জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ডাকার প্রতিবাদে ৪৮ ঘণ্টা হরতালের পর একদিন বিরতি দিয়ে ফের অবরোধে ফিরছে বিএনপি।
নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সরকারের পদত্যাগসহ নানা দাবিতে আগামী বুধবার ভোর থেকে শুক্রবার ভোর পর্যন্ত ফের ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ ডেকেছে দলটি।
সোমবার বিকালে এক ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে এই ঘোষণা দেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
এ নিয়ে বিএনটি ষষ্ঠ দফায় অবরোধ ডাকল। প্রথম কর্মসূচিটি ছিল ৭২ ঘণ্টার। এরপর প্রতিটি কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে ৪৮ ঘণ্টার।
রিজভী বলেন, “অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ও সবার অংশগ্রহণের নির্বাচন এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি, উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে প্রেরণ, দলের সংগ্রামী মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সকল নেতৃবৃন্দ ও কর্মীদের মুক্তির দাবিতে আগামী বুধ ও বৃহস্পতিবার ৪৮ ঘণ্টা অবরোধ কর্মসূচি পালিত হবে। বিএনপি ২২ ও ২৩ নভেম্বর অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করছে।”
দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী ও জনগণকে এই কর্মসূচি সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য আহ্বান জানিয়ে রিজভী বলেন, “দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সকল নেতা-কর্মীকে অবরোধ কর্মসূচি সফল করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন।”
এ নিয়ে গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় ‘মহাসমাবেশের’ দিন নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের পর এখন পর্যন্ত ২২টি কর্মদিবসের মধ্যে ১৯ দিনই হরতাল বা অবরোধের ডাক এল।
এর মধ্যে ২৯ অক্টোবর এবং ১৯ ও ২০ নভেম্বর হরতাল এবং বাকি ১৬ দিন অবরোধ ডাকল দলটি। মাঝে ৭, ১৪ ও ২১ নভেম্বর কেবল বিরতি রেখেছে বিএনপি।
এসব কর্মসূচিতে নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি বা পিকেটিং সেভাবে চোখে পড়ছে না। তবে একাধিক দিন সকালে রিজভীর নেতৃত্বে ঝটিকা মিছিল হয়েছে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো অবশ্য মিছিল সমাবেশ করছে।
তবে এসব কর্মসূচিতে বিশেষ করে বাসে চোরাগোপ্তা হামলা চলছে শুরু থেকেই। হরতাল বা অবরোধ- দুই ধরনের কর্মসূচিতে প্রায় প্রতিদিনই বাসে আগুন দেওয়া হচ্ছে এখানে সেখানে। হরতালেই আগুনের ঘটনা বেশি।
ফায়ার সার্ভিস গত ২৮ অক্টোবর থেকে দুইশটির মতো বাসে বাসে আগুনের কথা জানিয়েছে। এসব ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপিকে দায়ী করা হলেও রিজভী দাবি করছেন ‘সরকারের এজেন্সি’ দিয়ে এসব ঘটনা ঘটিয়ে তাদের দলের নেতা-কর্মীদের বদনাম করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
অবশ্য আইনশৃঙ্খল বাহিনী একাধিক ঘটনায় আগুন দেওয়ার সময় হাতেনাতে বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের আটকের কথা জানিয়েছে। প্রকাশ করা হয়েছে বেশ কিছু ভিডিও।
২৯ অক্টোবরের হরতাল চলাকালে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ ও অন্যান্য দাবিতে প্রথমে ডাকা হয় ৭২ ঘণ্টার অবরোধ। সোমবার বিরতি দিয়ে ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
দুই দিনের সাপ্তাহিক ছুটি শেষে ফের ৫ ও ৬ নভেম্বর অবরোধ শেষে মঙ্গলবার ৭ নভেম্বর বিরতি দেয় বিএনপি। ১৯৭৫ সালের এই দিনটিতে সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্যে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন। সেই দিনটি বিএনপি জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে পালন করে।
এই দিনটিকে এবার কোনো কর্মসূচি না দিলেও সেদিন অবরোধ রাখা হয়নি। এরপর ৮ ও ৯ নভেম্বর ফের একই কর্মসূচি দেওয়া হয়।
শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির পর ফের ১২ ও ১৩ নভেম্বর অবরোধ ডাকে বিএনপির পাশাপাশি সমমনা দলগুলো। ১৪ নভেম্বর বিরতি দিয়ে আবার ১৫ ও ১৬ নভেম্বর ডাকা হয় অবরোধ।
এই অবরোধ চলার মধ্যেই ৭ জানুয়ারি ভোট এবং ৩০ নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমার শেষ সময় জানিয়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল।
এর প্রতিবাদে ১৭ ও ১৮ নভেম্বরের সাপ্তাহিক ছুটি শেষে দুই দিন হরতালের ঘোষণা দেয় বিরোধীরা। এই কর্মসূচি শেষে আবার মঙ্গলবার কর্মসূচি রাখেনি দলটি।
অবরোধের পাশাপাশি চলছে গ্রেপ্তার অভিযান। মির্জা ফখরুল ছাড়াও কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য মির্জা আব্বাস ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, শাহজাহার ওমর, শামসুজ্জামান দুদু, যুগ্ম মহাসচিব মজিবুর রহমান সরওয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, সাংগঠনিক সম্পাদক জহিরউদ্দিন স্বপন, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, বিলকিস জাহান শিরীন, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স।
বিএনপির দাবি এই কয়দিনে সারা দেশে তাদের ১৫ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে এবং এই অভিযান চলছেই।
এই অবস্থায় বিএনপির কেন্দ্রীয় থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের সিংহভাগ নেতাই আছেন আত্মগোপনে। রিজভী নিজেও কর্মসূচি ঘোষণা করছেন অনলাইনে।
যে দাবিতে এই কর্মসূচি, সরকার অবশ্য তা অগ্রাহ্য করছে। সংবিধানের বিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে-সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন জনসভায় নৌকা মার্কায় ভোটও চাইছেন।
নির্বাচন কমিশন এরই মধ্যে তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি গুটিয়ে এনেছে। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নির্বাচনের প্রস্তুতি জানিয়ে এসেছে কমিশন। চলতি সপ্তাহেই যে কোনো দিন তফসিল ঘোষণা হতে পারে বলে আভাস মিলেছে।
২০১১ সালে উচ্চ আদালত এক রায়ে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণার পর ওই বছরই নির্বাচিত সরকারের অধীনে ভোটের ব্যবস্থা ফিরিয়ে এনে পাস হয় সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী।
এর প্রতিবাদে আন্দোলনে গিয়ে বিএনপি ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি প্রতিহতের ডাক দেয়। টাকা হরতাল ও অবরোধের মধ্যে ভোট হয়।
এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও সেই নির্বাচনে আগের রাতে ভোট হয়ে যাওয়ার অভিযোগ তোলে আবার তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে ফেরে।