কুমিল্লায় ভোটের আগে ‘আওয়ামী পরিবারে’ দুই পক্ষে পাল্টাপাল্টি

আওয়ামী লীগ কাউকে প্রতীক না দিলেও দলের দুই নেতার পক্ষে বিভক্ত নেতাকর্মীরা।

মাসুম বিল্লাহআব্দুর রহমান, কুমিল্লা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 March 2024, 04:44 PM
Updated : 6 March 2024, 04:44 PM

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে উপ-নির্বাচনে ভোটের তিন দিন আগে আওয়ামী লীগ নেতা ও মেয়র পদে এক প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে তাকে ভোট না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন ক্ষমতাসীন দলেরই স্থানীয় আরেক নেতা।

সেই প্রার্থী আবার এই অভিযোগ তোলার পেছনে সদর আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারেরর দিকে আঙুল তুলেছেন। নাম উল্লেখ না করে বলেছেন, তিনি তার মেয়েকে জেতাতে ‘সব কিছু করছেন।’

২০২২ সালের ১৫ জুন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটে জয় পাওয়া আওয়ামী লীগের ইরফানুল হক রিফাতের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া মেয়র পদে ভোট হচ্ছে শনিবার।

প্রচারে জমজমাট নগরে বুধবার দুপুরে কুমিল্লা প্রেস ক্লাবে নির্বাচনের অন্যতম প্রার্থী নুর-উর রহমান মাহমুদ তানিমের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলনে আসেন কয়েকজন।

‘ভুক্তভোগীদের’ পক্ষে লিখিত বক্তব্যে আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা আনোয়ার হোসেন মিঠু বলেন, “বিভিন্ন সময় ছলচাতুরি করে আমাদের অনেক কর্মীর কাছ থেকে ধার করার নামে নামে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করেন।

“কখনও মুনসেফ বাড়িতে বাড়ি ক্রয় করবেন, কখনও ব্যবসার অংশীদারত্ব দেবেন অথবা ব্যক্তি গত প্রয়োজন দেখিয়ে অন্তত পক্ষে ৫০ জনের কাছ থেকে ১ কোটিরও বেশি টাকা গ্রহণ করেন যা আজ পর্যন্ত পরিশোধ করেননি।”

‘ডিডিএল’ নামের একটা প্রতিষ্ঠান খুলেও শতাধিক কর্মীর কাছ থেকে দুই লাখ টাকা করে নেওয়ার অভিযোগ আনা হয় সংবাদ সম্মেলনে। এই হিসাবে অবশ্য আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় দুই কোটি টাকা।

মিঠু বলেন, “অনেক কর্মী জমি বিক্রি করে, স্ত্রী এবং মায়ের গয়না বন্ধক দিয়ে তাকে লাখ লাখ টাকা প্রদান করে। আমরা বিভিন্ন সময়ে তার সাথে এবং তার মরহুম পিতার সাথে যোগাযোগ করে কোনো টাকা এবং গয়না উদ্ধার করতে পারিনি।”

মিঠু কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের ৫ নম্বর ওয়ার্ড কমিটির সদস্য। তিনি নগরীর মোগলটুলি এলাকার যুবক জাহিদ বাবু হত্যা মামলার আসামি। এবারের নির্বাচনে সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের মেয়ে তাহসীন বাহার সূচনার পক্ষে প্রচারে দেখা গেছে তাকে।

তানিম মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য। তাকে ভোট না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে এক সময় তার অনুসারী থাকার দাবিও করেন মিঠু।

তিনি বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ এবং মহানগর ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলাম। আমাদের রাজনীতির বিরাট একটা সময় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের সাবেক ভিপি নুর উর রহমান মাহমুদ তানিমের সাথে কাটিয়েছিলাম। এ রাজনীতির পথচলায় তাকে মা-বাবার পরে অন্ধের মত বিশ্বাস করতাম।”

এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কাউকে সমর্থন দেবে না জানিয়ে প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দেয়। আর ক্ষমতাসীন দল থেকে তানিম ছাড়াও প্রার্থী হয়েছেন সংসদ সদস্য বাহারের মেয়ে তাহসীন বাহার সূচনা। তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।

বিএনপি এই নির্বাচন বর্জন করলেও দলটির বহিষ্কৃত দুই নেতা প্রার্থী হয়েছেন নির্বাচনে। তারা হলেন সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু এবং মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি নিজাম উদ্দিন কায়সার, যারা ২০২২ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন।

অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতীক না থাকলেও এই নির্বাচন দল দুটির দুই অংশের মধ্যে চতুর্মুখী লড়াইয়ের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

