ইসির সংলাপে ২৬ দলের ৩ শতাধিক প্রস্তাব

আওয়ামী লীগ এবং সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সঙ্গে সংলাপ এখনও বাকি।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 July 2022, 04:08 AM
Updated : 30 July 2022, 04:08 AM

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে শেষ হতে যাওয়া সংলাপে এপর্যন্ত ২৬টি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে তিনশরও বেশি প্রস্তাব পাওয়া গেছে।

নিবন্ধিত ৩৯টি দলের মধ্যে সবশেষ আগামী রোববার ইসির সঙ্গে বসবে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি। এছাড়া দুটি দল নির্ধারিত সময়ে সংলাপ করতে না পারায় নতুন করে সূচি চেয়েছে।

অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে ইসির সংলাপের আহ্বানে বিএনপিসহ ৯টি দল সাড়া দেয়নি।

অংশগ্রহণমূলক ভোটের প্রত্যাশা জানিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল ইতোমধ্যে বলেছেন, দলগুলোর দেওয়া প্রস্তাব বিবেচনার জন্য পর্যালোচনা করবেন।

সেই সঙ্গে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের যাবতীয় পদক্ষেপ নেবেন এবং আইন-বিধির প্রয়োগ নিশ্চিত করবেন।

এরপর সংলাপে পাওয়া প্রস্তাবগুলো দলীয় প্রধানদের কাছে পাঠানোর পাশাপাশি সরকারের কাছেও পৌঁছে দেবে নির্বাচন আয়োজনকারী সংস্থাটি।

১০ বছর আগের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শত শত সুপারিশ আসবে সংলাপে। এরমধ্যে কিছু গ্রহণযোগ্য হবে; কিছু হবে না।

“ইসির এখতিয়ারের মধ্যে যেসব প্রস্তাব থাকবে তা বাছাই করবে। নির্বাচনের পথে যা যা করণীয় তা করে যাবে ইসি।”

২০০৭-২০১২ সালে নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন ছহুল হোসাইন। দলগুলোর নিবন্ধন প্রথা চালুর পর ভোটকে সামনে রেখে রোডম্যাপ করে দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করার রেওয়াজও শুরু করে তৎকালীন কমিশন।

সাবেক এ নির্বাচন কমিশনার এবার নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটির একজন সদস্যও ছিলেন।

তিনি বলেন, সংলাপে প্রস্তাব না পেলেও কমিশন অবাধ নির্বাচনের জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেবে। সংলাপটা অতিরিক্ত কাজ। সবার মতামত নিয়ে ইসির কাজকে এগিয়ে নিতে হবে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয় তা বাদ দেবে-এ জন্য কোনো জবাবদিহিতা করতে হবে না ইসিকে।

নির্বাচন কমিশন ডাকার পরও যারা সংলাপে আসেনি তাতে কমিশনের নতুন কিছু করার থাকে না বলে মন্তব্য করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন।

“নির্বাচন কমিশন বিদ্যমান সংবিধান, আইন-বিধি মেনেই কাজ করবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে। সংবিধান সংশোধনের মতো জটিলতার মধ্যে কমিশনের কিছু করার নেই।

“সুতরাং কেউ এলো কি এলো না তা আর কমিশন দেখবে না; কমিশনকে জনগণের আস্থা নিয়ে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য ভোটের ব্যবস্থা নিতে হবে।”

দলগুলোর অনেক প্রস্তাব প্রায় একই রকম এবং অনেক প্রস্তাব নির্বাচন সংশ্লিষ্ট নয় জানিয়ে তিনি বলেন, “এখন কোনটা ইসির কাজ, কোনটা ইসির নয়; কোনটা জরুরি, কোন প্রস্তাবটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য করতে হবে- তা কমিশন দেখবে।

“সঙ্গে তো বিধি-বিধান রয়েছে। ইসিরও নতুন কোনো সুপারিশ থাকতে পারে। সব নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে বর্তমান কমিশনকে।”

সংলাপের শেষ দিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল আশ্বস্ত করেছেন, সংলাপ শেষে দলগুলোর প্রস্তাব পর্যালোচনা করে সরকারের কাছে, দলের প্রধানের কাছে সারসংক্ষেপ পাঠিয়ে দেবে কমিশন।

রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের প্রস্তাব সরকারকে দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে সিইসি জানান, নির্বাচনকালীন সরকার এ সরকারই করতে পারবে। বার্তাগুলো সরকারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।

জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান খুব সহজ নয় উল্লেখ করে দায়িত্ব পালনে সহায়তা চেয়ে নতজানু না হয়ে মেরুদণ্ড শক্ত রেখেই এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন বলেও জানান সিইসি।

দলগুলোর যত প্রস্তাব

তরিকত ফেডারেশনের ১১ দফা: সংসদ নির্বাচন ২/৩ ধাপে করা যেতে পারে; যেন প্রতি কেন্দ্রে সেনা মোতায়েন করা যায়। সংসদ নির্বাচনে ১৫০ আসনে ইভিএম; ১৫০ আসনে ব্যালট পেপার এবং স্থানীয় নির্বাচনে শতভাগ ইভিএম ব্যবহার করা যেতে পারে। নির্বাচনী ব্যয় ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ ন্যাপের ১১ দফা: দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ ও জাতীয় সংসদের আসন সংখ্যা বৃদ্ধি। প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে সংসদে প্রতিনিধিত্ব, তফসিল ঘোষণার পর সংসদ ভেঙে দেওয়া, ইভিএম ব্যবহার না করা।

গণফোরামের ১০ প্রস্তাব: নির্বাচনেকালে নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা, নির্বাচনী প্রচারণায় প্রত্যেক আসনে সব প্রার্থীদের এক মঞ্চে সভা করার সুযোগ দেওয়া।

কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ: নির্বাচনকালীন সরকার ও প্রশাসন দল নিরপেক্ষ না হলে কোনোভাবে নির্বাচন সুষ্ঠু করা সম্ভব নয়। জন আস্থা তৈরি ও ইসির দায়িত্ব পালনে মেরুদণ্ড শক্ত করে ভূমিকা নিতে হবে।

জাকের পার্টির ৪ প্রস্তাব: দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা ও হয়রানিমূলক আচরণ বন্ধ; ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজড করার পক্ষে মত দেয় দলটি।

এনপিপি’র ১৬ প্রস্তাব: স্বল্প সংখ্যক আসনে ইভিএম ব্যবহার, ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা, প্রার্থীদের জামানত বাড়ানো, বিনামূল্যে ভোটার তালিকা সরবরাহ, নিবন্ধিত দলে ৩ বছর সক্রিয়দের প্রার্থী করার প্রস্তাব।

বিকল্প ধারার ৭ দফা প্রস্তাব: সব কেন্দ্রে ইভিএম, প্রতি কেন্দ্রে অন্তত পাঁচজন করে সামরিক বাহিনীর সদস্য নিয়োগের প্রস্তাব করেছে দলটি।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের ১১ দফা: নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার, ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনা মোতায়েন, স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন ইসির অধীনে ন্যস্ত করা, সব আসনে ব্যালট পেপার ব্যবহার, ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাহীন দলের নিবন্ধন বাতিলের সুপারিশ।

ওয়ার্কার্স পার্টির ১২ প্রস্তাব: সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন; নির্বাচনকালীন স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে ন্যস্ত করা; আনুপাতির প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা, ত্রুটি দূর করে ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তাব রয়েছে দলটির।

মুসলীম লীগের ১৯ দফা: ভোটের তিন মাস আগে সংসদ বিলুপ্ত করা, ইভিএম ব্যবহার না করা, ‘না’ ভোট পদ্ধতি চালুর সুপারিশ করেছে দলটি।

ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের ৯ দফা: প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা না করে নিজস্ব লোকবল নিয়োগ, তিন দফায় ভোট করা, ইভিএমের যান্ত্রিক ত্রুটি-জটিলতা নিরসনের প্রস্তাব।

জাসদ: সংধিান অনুযায়ী নির্বাচন, ইসিকে রাজনৈতিক বিতর্কে না জড়ানো, অসাংবিধানিক দাবিকে প্রশ্রয় না দেওয়া, বিদেশি কূটনৈতিকদের অযাচিত নাক গলানোকে প্রশ্রয় না দেওয়া, প্রশাসনের কাজে প্রতিরক্ষাবাহিনীকে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের অধীনে ব্যবহারসহ ১২ দফা পরামর্শ।

খেলাফত আন্দোলনের ৪০ দফা: জন প্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে ন্যস্ত করা, সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া, সংরক্ষিত মহিলা আসন বিলুপ্ত করা, ইভিএম ব্যবহার না করা, সংসদ ভেঙে নির্বাচন, ‘না’ ভোট চালু, দলের সব কমিটিতে ৩৩% নারী প্রতিনিধিত্ব রাখার বাধ্যবাধকতা বিলুপ্ত করার প্রস্তাব।

