খুলনা থেকে আসা ৭২ বছর বয়সী রেখা বেগম ঠিকমত হাঁটতেই পারছিলেন না। এর মধ্যেও তাকে নিয়ে হাজির হতে হয় প্রার্থীকে।
Published : 11 Dec 2023, 10:03 PM
খুলনা-৪ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বাছাইয়ে বাদ পড়ে যাওয়া রেজভী আলমের আপিলে যে দৃশ্য দেখা গেল, তা মনযোগ কেড়েছে সেখানে উপস্থিত বহু মানুষের।
মনোনয়নপত্রে সমর্থন জানানো রেখা বেগমকে তিনি নিয়ে এসেছেন ঢাকার নির্বাচন কমিশনে। বয়সের ভারে ন্যুজ এই নারী ঠিকমত হাঁটতেই পারছিলেন না।
রেজভীর মনোনয়নপত্র যাচাইবাছাইয়ের সময় রেখা বেগমকে তার বাড়িতে গিয়ে না পেয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা ধরে নেন ‘তিনি আসলে সমর্থন দেননি।’
মনোনয়নপত্রে নাম থাকা আরও দুইজন রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে যাচাইবাছাইয়ের সময় অস্বীকার করেছেন তাদের সমর্থনের কথা।
রিটার্নিং কর্মকর্তার আদেশের বিরুদ্ধে আপিলে সোমবার রেজভী আলম সেই তিন ভোটারকে নিয়ে হাজির হন নির্বাচন কমিশনে। এ জন্য তাকে বেশ টাকাকড়িও খরচ করতে হয়।
এই তিন জনকে নির্বাচন কমিশনের সামনে হাজির করার পর মনোনয়নপত্রের বৈধতা ফিরে পেয়েছেন রেজভী। আগামী ৭ জানুয়ারির ভোটে লড়াইয়ের যোগ্যতা অর্জন হয়েছে তার।
রেজভী আলম প্রথমবার ভোটে নামলেন, যিনি নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন স্পেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে।
রেজভীর মতো আপিল শুনানির দুই দিনে শতাধিক প্রার্থী ফিরে পেয়েছেন প্রার্থিতা। এদের বেশিরভাগই স্বতন্ত্র, যাদের পোহাতে হয়েছে এই ১ শতাংশের যন্ত্রণা।
রোববার ৫৬ জন ও সোমবার ৫১ জন প্রার্থিতা ফিরে পেলেন। ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থনের প্রমাণ দিয়ে প্রথম দিন প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন ৩২ জন স্বতন্ত্র, দ্বিতীয় দিন ২৬ জন।
রিটার্নিং কর্মকর্তাদের আদেশের বিরুদ্ধে এ আপিল চলবে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
নির্বাচনী আইন অনুযায়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চাইলে নির্বাচনি এলাকায় মোট ভোটারের ১ শতাংশের সমর্থনের প্রমাণ মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হয়। খুলনা-৪ আসনের সাড়ে তিন লাখের কিছু বেশি ভোটার থাকায় রেজভীতে ৩ হাজার ৫৫২ জনের সমর্থন দেখাতে হয়েছে।
এদের মধ্যে দ্বৈবচয়নের ভিত্তিকে ১০ জন ভোটারের তথ্য যাচাই করেন রিটার্নিং অফিসার। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ও এলাকায় সরেজমিন গিয়ে ৭ জনের সমর্থনের সত্যতা পান নির্বাচনি কর্মকর্তারা। কিন্তু তিন জনের বিষয়ে ‘আপত্তি’ থাকায় মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায়।
এদের মধ্যে ৭২ বয়সী রেখা বেগমকে তার ঠিকানায় গিয়ে পাওয়া যায়নি, ৬৮ বছর বয়সী শোভা রাণী মজুমদার ও ২৩ বছর বয়সী আফিজুল ইসলাম সমর্থনের কথা অস্বীকার করেন।
এই তিনজনকে হাজির করে রেজভী বলেন, মনোনয়নপত্র জমার আগে তাকে সমর্থন করলেও রিটার্নিং কর্মকর্তার যাচাইবাছাইয়ে এই দুই জন ‘ভয়ে না করেন’।
