সরকারের পদত্যাগের দাবিকে ধামাচাপা দিতে ‘নতুন বিতর্ক’ সামনে আনা হচ্ছে বলে অভিযোগ করে বিএনপি নেতা বলেন, “যা বুমেরাং হতে বাধ্য।”
Published : 02 Aug 2024, 12:17 AM
কোটা সংস্কার আন্দোলনে নজিরবিহীন সহিংসতা ও ব্যাপক প্রাণহানির দায় দেওয়ার পর জামায়াত-শিবিরকে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধের যে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে, তার নিন্দা জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে সরকার জনদৃষ্টি ঘোরাতে চায় অভিযোগ করে তিনি বলেন, “এই সিদ্ধান্ত বুমেরাং হবে।”
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরা দলটি স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতিতে ফিরে আসার ৪৫ বছর পর বৃহস্পতিবার তাদেরকে নিষিদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় এমন বক্তব্য এল বিএনপির তরফে, যারা দুই যুগ ধরে দলটির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে রাজনীতি করেছে, আরও একবার তাদের সমর্থনে সরকার গঠন করেছে।
বৃহস্পতিবার দুপুরের পর সরকার জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধের আদেশ জারি করে। রাতে বিএনপির পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া জানান ফখরুল।
গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক মানের ন্যায়সঙ্গত ও বিশ্বাসযোগ্য, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ কোনো তদন্ত ছাড়াই কোনো রাজনৈতিক দলকে অপবাদ দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা অন্যায় এবং সংবিধান সম্মত নয়। সরকারের এই সিদ্ধান্ত অগণতান্ত্রিক এবং অসাংবিধানিক।”
বাংলাদেশের সংবিধানে রাজনৈতিক দল বা সংগঠন করার অধিকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ করার সরকারি সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছি।”
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পায় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের বদান্যতায়। তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হওয়ার পরেই রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম এক অধ্যাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের ধারাটি বাতিল করেন।
১৯৭৬ সালে জামায়াত রাজনীতিতে আসে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট বা আইডিএল নামে দিয়ে। ১৯৭৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির গোলাম আযম অনেকটা গোপনীয়তার সঙ্গে দেশে ফেরেন পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে। ভিসার মেয়াদ পেরিয়ে গেলেও তাকে কিছু বলেনি সরকার। ১৯৮১ সালে তিনি প্রকাশ্যে আসেন।
১৯৯১ সালে জামায়াতের সমর্থনে বিএনপি সরকার গঠনের মত যথেষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করে। এরপর ১৯৯৯ সালে দল দুটি জোট গঠন করে। ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ের পর মুক্তিযুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত আলবদর বাহিনীর দুই নেতা মতিউর রহমানী নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ মন্ত্রিত্ব পান।
প্রায় দুই যুগ টিকিয়ে রাখা জোট ভেঙে দেওয় হয় ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। সে সময় বিএনপি সরকারবিরোধী বৃহত্তর ঐক্য গড়তে যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। সম্প্রতি বিএনপি আবার জামায়াতসহ সব দলের কাছে বৃহত্তর ঐক্যের বার্তা দিয়েছে।
বিবৃতিতে ফখরুল বলেন, ‘‘ কোটা বৈষম্য বিরোধী শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে ‘গণহত্যা, নৃশংসতা, ফ্যাসিবাদী কায়দায় নির্মম-নির্দয় দমন নিপীড়নের জন্য’ সরকার দেশবিদেশে যখন তীব্র ক্ষোভ, ঘৃণা, চাপের মুখোমুখি, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন বন্ধু রাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও গণমাধ্যম যখন সরকারকে জবাবদিহি করতে বলছে, দেশে দলমত নির্বিশেষে ছাত্র, অভিভাবক, শিক্ষক, শিল্পী, সাংবাদিক, আইনজীবী, যুবক, নারীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ প্রতিবাদ, ধিক্কার জানিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এই ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের’ পদত্যাগের দাবি উচ্চারিত হচ্ছে, তখন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন ও চাপে রাখতে বিশ্বাসযোগ্য কোনো তদন্ত ছাড়াই নিজেদের দায় দায়িত্ব বিরোধী দলের ওপর চাপানোর অংশ হিসেবে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
বুমেরাংয়ের আশায় ফখরুল
ছাত্র আন্দোলনে ‘গণহত্যার দায়ে’ আওয়ামী সরকারের পদত্যাগের দাবিকে ধামাচাপা দিতে নতুন বিতর্ক সামনে আনা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন বিএনপি নেতা। বলেন, “যা বুমেরাং হতে বাধ্য।”