গণফ্রন্ট: সংসদের আসন সংখ্যা ৩৫০/৪৫০ করা, এক পোস্টার এক মঞ্চে প্রচার, দলগুলোকে আর্থিক অনুদান, নির্বাচনকালীন রাজনৈতিক সরকার, স্বল্প পরিসরে ইভিএম চালুসহ ২২ দফা পরামর্শ দিয়েছে দলটি।

বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির ১৩ দফা: নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠন, ভোট কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা, বিভাগওয়ারি নির্বাচন, ইভিএম চালু স্বল্প পরিসরে, ‘না’ ভোট চালুর সুপারিশ।

গণতন্ত্রী পার্টির ৫ দফা: ধর্মের অপব্যবহার নিষিদ্ধ করা এবং ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে মত দেয় দলটি।

বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের (এমএল) ৯ দফা: ইভিএমে ভোট, নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহার বন্ধ, টাকার খেলা বন্ধ করা, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের বিষয়ে দলটির সুপারিশ রয়েছে।

খেলাফত মজলিসের ১৫ দফা: স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে ন্যস্ত করা, ভোটের ৭ দিন আগে সেনা মোতায়েন, তফসিল ঘোষণার আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া, ব্যালট পেপারে ভোট করা, ভোট কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার।

ইসলামী ঐক্যজোটের (আইওজে) ১১ দফা: নির্বাচনকালীন সরকারের আকার সীমিত করা, ৩০ জনের বেশি প্রার্থী দিলে বেতার-টিভিতে প্রচারের সুযোগ, আস্থা অর্জন করে ইভিএমের ব্যবহারের সুপারিশ।

বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট: সাংবিধানকভাবে নির্বাচনকালীন সরকার, জাতীয় পরিষদ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে দলটি।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির ২০ দফা: নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তদারকি সরকার বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন, দল নিবন্ধনের শর্ত সহজ করা, নির্বাচনী ব্যয় মাত্র ৫ লাখ টাকা নির্ধারণ, ‘না’ ভোট চালুর প্রস্তাব।

খেলাফত মজলিশের ৪ দফা: নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার, ইভিএমের ব্যবহার না করা, প্রতিটি বুথে সিসিটিভি ক্যামেরা, সংসদ ভেঙে দেওয়ার সুপারিশ।

বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের ৯ দফা: পাঁচটি মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে রাখা, জেলা প্রশাসকের পরিবর্তে নির্বাচন কর্মকর্কতাকে রিটার্নিং কর্মকর্তা, ব্যালট পেপারে ভোট নেওয়া, ৩৩% নারী নেতৃত্বের বিধান সংশোধনের সুপারিশ।

বাংলাদেশ কংগ্রেসের ১৬ দফা: নির্বাচনের সময়ে স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে রাখা, তফসিল ঘোষণার পর জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রিপরিষদ কার্যকর থাকবে না, ওই সময়ে যে সরকার থাকবে তা ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ হিসেবে গণ্য করার প্রস্তাব করেছে দলটি।

বিএনএফ: দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়, নির্বাচন হবে ইসির অধীনে। নির্বাচন কমিশনকে সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনকে নির্বাহী বিভাগের সহায়তা করা।

এনডিএম-এর ১৩ দফা সুপারিশ: জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একাধিক দিনে ভোটগ্রহণ, নির্বাহী বিভাগ থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ না দেওয়ার প্রস্তাব।

নির্বাচন কমিশনের এ সংলাপে ১৭ জুলাই থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত ২৬টি দল অংশ নেয়।

সংলাপে অংশ নেয়নি বাসদ, বাংলাদেশ মুসলীম লীগ-বিএমল, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, জেএসডি, এলডিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, সিপিবি, বিজেপি ও বিএনপি।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও জাতীয় পার্টি-জেপি পরবর্তীতে সময় চেয়েছে। ৩১ জুলাই সকালে জাতীয় পার্টি ও বিকালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপ করবে ইসি।

আরও পড়ুন

Also Read: সব দল না এলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাবে, শুনতে হল ইসিকে

Also Read: জোর করে তো আনতে পারব না, তবে ডেকে যাব: সিইসি