আগের মতই দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সমস্যা নিরসনের দায়িত্ব নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন সিইসি।
Published : 05 Nov 2023, 12:21 AM
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে নিবন্ধিত দলগুলোর সঙ্গে যে সংলাপের আয়োজন নির্বাচন কমিশন করল, তাতে আমন্ত্রিত ৪৪ দলের মধ্যে ২৬টির প্রতিনিধির দেখা পেলেন নির্বাচন কমিশনাররা।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ভোটের পরিবেশ ‘ভালো’ বলে দাবি করলেও অধিকাংশ দলের প্রতিনিধিরা বললেন উদ্বেগের কথা। ভোটের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার জন্য নির্বাচন কমিশনের যে দায়িত্ব, তাও মনে করিয়ে দিলেন দলগুলোর প্রতিনিধিদের কেউ কেউ।
শনিবার সকাল ও বিকালে দুই ভাগে ২২টি করে দলকে এই আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন।
সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপি আগেই জানিয়েছিল, তারা নির্বাচন কমিশনের সংলাপে যাবে না। তাদের ভাষায় সংলাপের নামে আসলে ‘নাটক’ করছে ইসি।
বিএনপির মত একই দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা দলগুলোও এদিন সংলাপে যোগ দেয়নি।
ভোট নিয়ে বিবাদমান রাজনৈতিক উত্তেজনা ইতোমধ্যে সহিংসতার রূপ পেয়েছে। মতভেদ নিরসনে সংলাপের তাগিদ এসেছে বিভিন্ন মহল থেকে; কূটনৈতিক মহলেও চলছে দৌড়ঝাঁপ।
কিন্তু প্রধান দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের অনড় অবস্থানের কারণে সমঝোতার কোনো ইংগিত এখনও মিলছে না। নির্বাচন কমিশনের সংলাপের পরও সংকট সমাধানের কোনো আশা দেখা যাচ্ছে না কোনো দিক থেকে।
দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার পর ব্রিফিংয়ে আসেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, “২৬টি দল আলোচনায় অংশ নিয়েছে। আলোচনা যথেষ্ট ইতিবাচক ছিল। পরিবেশ নিয়ে কেউ কেউ বলেছেন-নির্বাচনের পরিবেশটা অনুকূল নয়, কিছু কিছু দল এখনও অংশ নিতে পারছে না। আমরা সেটা স্বীকার করেছি।”
তবে আগের মতই দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সমস্যা নিরসনের দায়িত্ব নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি।
দলগুলো কী বলেছে?
শনিবার সকালে যে ২২টি দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, তাদের মধ্যে ১৩টি দল প্রতিনিধি পাঠিয়েছিল ইসিতে। তাদের সঙ্গে প্রায় আড়াই ঘণ্টা বৈঠক করেন নির্বাচন কমিশনাররা।
বিকালেও সমান সংখ্যক দলের প্রতিনিধিরা সংলাপে অংশ নেন। এবারও আড়াই ঘণ্টা ধরে আলোচনা চলে। সিইসির সভাপতিত্বে চার নির্বাচন কমিশনারসহ সংশ্লিস্টরা উপস্থিত ছিলেন আলোচনায়।
আলোচনা শেষে সকালে ও বিকালে দুই দফা সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন অংশগ্রহণকারী দলগুলোর প্রতিনিধিরা।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ফারুক খান বলেন, “আমরা মনে করি, বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ আছে। আগামীতে এটা আরও ভালো হবে।”
তার ভাষায়, “বিএনপিকে নিয়ে নির্বাচন করতে হবে, সংবিধানের কোথাও এ কথা লেখা নেই। পৃথিবীর কোনো আইনেও লেখা নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমরা দেখেছি, নির্বাচনের সময় অনেক রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে না। সুতারং সব রাজনৈতিক দলের সক্ষমতা নেই, যাদের জনসমর্থন নেই, জনগণের প্রতি যাদের আস্থা নেই; তারা তো নির্বাচনে আসবেই না।”
সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে কেউ ব্রিফ করেননি। তবে বৈঠকে উপস্থিত দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম ভুঁইয়া সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেন, “পোলিং, প্রিজাইডিং অফিসারসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা একটি পক্ষের হয়ে ভোটের দিন কাজ করলে আস্থাহীনতা তৈরি হয়। গাইবান্ধা-৫ আসনের উপ নির্বাচনে জড়িত ১৩৭ জনের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা জানতে চেয়েছিলাম আমরা। তবে কমিশন এ নিয়ে কোনো কিছু জানায়নি।”
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া ব্রিফিংয়ে বলেন, “যেহেতু একটা রাজনৈতিক অস্থিরতা আছে, সেই অস্থিরতা নিয়ে মানুষের মধ্যে কিছুটা শঙ্কা আছে। আমরা চাই, এই শঙ্কা থেকে দেশবাসী যেন মুক্তি পায়।”
তিনি বলেন, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে অংশগ্রহণমূলক হয়, অবাধ ও সুষ্ঠু হয় এবং এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণ যাতে তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, সে ব্যাপারে কমিশনকে অর্থবহ পদক্ষেপ নিতে হবে।
“নির্বাচন পেশী শক্তি ও সন্ত্রাসের দাপটমুক্ত ও সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন যেন না হয়, সে বিষয়ে নজর দিতে বলেছি আমরা।”
জাতীয় পার্টি (জেপি) মহাসচিব শেখ শহিদুল ইসলাম বলেন, “আমরা চাই আগামী নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারুক। আগামী নির্বাচন দেশের জন্য জাতির জন্য গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে সম্মিলিত করুক।
“আমরা এখানে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছি যে, গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক ধারা কীভাবে অব্যাহত রাখা যায়। সে ক্ষেত্রে আমাদের দেশের সকল রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করতে পারে।”
নাজমুল হুদার গড়া দল তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, নির্বাচনে জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য কমিশনকে ‘আরও কাজ করতে হবে’।
জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মোমিনুল আলম বলেন, “সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সিইসি রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর যেভাবে দায়িত্ব চাপিয়েছেন, তাতে ফেরেশতারা ছাড়া আওয়ামী লীগের ক্যাডার বাহিনী মোকাবেলা করে নির্বাচনে টিকে থাকা সম্ভব না। রাজনৈতিক ঐকমত্য সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত এবং নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থার দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তফসিল ঘোষণা স্থগিতের দাবি জানিয়েছি আমরা।”
ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের চেয়ারম্যান সৈয়দ বাহাদুর শাহ মোজাদ্দেদী বলেন, “বাংলাদেশের মানুষ ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মত প্রহসনের নির্বাচন আর দেখতে চায় না। আমরা চাই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন।”
বাংলাদেশ কংগ্রেসের সভাপতি অ্যাডভোকেট কাজী রেজাউল হোসেন বলেন, ভোটকেন্দ্র যাতে দলীয় প্রভাবমুক্ত হয় এবং নির্বাচনে প্রার্থী ও ভোটারদের নিরাপত্তা যাতে নিশ্চিত করা হয়, আলোচনায় তারা সেই তাগিদ দিয়েছেন।
বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) সভাপতি এস এম আবুল কালাম আজাদ বলেন, “ইসির অধীনে নির্বাচন হবে, সরকারের অধীনে নয়। নির্বাচনের পরিবেশ ঠিক করতে কমিশনকে বলা হয়েছে।”
সেনা বাহিনীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে এই নির্বাচন পরিচালনা করার প্রস্তাব দিয়েছে নতুন নিবন্ধিত দল ইনসানিয়াত বিপ্লব। দলটির মহাসচিব রায়হান রাহবার বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব তারা আলোচনায় তুলেছেন।
