রাজপথে ফিরে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান মির্জা ফখরুলের

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী কারাগারে থেকেও যেভাবে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, সেখান থেকে বিএনপি নেতাকর্মীদের অনুপ্রেরণা নিতে বলছেন দলের মহাসচিব।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 March 2024, 10:41 AM
Updated : 25 March 2024, 10:41 AM

দীর্ঘ ১৪৮ দিন পর রাজপথের কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ডাক দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

সোমবার দুপুরে ঢাকায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের জনগণ ‘কারো প্রভুত্ব’ স্বীকার করবে না।

“একটা চমৎকার গান আছে… ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারোর দানে পাওয়া নয়’। আমরা রক্তের দাম দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি। করো দয়ায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয় নাই। আজকে সেই বোধ নিয়ে রুখে দাঁড়ান।”

গত বছরের ২৮ অক্টোবর এই নয়াপল্টনের সামনে বিএনপির সমাবেশ ঘিরে সংঘর্ষের পর হরতালের ডাক দেন মির্জা ফখরুল। পরদিন সকালে গ্রেপ্তার করে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

ফখরুলের মত বিএনপির অধিকাংশ শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যান। বাকিরা যান আত্মগোপনে। এর মধ্যেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়, তাতে জিতে টানা চতুর্থবারের মত ক্ষমতায় যায় আওয়ামী লীগ।

সাড়ে তিন মাস কারাগারে থাকার পর গত ১৫ ফেব্রুয়ারি জামিনে মুক্তি পান মির্জা ফখরুল। এরপর চিকিৎসার জন্য তিনি সিঙ্গাপুরে যান। গত শনিবার দেশে ফিরে সোমবারই প্রথম কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগ দিলেন তিনি।

তরুণ সমাজকে জেগে ওঠার আহ্বান জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আমি বৃদ্ধ মানুষ হয়ে গেছি… হাফিজ (হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম) ভাই আমার চেয়েও বড়। আমরা এখনো লড়ছি, কথা বলছি, লড়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমরা এখনো বিশ্বাস করি, এই দেশকে পরাধীন করে রাখার ক্ষমতা কারো নেই। আমরা বিশ্বাস করি, এই ভয়াবহ ফ্যাসিবাদী একটা রেজিম, একটা শাসকগোষ্ঠী, যারা আজকে জোর করে, কলাকৌশল করে, বিভিন্ন নাটক করে ক্ষমতা দখল করে আছে তাদেরকে একদিন চলে যেতেই হবে।

“সেজন্য বলি, মানুষকে সঙ্গে নিয়ে নামতে হবে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে না নামলে আপনারা জয়ী হতে পারবেন না। সেই মানুষকে সঙ্গে নিয়ে কিছুক্ষণ আগে এখান দিয়ে রিকশা শ্রমিক ভাইয়েরা গেলেন না, এরকম শ্রমিক ভাইদেরকে নামাতে হবে। এই রকম সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ভাইদেরকে আনতে হবে। সমস্ত জায়গা থেকে মানুষ যেদিন উঠে আসবে, সেইদিন হবে সত্যিকার অর্থেই সফল গণঅভ্যুত্থান, সফল বিস্ফোরণ… বিজয়।”

ফখরুল বলেন, “আন্তর্জাতিক বিশ্ব নিশ্চয় সেই বিষয়গুলো দেখবে, দেখেছে অতীতে। আর কোনো দেশ যদি আমাদেরকে মনে করে যে, আমাদের ওপরে প্রভুত্ব করবে, বাংলাদেশের মানুষ কোনোদিন সেই প্রভুত্ব স্বীকার করে নাই। মোগল আমলেও করেনি, ব্রিটিশ আমলেও করেনি, পাকিস্তান আমলেও করেনি, এখনো করবে না।”

স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে বিএনপির স্বাধীনতা দিবস উদযাপন কমিটির উদ্যোগে এই মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ হয়। ‘ভারতীয় পণ্য বর্জন করুন’ এরকম কথা লেখাও ছিল সমাবেশের ব্যানারে।

নয়া পল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের ফুটপাতের একপাশে সড়কে এই সমাবেশ হয় ছোট পরিসরে। 

‘ব্যাংক একীভূত আরেকটা দুর্নীতির কৌশল’

দুর্দশায় পড়া পদ্মা ব্যাংককে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিএনপি মহাসচিব।

তিনি বলেন, “ব্যাংকগুলো লোপাট করে দিয়ে এখন ব্যাংক একীভূত হচ্ছে; ওটা আবার আরেকটা দুর্নীতির ব্যবস্থা তৈরি করছে।”

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে এ ব্যাপারে ছাত্রদলকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান ফখরুল।

তিনি বলেন, “এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকেরা ছাত্রীদেরকে শ্লীলতাহানি হয়েছে…. আপনারা কী করেছেন? উত্তর দিতে পারবেন না। একটা প্রতিবাদ পর্যন্ত করেন নাই। এই যে মেয়েরা বসে আছে আপনারা প্রতিবাদ করেন নাই।

“আমি কিছুক্ষণ আগে ফজলুর রহমান সাহেবের সাথে কথা বলছিলাম। কোথায় গেল সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়? কোথায় গেল ছাত্ররা, যারা স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছে, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন করেছে, ৬৯ এর আন্দোলন করেছে, ৯০ এর আন্দোলন করেছে, কোথায় গেছে তারা?

