্যথা দেখা গেল না ঢাকা-১৪ আসনের ভোটারদের।
গোলাম রহমান নামের একজন বললেন, “আমরা সবাই শান্তি চাই। নির্বাচনে কে আইলো, কে গেল এইটা তাদের ব্যাপার। আমরা অশান্তি চাই না। দেশে অশান্তি হইলে আমরা যারা ছোটমুটো ব্যবসা কইরা খাই, তারাই সবচেয়ে ক্ষতির মইধ্যে পরি।”
চিড়িয়াখানার পাশের রাইনখোলা এলাকার বাসিন্দা মানিক মিয়া বলছিলেন, বিএনপি না আসায় ভোটের মাঠ এবার সেভাবে ‘গরম’ হয়নি।
ঢাকার অর্ধেক আসনে ‘চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন’ স্বতন্ত্র প্রার্থীরা
“এখন দিন রাত ২৪ ঘণ্টাই ভোটের আমেজে আছি, খুবই মজায় আছি। কিন্তু বিএনপি না থাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতার অভাব দেখছি।”
বিএনপি যাতে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে আসে, তার আহ্বান জানিয়ে মানিক বলেন, “দিনশেষে আমরা দেশে শান্তির রাজনীতি চাই।”
চিড়িয়াখানা গেইট এলাকার সিগারেট ব্যবসায়ী আমিনুর রহমান নিজেকে ‘নৌকা পাগল’ বলে আখ্যা দেন। গোপালগঞ্জের এই ভোটার ‘মিস’ করছেন ধানের শীষের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের।
“আমার জীবনে আমি নির্বাচনের এক মাস শুধু নির্বাচন ছাড়া কিছুই করি না। কিন্তু এবার বিএনপি নির্বাচনে না আসায় নির্বাচনের মাঠ আমায় টানতে পারছে না।”
আমিনুর বললেন, “বিএনপি নির্বাচনে আসলে আমি নৌকাকে জিতাইতে বাড়ি চলে যেতাম। কারণ আমি নৌকা পাগল।”