আইন বলছে, স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে এমপিদের পদ ছাড়তে হবে না, ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থনের তালিকাও দিতে হবে না।
Published : 29 Nov 2023, 01:20 AM
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় হওয়া ঠেকাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে বিকল্প (ডামি) প্রার্থী রাখার নির্দেশনা আসার পর স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার হিড়িক পড়েছে।
সেই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের তালিকায় দলটির নতুন-পুরনো মুখ যেমন আছে, তেমনই বর্তমান সংসদ সদস্যরাও আছেন, যারা এবার নৌকার টিকেট পাননি। আবার রাজনৈতিক দলের বাইরেও অনেকে প্রার্থী হতে চাইছেন।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে বর্তমান সংসদ সদস্যদের স্বতন্ত্র হওয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানার এক বক্তব্য নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে।
মঙ্গলবার রাজশাহীতে সাংবাদিকরা এ নির্বাচন কমিশনারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, অনেক সংসদ সদস্য রয়েছেন, যারা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে মনোনয়নপত্র নিচ্ছেন; আবার দল সেখানে অন্য প্রার্থী দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে সংসদ সদস্য যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চান, তাদের পদত্যাগ করতে হবে কি না।
জবাবে ইসি রাশেদা সুলতানা বলেন, “আপনারা সবাই জানেন, সংসদ সদস্যরা পদে থেকে (ভোট) করতে পারবেন না যদি উনারা স্বতন্ত্র করতে চান, তাহলে অবশ্যই উনাদের পদত্যাগ করতে হবে- এটা হল আইনের কথা।”
আইন কী বলছে?
ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম বলছেন, সংসদ সদস্যদের স্বতন্ত্র প্রার্থিতা নিয়ে নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানার ওই বক্তব্য হয়ত ‘স্লিপ অব টাং’।
তার ভাষ্য, সংসদ সদস্যরা আইন অনুযায়ী পদে থেকে নির্বাচন করতে পারেন। সেক্ষেত্রে কারো পদত্যাগের প্রশ্ন আসে না। দলীয় হোক, নির্দলীয় হোক বা সংরক্ষিত নারী আসনের হোক- সংসদ সদস্য পদে থেকেই তিনি প্রার্থী হতে পারবেন।
স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের এবং ‘লাভজনক’ পদে থাকা কাকে, কাকে নির্বাচন করতে পদত্যাগ করতে হবে, সে বিষয়ে আইনে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে বলে মন্তব্য করেন জাহাংগীর।
নির্বাচনী আইন অনুযায়ী, স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় অন্যান্য দলিলাদির সঙ্গে প্রার্থীকে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থন তালিকা দিতে হয়। দলীয় প্রার্থীর ক্ষেত্রে নিবন্ধিত দলের মনোনয়ন সংক্রান্ত প্রত্যয়ন জমা দিতে হয়।
তবে কোনো সংসদ সদস্য যদি স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চান, সেক্ষেত্রে তার ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থনের তালিকা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
ইসি সচিব বলেন, “নির্বাচন কমিশনার কী বলেছেন তা তো আমি দেখিনি। একাদশ সংসদের মেয়াদ ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত, ততদিন পর্যন্ত এ সংসদের সংসদ সদস্যরা বহাল থাকবেন। মেয়াদ শেষের আগের ৯০ দিনের মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হচ্ছে।
“সেক্ষেত্রে একাদশ সংসদের সংসদ সদস্যদের পদে থেকে নির্বাচন করতে বাধা নেই। তাদের কেউ দলীয় প্রার্থী হলে দলীয় মনোনয়ন জমা দিতে হবে, আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চাইলে শুধু সংসদ সদস্য হিসেবে একাদশ সংসদের গেজেটের কপি সংযুক্ত করলেই হবে।”
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের আইন শাখার যুগ্মসচিব মাহবুবার রহমান সরকারও একই কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, সংসদ সদস্যরা পদে থেকে নির্বাচন করতে পারবেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে কোনো সংসদ সদস্যের পদত্যাগের দরকার নেই।
১৯৯১ সালের পর বাংলাদেশে এমপি বা সরকারের মন্ত্রীদের পদে থেকে নির্বাচন করার সুযোগ ছিল না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরের ৯০ দিনে নির্বাচনের বিধান ছিল সে সময়।
কিন্তু সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বিলুপ্ত করায় সরকারের মেয়াদের শেষ ৯০ দিনে নির্বাচন করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়। এ নিয়মে দশম, একাদশ সংসদ নির্বাচন হয়েছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনও হচ্ছে একইভাবে।