“আজকে ছাত্রদলের নেতারা এখানে যারা আছেন, এভাবে শুধু স্লোগান দিলে হবে না, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।”

একজন মুক্তিযোদ্ধাকে উদ্ধৃত করে ফখরুল বলেন, “ইনফেন্ট্রি যদি শক্তিশালী না হয়, তাহলে যুদ্ধ কে করবে? ইনফেন্ট্রিকে শক্তিশালী করতে হবে, যারা একটা পুলিশের হুইসেল শুনলে দৌড়াবে না, যারা একটা সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ শুনলে পালবে না, যারা রাস্তায় অনড় হয়ে প্রাণ দেবে, দাঁড়িয়ে থাকবে, এই ধরনের মানুষগুলো তৈরি করতে হবে, সেই সাহস বুকে তৈরি করে দাঁড়াতে হবে।”

মুক্তিযুদ্ধ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে নেতাকর্মীদের প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান ফখরুল।

তিনি বলেন, “আমি জানি, আমার বহু ছেলে সেইভাবে কষ্ট করছে, তারা কেউ বাড়িতে থাকতে পারে না, তাদের চাকরি-বাকরি নাই, টাকা-পয়সা নাই, তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নাই। তারা লড়াই করছে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য।

“এই গণতন্ত্র ফেরানোর বিষয়টি ছড়িয়ে দিতে হবে সারাদেশে তরুণ সমাজের মধ্যে, সেই সাহস ও বোধ তৈরি করতে হবে যে ‘আমি যা করছি তা আমার দেশের জন্য করছি, আমি যা করছি তা আমার গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য করছি, আমি যা করছি তা আমার দেশমাতৃকাকে রক্ষা করার জন্য করছি’।”

ইমরান খানের দিকে তাকান’

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী কারাগারে থেকেও যেভাবে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, সেখান থেকে বিএনপি নেতাকর্মীদের অনুপ্রেরণা নিতে বলছেন দলের মহাসচিব।

তিনি বলেন, “আমরা পাকিস্তান নাম বললে সবাই আঁতকে উঠি, অন্যভাবে চিন্তা করি। সেই ইমরান খান তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে তরুণদের মাঠে নিয়ে আসতে হয়। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে মহিলাদের মাঠে আনতে হয়।

“আমাদের চেয়ে কম অত্যাচার তাদের উপরে হয়নি; তারা সেনানিবাস আক্রমণ করেছিল, তারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তারা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। পাকিস্তানে এই অবস্থান নিয়ে কেউ কোনো দিন রাজনীতিতে টিকতে পারে নাই।”

ফখরুল বলেন, “ইমরান খান জেলে চলে গেছে, ৩৪ বছর সাজা হয়েছে, তার ২ হাজারের বেশি নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছে, জোর করে দলবদল করানো হয়েছে। তারপরেও জেলে বসে যখন তার দলের মার্কা নিয়ে গেছে। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নির্বাচনে যাও। সেই নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে কারা? এই তরুণেরা।”

আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ‘সবচেয়ে বড় হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করতে নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান বিএনপি মহাসচিব।

বিএনপির স্বাধীনতা দিবস উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক দলের ভাইস চেয়ারম্যান মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “দেশের চরম অবস্থা। দেশের যুব সমাজ, তরুণ সমাজকে বলব, আজকে মোবাইল রাখেন, ল্যাপটপ রাখেন... আজকে দেশ আপনাদেরকে আহ্বান জানাচ্ছে, দেশের ডাকে, জনগণের ডাকে আপনাদের মা-বোনের ইজ্জত রক্ষায় রাজপথে নেমে আসুন।

“দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নাই। অতীতে দেশে কোনো আন্দোলন ব্যর্থ হয়নি, গণতন্ত্র ফেরানোর এই আন্দোলনও ব্যর্থ হবে না। সকলে প্রস্তুত থাকুন, বিজয় আমাদের হবেই।”

হাফিজের সভাপতিত্বে ও মুক্তিযোদ্ধা দলের সাধারণ সম্পাদক সাদেক আহমেদ খানের সঞ্চালনায় সমাবেশে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য জয়নুল আবদিন ফারুক, ফজলুর রহমান, ফরহাদ হালিম ডোনার, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, কেন্দ্রীয় নেতা আবদুস সালাম আজাদ, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, জয়নাল আবেদীন, মুক্তিযোদ্ধা দলের ইশতিয়াক আজিজ উলফাত, যুব দলের সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, মহানগর দক্ষিণ বিএনপির ইশরাক হোসেন, ছাত্রদলের রাকিবুল ইসলাম রাকিবসহ মুক্তিযোদ্ধা দলের কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য দেন।