সিটি করপোরেশন হওয়ার পর কুমিল্লায় বিএনপির সমর্থনে বা মার্কা নিয়ে সাক্কু জয় সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। তবে ২০২২ সালের নির্বাচনে বিএনপি আসেনি। সেই নিজামউদ্দিন কায়সার ‘বিএনপিপন্থিদের ভোটে’ ভাগ বসালে হেরে যান সাক্কু।

সেই নির্বাচনে নৌকা নিয়ে আরফানুল হক রিফাত ভোট পেয়েছেন ৫০ হাজার ৩১০টি। মনিরুল হক সাক্কু ধানের শীষ না পেয়ে টেবিল ঘড়ি মার্কায় পেয়েছিলেন ৪৯ হাজার ৯৬৭ ভোট। জয়-পরাজয়ের ব্যবধান ছিল ৩৪৩ ভোট।

সেভাবে আলোচনায় না থাকলেও নিজামউদ্দিন কায়সার ঘোড়া মার্কায় পান ২৯ হাজার ৯৯ ভোট। অর্থাৎ বিএনপিপন্থিদের ভোট ভাগাভাগির কারণেই মূলত জয় পায় আওয়ামী লীগ।

তানিমের জবাব

মিঠু সংবাদ সম্মেলন করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নিজ বাসায় নির্বাচনি ইশতেহার প্রকাশের জন্য পাল্টা সংবাদ সম্মেলনে আসেন তানিম।

তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, “এর বিন্দু বিসর্গর সত্যতাও নাই। একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে বসে, তার নির্দেশনা অনুযায়ী এগুলো সাজানো হয়েছে। আমি স্পষ্ট বলতে চাই, এই রকম কোনো প্রতিষ্ঠান, এই রকম কোনো সংগঠন, এই রকম কোনো ঘটনার সাথে আমার যোগাযোগ নেই।”

হাতি প্রতীকের এই প্রার্থী বলেন, “আমার অনেক নেতাকর্মী অনেক জায়গায় অনেক সমবায় সমিতি করে, অনেক প্রতিষ্ঠান করে, তারা অনেকে আমাকে না জানিয়েই সেগুলোতে উপদেষ্টা হিসাবে রাখে বা সম্মানিত পৃষ্ঠপোষক হিসাবে রাখে। এই রকম কোনো প্রতিষ্ঠানের কোথাও যদি কেউ কোনো কিছু করে থাকে, সেটা আমার জানার কথা নয়। আমি এসব বিষয়ে টোটালি বলব, এগুলো সম্পর্কে আমার আর কোনো বক্তব্য নেই।” 

সেই প্রভাবশালী ব্যক্তিটা কে- এই প্রশ্নে তানিম আঙুল তোলেন বাহারের দিকে। তিনি বলেন, “আমি উনাকে একজন এমপি বলব না, আমি বলব উনি একজন প্রার্থীর পিতা।

“পিতারা সন্তানের প্রতি একটু দুর্বল হয়, সন্তানের ব্যাপারে খুবই অন্ধ। আমি পিতা হিসাবে উনার যে তৎপরতা, এটাকে আমি সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখতে চাই। পিতা হিসাবে মেয়েকে জেতানোর জন্য সব কিছু করছেন।

“আর যদি সংসদ সদস্য হিসাবে বিবেচনা করি, তাহলে বলব এটা উনার চরম ব্যর্থতা। ১৫ বছর সংসদ সদস্য থাকার পরে কোনো মানুষের তো রাস্তায় নেমে ভোট চাওয়ার কথা না। উনি ঘরে বসেই উনার ম্যাকানিজম দিয়ে, উনাদের জনপ্রিয়তা দিয়ে মেয়েকে পাস করিয়ে আনতে পারতেন। সেই সাহসটুকু উনার নেই। তাই, আজকে প্রভাবশালী মহল বলতে আমি উনাকেই বুঝাচ্ছি।”

এমপি বাহারের কারণে কুমিল্লার মানুষের ঘুম হারাম হয়ে গেছে অভিযোগ করে এক সময় বাহারের অনুসারী হিসাবে পরিচিত এই নেতা বলেন, “আমি আশা করি, অচিরেই কুমিল্লার মানুষ উনাকে জবাব দিয়ে দেবে, ৯ তারিখের নির্বাচনে উনার প্রার্থীকে পরাজিত করার মাধ্যমে এবং জনগণের পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করার মাধ্যমে।”

তানিমের অভিযোগের বিষয়ে প্রতিক্রিয়ার জন্য বাহারকে ফোন করা হলেও তিনি তা ধরেননি; এরপর এসএমএস পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।