‘নন ইস্যুকে’ ইস্যু বানানোর ‘পুরনো কার্ড’ নতুন করে খেলে আওয়ামী লীগ জনদৃষ্টি ভিন্নদিকে প্রবাহিত করতে পারবে না বলেও মন্তব্য করেন বিএনপি নেতা। বলেন, “শত শত ছাত্র, কিশোর, যুবক, শিশুসহ জনতার রক্ত বৃথা যেতে দেয়া হবে না।”
‘হটকারী সিদ্ধান্ত’ নিয়ে আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে পরিস্থিতি আরো জটিল ও সংঘাতময় করে তার দায় বিরোধী দলের ওপর চাপানোর অভিযোগও আনেন ফখরুল।
‘রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলায় ব্যর্থ’
উন্মুক্ত রাজনীতির ময়দানে জনগণের সমর্থনে শান্তিপূর্ণ মোকাবেলা করাই রাজনৈতিক দলের কাজ মন্তব্য করে ফখরুল বলেন, “আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা না করে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে নির্মূল বা ধ্বংস কিংবা নিষিদ্ধ করতে সিদ্ধহস্ত। তাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে তার প্রমাণ মেলে।”
১৯৭৫ সালে সব দলকে নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল গঠনের কথা তুলে ধরে বিএনপি নেতা বলেন, “শুধু রাজনৈতিক দল নয়, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র সংগঠনকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, বাক-ব্যক্তি-সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ সকল মৌলিক গণঅধিকারসমূহ, স্বাধীনভাবে সংগঠন করার স্বাধীনতা এবং আইন বিভাগের স্বাধীনতাও হরণ করে এক ব্যক্তির দুঃশাসন কায়েম করা মহান স্বাধীনতার মূল আকাঙ্ক্ষায় কুঠারাঘাত করা হয়েছিল।”
বিএনপি বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দাবি করে দলের মহাসচিব বলেন, “জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস - শহীদ জিয়ার এই উক্তিকে ধারণ করে বিএনপি কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ নয়, উন্মুক্ত রাজনীতির ময়দানে জনগণের সমর্থনে রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলায় বিশ্বাসী।”
‘হয় সঙ্গী না হয় জঙ্গি’
আওয়ামী লীগ এমন নীতিতে বিশ্বাসী অভিযোগ করে ফখরুল বলেন, “স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে জাসদ সৃষ্টি হয়েছিল, সেই জাসদকে নির্মূল, ধ্বংস করতে হত্যাযজ্ঞ ও নির্মমভাবে দমন নিপীড়ন চালিয়েছিল।
“এই জাসদকে আওয়ামী লীগ একসময় তাদের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক প্রেসিডেন্ট মরহুম শেখ মজিবুর রহমানের হত্যার প্রেক্ষাপট রচনাকারী হিসেবে চিহ্নিত করত, সেই জাসদের একেক সময় একেক ভগ্নাংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ এক সময় ১৫ দলীয়, ১৪ দলীয় জোট করেছে, সরকার গঠন করেছে ,বর্তমানেও তাদের জোট আছে।”
জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ‘সখ্যতাও’ সর্বজনবিদিত দাবি করে তিনি বলেন, “এক সময় তারা পরস্পরের সঙ্গী ছিলেন।
“৮০র দশকে স্বৈরাচার বিরোধী সর্বদলীয় গণআন্দোলনের মধ্যে আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীকে সাথে নিয়ে আন্দোলনের পিঠে ছুরিকাঘাত করে স্বৈরাচারকে বৈধতা দিতে স্বৈরাচারের পাতানো নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।”
সে সময়েও জামায়াতে ইসলামীর নেতারা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়ে শেখ হাসিনাকর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কোরআন ও জায়নামাজ উপহার দিয়েছিলেন বলেও দাবি করেন বিএনপি নেতা।
তিনি বলেন. “উপহার দেওয়া-নেওয়ার সময় উভয় দলের নেতাদের হাস্যজ্জল ছবি আজও অনেকের মানসপটে রয়েছে।”
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ৯০ দশকে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলনেও জামায়াত ও জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের পাশে ছিল মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সংসদের ভেতর-বাইরে যুগপৎ আন্দোলনে ১৭৩ দিন হরতাল-অবরোধ করেছিল, সংসদ থেকে একত্রে পদত্যাগ করে গণতন্ত্রকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল। সে সময়ে শেখ হাসিনা জামায়াতের নেতাদেরকে পাশে বসিয়ে একত্রে কর্মসূচি দেওয়ার ছবি আজও মানুষের দৃশ্যপটে ভাসে।
“তখন জামায়াতে ইসলামীকে তাদের স্বাধীনতাবিরোধী বা জঙ্গি মনে হয় নাই। কারণ, তখন জামায়াত আওয়ামী লীগের সাথে তাল মিলিয়ে চলেছিল। আজ জামায়াত আওয়ামী লীগের ‘ফ্যসিস্ট সরকারের’ বিরোধিতা করছে। তারা আজ আওয়ামী লীগের সঙ্গী নেই বলে আওয়ামী ভাষায় জঙ্গি হয়ে গেছে।”
আওয়ামী লীগ দেশে ‘জঙ্গির সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক’ মন্তব্য করে বিএনপি নেতা বলেন, “তাদের সন্ত্রাস, নৈরাজ্যে ,হত্যাযজ্ঞে গোটা দেশ আজ অগ্নিগর্ভ, ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, দেশকে আজ ব্যর্থ রাষ্ট্রে, জংলী রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।”