রেজভী আলম বলেন, “রেখা বেগম বয়স্ক মানুষ। ভালো মতো হাঁটতে পারেন না, কথাও বলতে পারেন না। যেদিন তাকে রিটার্নিং কর্মকর্তার অফিসের লোকজন খুঁজতে গিয়েছিলেন, তখন তিনি অন্যত্র ছিলেন।
১% ভোটারের স্বাক্ষর তালিকার হেরফেরে বাদ অধিকাংশ স্বতন্ত্র প্রার্থী
১% ভোটারের স্বাক্ষরের বিধান পরিবর্তন করা উচিত: আনোয়ার
ভোটের প্রার্থিতা নিয়ে ইসিতে ৫৬১ আপিল
“বাকি দুজনের একজন শোভা রাণী স্বাক্ষর না করে টিপসই দিয়েছিলেন, আফিজুল ভয় পেয়েছিলেন। তানা অস্বীকার করায় এ ঘটনা ঘটে। কিন্তু তিনজনই আজ আপিলে উপস্থিত থাকায় কমিশন সন্তুষ্ট হয়ে আমার মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করেন। আমিও স্বস্তি পেলাম।”
ঢাকায় আনার বিষয়ে রাজি করালেন কীভাবে- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “এরা প্রথমবারের মতো ঢাকা শহরে এসেছেন। তাদেরকে থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা করে আনা হয়েছে।
“উনাদের আনতে তো ঝামেলা হয়। সৌজন্যতাবোধ থেকে অনেক কিছু করতে হয়। সুতরাং বুঝতে পারছেন কষ্ট হলেও প্রার্থিতা ফেরত পেতে এছাড়া বিকল্প ছিল না।”
তারা কী বললেন
সেই তিন ভোটারের পক্ষ থেকে ‘ভিন্ন’ তথ্য পেয়েছেন সাংবাদিকরা। একজন জানিয়েছেন, তাকে বোঝানো হয়েছে, মৃত ভোটার দেখানোয় বিপত্তি ঘটেছে। ঢাকায় না গেলে নানা ধরনের ঝামেলা হতে পারে।
রেখা বেগমের সঙ্গী এক নারী বলেন, “অফিসের লোকজন নাকি উনাকে (রেখা) মৃত ঘোষণা করেছিল। তাই নিজ থেকে নির্বাচন কমিশন এসেছেন। প্রমাণটা দেওয়ার জন্য, সাক্ষী দেওয়ার জন্য।”
অস্ফুট স্বরে রেখা বেগম বলেন, “আমি তো মৃত হলে (ভাতা সুবিধা) কিছু পাব না। আমি গরিব মানুষ, এজন্য এসেছি।”
তিনি এই বক্তব্য দেওয়ার সময় সাত্তার ইসলাম নামে একজন কথা ‘কেড়ে নিয়ে’ একজন বলেন, “সমর্থন করছে, সই করছে। আমরা প্রার্থিতা ফেরত পেয়ে অনেক খুশি। তারা আমাদের স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে।”
স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে ১ শতাংশ ভোটারের আগাম সমর্থন নিয়ে আগে আপত্তি করলেও প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ার পর পাল্টে যায় রেজভীর বক্তব্য।
তিনি বলেন, “এর ইতিবাচক দিক আছে, নেতিবাচক দিকও রয়েছে। এভাবে স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে না হলে অনেক প্রার্থী হত স্বতন্ত্রভাবে। এতে ইসিকে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হত।
“এটাও ঠিক, অনেকের বিরুদ্ধে মৃত ব্যক্তি বা নামসর্বস্ব তালিকা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সচেতন না না হলে এটা ঠেকানো মুশকিল।”
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে এবার ২৭১৬টি মনোনয়নপত্র জমা পড়ে। এর মধ্যে স্বতন্ত্র ছিলেন ৭৪৭ জন। বাছাইয়ে বাদ পড়ে যাওয়া ৭৩১ জনে মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী ৪২৩ জন। নির্বাচন কমিশনে এবার আপিল করেছেন ৫৬১ জন, যাদের সিংহভাগই দল নিরপেক্ষ।
অনেকে নির্বাচন কমিশনে এসে অভিযোগ করেছেন, তাদেরকে ভোট থেকে দূরে রাখার একটা কৌশল হচ্ছে ১ শতাংশ স্বাক্ষরের শর্ত।