পঞ্চদশ সংশোধনীর পর সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সংসদ-সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে-
(ক) মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে; এবং
(খ) মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে
তবে শর্ত থাকে যে, এই দফার (ক) উপ-দফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ, উক্ত উপ-দফায় উল্লিখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত, সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন বলেছিল, সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হলে তাতে সংসদ সদস্যদের প্রার্থী হতে কোনো বাধা নেই।
সংসদ সদস্যপদ লাভজনক কি না জানতে কমিশন আদালতের শরণাপন্ন হবে কি না জানতে চাইলে তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ বলেছিলেন, “আদালতে যাওয়ার দরকার নেই। এ নিয়ে একটি রায় হয়ে গেছে। তাতে বলা হয়েছে- সংসদ সদস্যপদ লাভজনক নয়।”
ওই রায়ের আলোকে পদে থেকে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে সংসদ সদস্যদের ‘কোনো বাধা নেই’ বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।
তবে স্থানীয় সরকারের চেয়ারম্যান ও মেয়র পদ লাভজনক বিবেচিত হওয়ায় তাদের পদ ছেড়ে তবেই সংসদ নির্বাচন করতে হয়।
ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আদালতের পর্যবেক্ষণে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদকেও ‘লাভজনক’ বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে ওই পদে থেকে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই।
একইসঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে পৌরসভার মেয়র ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের বিষয়েও একই ধরনের নির্দেশনা রয়েছে। সিটি করপোরেশনের মেয়র পদটি ‘লাভজনক’ বিবেচিত হওয়ায় তাদেরও পদত্যাগ করে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে হয়।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানার বক্তব্য জানতে কয়েকবার ফোন করা হলেও তার সাড়া মেলেনি।
স্বতন্ত্র প্রার্থীর হিড়িক কেন
দল মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে তাকে বিদ্রোহী হিসেবে তকমা দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে বহিষ্কারের মত বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়ার নজির আছে।
তবে এবার দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপি নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক দেখাতে চাইছে ক্ষমতাসীনরা।
দলটির নেতারা বলছেন, ভোটে কারও মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যেতে পারে, সেক্ষেত্রে সেখানে নৌকার প্রার্থী শূন্য হয়ে পড়তে পারে। আবার অন্যদের বাতিল হলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছাড়া অন্য কেউ থাকবে না।
এমন পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীনদের কেউ যাতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় না পায়, সেজন্য সতর্ক রয়েছে আওয়ামী লীগ।
এর আগে বিএনপির বর্জনে দশম সংসদ নির্বাচনে দেড়শর বেশি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পেয়ে যান, যা নিয়ে পরে ব্যাপক সমালোচনা হয়। এবার তেমন পরিস্থিতি এড়াতে চায় আওয়ামী লীগ।
গত রোববার দলটি ২৯৮টি আসনে প্রার্থী ঘোষণার পর দেখা যায়, একাদশ সংসদ নির্বাচনের সাধারণ ও উপনির্বাচনে জিতে এসেছেন- এমন ৭১ জন সংসদ সদস্য এবার দলীয় মনোনয়ন পায়নি। তাদের মধ্যে তিনজন বর্তমানে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে আছেন, আর চারজন আছেন, যারা আগে মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।
দলের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ‘খড়গ’ উঠে যাওয়ায় মনোনয়ন না পাওয়া এমপিদের অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
আবার সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও দলীয় মনোনয়ন দেয়নি বর্তমান কয়েকজন সংসদ সদস্যকে। দলটির সাবেক মহাসচিব ও সংসদ সদস্য মসিউর রহমান রাঙ্গাঁও এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চাইছেন।
আরও পড়ুন
স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন রাঙ্গা, জাতীয় পার্টিকে বললেন ‘পরগাছা’
রাজশাহীতে সাবেক এমপিসহ ৪ নেতার স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা
নৌকা না পেয়ে স্বতন্ত্রের মিছিলে আওয়ামী লীগ নেতারা
প্রার্থী হতে পদ ছাড়তে হবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের
নির্বাচনে কারা প্রার্থী হতে পারবেন, কারা পারবেন না