গত নির্বাচনের বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে ছিল গণফোরাম। দলটির সাধারণ সম্পাদক মো. মিজানুর রহমান বলেন, “বর্তমানে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো পরিবেশ দেশে নেই। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার জন্য ইসির ওপর আস্থা থাকলেও দলীয় ও সরকারের আজ্ঞাবহ প্রশাসনের কারণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে সংশয় আছে।”
নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে তাতে অংশ নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করার কথা বলেন গণফোরামের এই নেতা।
গণফ্রন্টের চেয়ারম্যান মো. জাকির হোসেন বলেন, “জাতীয় সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়, নির্বাচনকালীন রাজনৈতিক সরকার চাই। রাজনৈতিক সরকার হলে গণফ্রন্ট নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করবে।”
বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সভাপতি আইভি আহমেদ বলেন, “আগামী নির্বাচনের দিকে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি রয়েছে। কমিশন জানিয়েছে, নির্বাচনে পুরোপুরি অনুকূল পরিবেশ তেমন নেই। তবে সব সময় সম্পূর্ণ অনুকূল পরিবেশ নির্বাচন করব সেটাও না। ৯৯ ভাগ পরিবেশ অনুকূল হবে, সেটাও বলতে পারি না। অনুকূল পরিবেশ না থাকলেও তার মধ্য দিয়ে আমাদের নির্বাচন করে যেতে হবে।”
তরিকত ফেডারেশনের মুখপাত্র মোহাম্মদ আলী ফারুকী বলেন, সংবিধান যে ক্ষমতা দিয়েছে, নির্বাচন কমিশনকে তা প্রয়োগ করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে তার দল।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য মোশাররফ হোসেন বলেন, “যারা আলোচনায় আসেনি, নির্বাচন কমিশন উদ্যোগ নিয়ে তাদের আলোচনায় নিয়ে আসতে পারে। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে কমিশনকে এই উদ্যেগ নিতে হবে।”
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য ১ শতাংশ সমর্থকের স্বাক্ষরের যে বিধান, তা উঠিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে দলটি।
বিকল্পধারার মহাসচিব আব্দুল মান্নান বলেন, “আমরা চেয়েছি যেন সব দলের অংশগ্রণে নির্বাচন হয়। এখানে যদি কোনো দলের অংশগ্রহণ না হয়, তাহলে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে না। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পরিবেশ সৃষ্টি করা। খেলার মাঠে একদল খেললো, আরেক দল খেললো না, তাহলে খেলাতো হল না।”
তিনি বলেন, “এর আগে এগারোটা নির্বাচন হয়েছে। সব নির্বাচনে ছোটখাটো ভুল ছিল। আমাদের প্রস্তাব ছিল, আগামী নির্বাচনে যেন কোন ভুল ত্রুটি না হয়। সবাই যাতে অংশগ্রহণ করে। আইনের শাসন আমরা চাই। সবার যদি অংশগ্রহণ না হয়, সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে নির্বাচন সংসদ জনগণের বা দেশের কাজে আসবে না।”
সিইসি যা বললেন
দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শেষে বিকালে আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের সামনে আসেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল।
তিনি বলেন, “রাজনৈতিক যে সঙ্কটগুলো আছে, আমরা বলেছি, সেগুলো সম্পর্কে আমাদের প্রত্যাশা সব সময় ইতিবাচক। কিন্তু সেই সঙ্কট নিরসন করার সামর্থ্যটা আমাদের নেই বা আমাদের সে ম্যান্ডেটও নেই। আমরাও বলেছি, আপনারাও নিজেদের মধ্যে চেষ্টা করতে পারতেন।”
সংবিধান অনুযায়ী আগামী ২৮ জানুয়ারির মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে হাবিবুল আউয়ালের নির্বাচন কমিশনকে। সেই লক্ষ্যে নভেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধে তফসিল দেওয়ার কথা রয়েছে ইসির।
আরো পড়ুন
সংকট নিরসনের সামর্থ্য ইসির নেই: হাবিবুল আউয়াল
বিএনপিকে নিয়ে নির্বাচন করতে হবে, সংবিধানে কোথাও লেখা নেই: আওয়ামী লীগ
ভোটের প্রস্তুতি নিয়ে ইসির আলোচনা শুরু, প্রথম ধাপে নেই ৯ দল