”তাদের কাছে প্রথম স্বাধীনতাও গুরুত্বপূর্ণ না, দ্বিতীয় স্বাধীনতাও গুরুত্বপূর্ণ না। তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে লুটপাটের স্বাধীনতা।”
Published : 27 Mar 2025, 11:02 PM
গণ অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের দমন-নিপীড়ন ও ভোট ডাকাতির কথা তুলে ধরতে গিয়ে ভারতের বাংলাদেশ নীতির কড়া সমালোচনা করে জাতীয় নাগরিক পার্টির-এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, শেখ হাসিনার ‘ফ্যাসিজমের’ মূল কারিগরও ছিল ভারত।
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর আয়োজনে যোগ দিতে ২০২১ সালের মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের সময় আগ্রাসনবিরোধী আন্দোলনে নিহতদের তালিকা প্রকাশ, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও হত্যার বিচারের দাবির আলোচনা সভায় তিনি সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন।
সভায় ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অর্জিত বিজয় নিয়ে ‘প্রথম স্বাধীনতা ও দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ এর বিতর্ক নিয়েও কথা বলেন তিনি। বলেন, “আমরা যারা গত ১৫ বছর আওয়ামী নির্যাতনের ভিক্টিম ছিলাম, আমাদের কাছে এটা অবশ্যই স্বাধীনতা।”
অপরদিকে লুটপাটকারীদের কাছে ‘প্রথম স্বাধীনতাও গুরুত্বপূর্ণ না, দ্বিতীয় স্বাধীনতাও গুরুত্বপূর্ণ না। তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ’লুটপাটের স্বাধীনতা’।
আওয়ামী লীগ ও ভারত প্রসঙ্গে নাহিদ বলেন, “আওয়ামী লীগ সব সময় ভারতের স্বার্থ রক্ষা করে রাজনীতি করেছে। গত তিন-তিনটা নির্বাচনে ভোট ডাকাতি করে সব বিরোধী রাজনৈতিক দলকে দমন করে ক্ষমতায় থাকতে পেরেছে, এর মূল কারিগর ছিল ভারত। ভারতের সহযোগিতা নিয়ে শেখ হাসিনা তার ফ্যাসিজমকে দীর্ঘায়িত করতে পেরেছে।
”আওয়ামী ফ্যাসিজম ছিল ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ বা ভারতীয় আগ্রাসনের একটা এক্সটেনশন। ভারতকে খুশি করা একটা নতজানু পররাষ্ট্র নীতি রাখা শেখ হাসিনার মূল নীতি ছিল। এর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা- সাম্য, ন্যায় বিচার ও মানবিক মর্যাদার স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে।”
২০২১ সালের মোদীবিরোধী আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মোদীর আগমন নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ বিরোধীতা করে আসছিল। কারণ সে ভারতেও গণহত্যা চালিয়েছিল।
“ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলো একই কাতারে নেমে আন্দোলন করেছিল। সেই আন্দোলনে পুলিশসহ ছাত্রলীগ যুবলীগ হত্যাযজ্ঞ চালায়। সেই হত্যাযজ্ঞে ঠিক কত মানুষ নিহত হয়েছিল সেটাও সঠিকভাবে নিরূপন করা যায়নি। কোথাও ১৭ জন, কোথাও ১৪ জন আমরা শুনতে পাই। সংখ্যাটা আইডেন্টিফাই করা প্রয়োজন।”
তিনি বলেন, ”মোদীবিরোধী আন্দোলনে যাদেরকে শহীদ করা হয়েছিল তাদেরকে যেন আমরা ভুলে না যাই। গত ১৫/১৬ বছর বিভিন্ন ঘটনায় যারা নির্যাতিত হয়েছে তাদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনে বিজয় পেয়েছি, শেখ হাসিনাকে তাড়াতে সক্ষম হয়েছি। রাষ্ট্রের কাছে এটাই দাবি যে, সেই শহীদদেরকে যেন আমরা যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারি।”
গত ৫ অগাস্ট পরবর্তী সময়ে ভারতের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে এনসিপি আহ্বায়ক বলেন, শেখ হাসিনা ও তার দলের নেতাকর্মীরা এখনও ভারতে আশ্রয় নিয়ে আাছে। ভারত গণহত্যাকারীদের নিজ দেশে আশ্রয় দিয়ে কোনো ভালো উদাহরণ তৈরি করছে না।
’দ্বিতীয় স্বাধীনতা না অন্য কিছু’
চব্বিশের গণ অভ্যুত্থানের মর্যাদা নিয়ে কিছু কিছু রাজনৈতিক দলের মূল্যায়নে আপত্তি তুলে আওয়ামী লীগ সরকার পতন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা নাহিদ বলেন, “আমরা একটা ভয়াবহ সময় পার করে এসেছি। এখন প্রথম স্বাধীনতা ও দ্বিতীয় স্বাধীনতা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। আমরা যারা গত ১৫ বছর আওয়ামী নির্যাতনের ভিক্টিম ছিলাম, আমাদের কাছে এটা অবশ্যই স্বাধীনতা।
”আর যাদের ব্যাংক ব্যালেন্স অক্ষুন্ন ছিল, যারা আপোষ করে বিরোধী রাজনীতি করেছে তাদের কাছে এটা হয়ত স্বাধীনতা মনে হয় না। কারণ তারা সব সময় হয়ত স্বাধীন ছিল। তাদের কাছে প্রথম স্বাধীনতাও গুরুত্বপূর্ণ না, দ্বিতীয় স্বাধীনতাও গুরুত্বপূর্ণ না। তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে লুটপাটের স্বাধীনতা।”
দলগুলোকে ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ”গত ১৫ বছরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, সাধারণ মানুষ, ছাত্র আন্দোলনের নিপীড়িত শক্তিগুলোর ঐক্যবদ্ধ থাকা প্রয়োজন। এই ঐক্যের শক্তির মাধ্যমে আমরা আওয়ামী ফ্যাসিজমকে প্রতিহত করেছিলাম।”
হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়া যায়নি
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর আয়োজনে যোগ দিতে ২০২১ সালের মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশ সফরে আসেন। সেসময় তার সফরের বিরোধিতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন নিহত হন।
বৃহস্পতিবার বাংলা মোটরে এনসিপির কার্যালয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যেসব নিহতের স্বজনরা এসেছেন তাদের অভিযোগ, ওই ঘটনার পর থেকে কেউ তাদের খবর নেয়নি।
এছাড়া পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরে বিনা চিকিৎসায় অনেকের মৃত্যু হয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয়।
নিহত জোবায়েরের বাবা বলেন, “ছেলেটাকে হাফেজ বানাইছি। তাকে হত্যা করা হয়েছে। চারটা বছর হয়ে গেল, কেউ খবরও নিল না।”
আরেক নিহত আল আমিনের বাবা শফি আলীর অভিযোগ, “পুলিশ ছেলেটার বুকে গুলি করল, গুলি আরেক পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার ছেলেটাকে ধরে নাই। সেখানেই সে মারা যায়। তারপর তিন মাস পুলিশের তাড়ায় বাড়িতেই থাকতে পারি নাই। মামলা করা তো দূরের কথা। আমি আমার ছেলে হত্যার জন্য দায়ীদের বিচার চাই।”
আরেক নিহত আশিক মিয়ার বাবা হারিছ মিয়া অভিযোগ করে বলেন, “কাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলাম। হঠাৎ গণ্ডগোল থেকে চোখের সামনে আমার ছেলের বুকে গুলি করা হয়। হাসপাতালে বিনা চিকিৎসায় আমার ছেলে মারা গেছে, কোনো ডাক্তার চিকিৎসা দেয় নাই। আমি ছেলে হত্যার বিচার চাই।”
নিহত হোসাইনের মা সালেহা বেগম বলেন, “ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি মাদ্রাসায় হাফেজি শিখছিল ছেলে। রোববার পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। সকালে কোরআন পরা অবস্থায় ক্লাসে একটি গুলি লেগে সে শহীদ হন।”
নিহত আসাদুল্লাহ রাতিনের বাবা মো. শহিদুল ইসলাম পুলিশের বিরুদ্ধে ছেলে হত্যার অভিযোগ এনে বলেন, “২০২১ সালের ২৭ মার্চ রাত ১২টায় আমার ছেলেকে মারা হয়। পুলিশ তার মুখে বন্দুক ঠেকায়া গুলি করে। নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে নেওয়ার পর পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে আমার ছেলেটা বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে।
”হাসপাতাল থেকে সেদিন বলেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কোনো রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া যাবে না। ডাক্তারের কাজ হচ্ছে চিকিৎসা দেওয়া, তারা রাজনৈতিক কারণে চিকিৎসা দেয় না। এদের উচিত শিক্ষা দিতে হবে।”
এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সংগঠক আতাউল্লাহ তখন যুব অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা। তার অভিযোগ, “মোদীবিরোধী আন্দোলনের কারণে র. আ. ম. উবায়দুল মোক্তাদিরের নির্দেশে আমার বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়, লুট করা হয়।”
এনসিপির নেতা আকরাম হোসেনের দাবি, “মোদীবিরোধী আন্দোলনের সময় এয়ারপোর্ট থেকে আমাকে গুম করা হয়েছিল। অনেক নির্যাতন করা হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত যারা পুলিশ, লীগের সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়েছে তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। অপরাধীদের শাস্তি দিতে হবে।”
ওই সময়ের ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরে আরও বক্তব্য দেন এনসিপি নেতা সানাউল্লাহসহ আহত ব্যক্তিরা এবং নিহতদের স্বজনরা।